ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

সাংবাদিক আলেক্সিয়েভিচ সাহিত্যে নোবেলজয়ী

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

সাংবাদিক আলেক্সিয়েভিচ সাহিত্যে নোবেলজয়ী

সংবাদপত্রে দর্পণে বিম্বিত হয় দেশ, মাটি, মানুষ, সমাজের সাচ্চা প্রতিচ্ছবি। আর যাদের হাতের নিপুণ স্পর্শে এ দর্পণ বাঙময় হয়ে ওঠে, তারা হলেন সাংবাদিক। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন এমনই এক সাংবাদিক- বেলারুশের সভেৎলানা আলেকসান্দ্রভনা আলেক্সিয়েভিচ। ১৯৪৮ সালের ৩১ মে ইউক্রেনে জন্ম নেয়া আলেক্সিয়েভিচের বেড়ে ওঠা ও পড়ালেখা পিতৃভূমি বেলারুশে। স্কুলের পাঠ শেষ করে সাংবাদিকতায় ডিগ্রী নেন মিনস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি মিনস্কে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করন। পরে জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতা পেশায়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাই তার মুখ্য কাজ হয়ে ওঠে এবং এ পথ ধরেই বিকশিত হয় তার সাহিত্য প্রতিভা। ৬৭ বছর বয়স্ক এ নন-ফিকশন লেখক তার শক্তিমান লেখনীর মাধ্যমে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। তার গ্রন্থাবলী এবং বিশ্লেষণধর্মী রচনাবলীর কারণে পাঠক নন্দিত এ লেখকের সাহিত্যকর্ম এরই মধ্যে বিশ্বের ১৯টি ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে তিনি ২১টি তথ্যচিত্রের পা-ুলিপি ও তিনটি মঞ্চনাটক রচনা করেছেন, যা বুলগেরিয়া, জার্মান ও ফ্রান্সে মঞ্চস্থ হয়েছে। স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এ অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক লিখতেন বলে তাকে অনেক বিড়ম্বনাও সইতে হয়েছে। সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা করায় তাকে নির্বাসনেও থাকতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। লেখক সত্তা নিয়েই তিনি সুদীর্ঘ ১১ বছর থেকেছেন ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও সুইডেনে। তার লেখালেখির সময়কাল প্রায় ৫০ বছর। এ হিসাবে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু যা লেখেন, তা যেন সাগর সেঁচে আনা মুক্তা। বই লেখার কাজে কোন অবস্থাতেই তিনি তাড়াহুড়ো করেন না। ধীরেসুস্থে অনেক ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে বই লেখেন। সুইডেনের এসটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারেও বিষয়টি উঠে আসে। এতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বই ‘ফর হার পলিফনিক রাইটিংস : এ মন্যুমেন্ট টু সাফারিংস এ্যান্ড কারেজ ইন আওয়ার টাইম’ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলন, ‘এটি আমার দীর্ঘ সময় কেড়ে নিয়েছে, পাঁচ থেকে দশ বছর ধরে এটি আমাকে লিখতে হয়েছে।’ নিজের অস্থিমজ্জায় সাংবাদিকতার শিকড় প্রোথিত থাকায় তিনি ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, জীবনঘনিষ্ঠ তথ্যচিত্রমূলক প্রতিবেদন কাব্যিক আবহে অনেকটা উপন্যাসের ঢঙেই লিখেছেন তার গদ্য সাহিত্যে। এভাবে তিনি সৃষ্টি করেন সাহিত্যচর্চার এক নতুন ধারা, যাকে বলা হয় ‘প্রামাণ্য সাহিত্য’। মানুষের যাপিত জীবনের কষ্ট-বেদনা তার লেখার প্রধান উপজীব্য। তিনি লেখার উপাদান খোঁজেন প্রতিদিনের বহমান বাস্তব ঘটনাপ্রবাহে। এজন্য তিনি পথেপ্রান্তরে ছুটে বেড়ান। গণমানুষের কণ্ঠ থেকে উঠে আসে তার সাহিত্যের নির্যাস। