ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সত্তর প্রতিষ্ঠানের সায়েন্স কার্নিভ্যাল

বিজ্ঞান মনস্ক প্রজন্ম বিচিত্র ভাবনার বিস্তার অভিনব উদ্ভাবন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৫

বিজ্ঞান মনস্ক প্রজন্ম বিচিত্র ভাবনার বিস্তার অভিনব উদ্ভাবন

মোরসালিন মিজান ক্যাম্পাস একটি বটে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। ইউনিফর্ম গুনে শেষ করা যায় না। স্কুলের প্রতিনিধি যেমন আছে, তেমনি আছে কলেজের। ছেলেরা মেয়েরা মিলে ভরপুর প্রাণ। একসঙ্গে জেগে উঠেছে। সবে স্কুল-কলেজ। তাতে কী? প্রত্যেকেই বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী! বিজ্ঞান মানে বিশেষ জ্ঞান, সে হিসেবে খুব পিছিয়ে নেই এরা। বরং আগামী দিনের কত কত স্বপ্ন যে দেখাচ্ছে! এই স্বপ্নগুলো একত্রিত করে, বলা চলে, মালাটি গেঁথেছে ওয়াইডব্লিউসিএ হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুল। ৭০টির বেশি স্কুল-কলেজ সঙ্গে নিয়ে ঢাকার স্বনামধন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আয়োজন করেছে বিজ্ঞান বিষয়ক কার্নিভ্যালের। সঙ্গে আরও নানা আয়োজন। পুরো আয়োজনটির শিরোনাম তাই ‘সেকেন্ড ইয়ঙ্গারস ইন্টার স্কুল এন্ড কলেজ সায়েন্স কুইজ কার্নিভ্যাল।’ তিন দিনব্যাপী উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় মঙ্গলবার। আয়োজন সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। এর পরও প্রথম ও দ্বিতীয় দিন সেখানে গিয়ে অবাক হতে হলো। বিপুল আয়োজন! প্রথম দিন মোটামুটি দেখেই সময় শেষ। তাই দ্বিতীয় দিনও যেতে হলো। প্রকৃতই উৎসব ভেন্যু। পাঁচতলা ভবনের সবকটি জুড়ে শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি। বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজেক্ট, দেয়ালপত্রিকা, আলোকচিত্র, স্ক্র্যাপবুকÑ কত কী যে নিয়ে এসেছে শিক্ষার্থীরা! প্রথমেই দৃষ্টি কাড়ে ছোট বিজ্ঞানীদের বড় বড় প্রজেক্ট। একাধিক কক্ষে নিজেদের বিজ্ঞান ভাবনা তুলে ধরেছে তারা। ধানম-ি গবর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের তিন শিক্ষার্থী বিশাল ইটভাটা নিয়ে হাজির! প্রথম দেখায় কিছু তেমন বোঝা গেল না। তবে ফাহমিদ, জামিলসহ তিনজন চমৎকার