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পেন ওয়ার্ল্ড ভয়েসেস ফেস্টিভালে এক ভাষণে তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন : ‘যথাযথভাবে সবকিছু উপস্থাপন করার পন্থা খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হলো, যা ঘটমান তার সবচেয়ে কার্যকর বয়ান পাওয়া যাবে পথে-প্রান্তরে, রাস্তাঘাটে, বা জনসমাগমে মানুষের কণ্ঠধ্বনি থেকে। বইপত্র পড়ে বা লেখনীর মাধ্যমে মানুষ যা তুলে ধরার চেষ্টা করছে তা থেকে আমি আসল জিনিস পাব না। কেউ যখন কিছু বলে, তা তখন শোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি সব সময় তাদের কথা শুনতে চেয়েছি।’ এভাবে শুনতে শুনতে তিনি ব্যক্তি মানুষের কণ্ঠস্বরকে তাদের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করে বহুস্বরে একীভূত করেন, সুইডিশ একাডেমি যাকে ‘অনন্তকালের হাজারো কণ্ঠে উচ্চরণে চলা জীবনের যাতনা ও সাহসিকতার সৌধ’ বলে উল্লেখ করেছেন। আলেক্সিয়েভিচকে ‘অসাধারণ লেখক’ অভিহিত করে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমির সচিব সারা দানিউস বলেন, ‘অসাধারণ লেখনীশৈলীর মাধ্যমে সর্তকভাবে যাচাই-বাছাই করা কিছু কণ্ঠের যে কোলাজ রচনা করেছেন তিনি, তা পুরো একটি যুগ সম্পর্কে আমাদের বোধের জগৎকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে।’ আলেক্সিয়েভিচের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, জীবন-বাস্তবতাকে তিনি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সাহিত্যের ফ্রেমে আবদ্ধ করতে পারেন নিপুণ পারঙ্গমতায়। তিনি নিজেও বলেছেন, ‘বাস্তব জীবনঘেঁষা ঘটনাপ্রবাহকে সাহিত্যে রূপান্তরের চেষ্টাই আমি করি। বাস্তবতা আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। এটা আমাকে জ্বালায় এবং সম্মোহিত করে রাখে, যতক্ষণ না আমি এসব কাগজে লিখি।’ তার গ্রন্থে সন্নিবেশিত মানবসৃষ্ট দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শিকার মানুষকে নিয়ে সংবেদনশীল চিন্তাভাবনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রুশ-আফগান যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন, চেরনোবিল পরমাণু দুর্ঘটনা ইত্যাদিকে ঘিরে আবর্তিত। বাস্তবে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার ভয়াবহতা তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় আবেগদীপ্ত ভাষায় তুলে ধরেন তার গ্রন্থে। এক্ষেত্রে তার অবস্থান মৌলিকভাবেই মানবিক। মানবাধিকারের পক্ষে তার অবস্থান সুস্পষ্ট। সভেৎলানার সবচেয়ে আলোচিত বই হচ্ছে ‘দ্য আনওমেনলি ফেস অব দ্য ওয়ার’। এটি তার রচিত প্রথম গ্রন্থও। ১৯৭০ সালে স্থানীয় একটি পত্রিকায় রিপোর্টিংয়ের কাজ করার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া শ’খানেক সোভিয়েত নারীর সাক্ষাতকার নেন তিনি। এর ভিত্তিতেই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে রুশ ভাষায় লেখেন বইটি। লেখা শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। কিন্তু নিজ দেশেই বইটি প্রকাশিত হতে দেননি স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। বলা হয়, এতে শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিই স্থান পেয়েছে। রুশ নারী যোদ্ধাদের বীরত্বকে অবমাননা করা হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার ওপরও জোর দেয়া হয়নি। অবশেষে মিখাইল গর্বাচভের পেরেসত্রোইকা সংস্কারের পর ১৯৮৫ সালে বইটি প্রকাশ পায়। বইটির ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। প্রকাশের পর কালজয়ী এই বইটির বিশ লাখ কপি বিক্রি হয়। ডেনিয়াস একে এক অজানা ইতিহাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা পাঠককে প্রতিটি ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে সক্ষম। সভেৎলানা বেশকিছু বই লিখেছেন। তবে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘দ্য লাস্ট উইটনেসেস : দ্য বুক অব আনচাইল্ডলাইক স্টোরিস’। ৭ থেক ১২ বছর বয়সী শিশুদের যুদ্ধ-স্মৃতি এই বইয়ের উপজীব্য বিষয়। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘জিঙ্কি বয়েজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। এটির ইংরেজী অনুবাদ ‘জিংকি বয়েজ : সোভিয়েত ভয়েস ফ্রম দ্য আফগানিস্তান ওয়ার’ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের ওপর লেখা এই বইয়ে সন্তানহারা মায়েদের কষ্টগাথা বিধৃত। এই বই রচনার পেছনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলন, ‘আমি যখন ‘জিঙ্কি বয়েজ’ বই লিখি, তখন দেখেছি আফগান মায়েরা অকপটে তাদের দুঃখ-কথা বলন, চিৎকার করে কাঁদেন।” তার বহুল আলোচিত-জনপ্রিয় আরেকটি গ্রন্থ হচ্ছে ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল : দ্য ওয়াল হিস্ট্রি অব আ নিউক্লিয়ার ডিজাস্টার’। ১৯৯৮ সালে এটি প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণের ফলে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল এটি তার শ্রুতি-ইতিহাস। এতে মূলত পারমাণবিক জঞ্জাল সরানোর ঝুঁকিপূর্ণ ও দুরূহ কাজে নিয়োজিতদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা স্থান পেয়েছে। সভেৎলানার সর্বশেষ গ্রন্থÑ ‘সেকেন্ডহ্যান্ড টাইপ’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সোভিয়েত মানসিকতার রেশ নিয়ে লেখা এই গ্রন্থটিও পাঠকনন্দিত হয় এবং লাভ করে ফ্রান্সের মর্যাদাশীল ‘প্রি মেদিসিস এসে’। এছাড়া সাহিত্যক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য বেশকিছু মর্যাদাশীল পুরস্কার তার ঝুলিতে যোগ হয়। এ রকম ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল এ্যাওয়ার্ড, কুট টুকোলস্কি সাহিত্য পুরস্কার, দ্য জার্মান প্রাইজ, পেন সাহিত্য পুরস্কার, আন্দ্রে সিনইয়াভিস্কি সাহিত্য পুরস্কার, দ্য লিপজিগ প্রাইজ, হারডার প্রাইজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সভেৎলানা হলেন প্রথম সাংবাদিক, যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা পেলেন। নোবেল সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাসে তিনি হলেন চতুর্থ গদ্য লেখক, যিনি এ পুরস্কার পেলেন। তার পূর্বে মাত্র তিনজন এ পুরস্কারে ভূষিত হন। তারা হলেনÑ থিয়োডর মমেনসেন (১৯০২), বার্ট্রান্ড রাসেল (১৯৫০) ও উইন্সটন চার্চিল (১৯৫৩)। তিনি কত উঁচুমাপের গদ্য লেখক, তা রয়েল সুইডিশ একাডেমির সচিব সারা দানিউসের বক্তব্যেই সুস্পষ্ট। আলেক্সিয়েভিচের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সারা দানিউস বলেন, ‘আপনি যদি তার বইগুলো বইয়ের তাক থেকে সরিয়ে ফেলেন, তাহলে দেখবেনÑ সেখানে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।’ এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি কতটা শক্তিমান সাহিত্যিক।
×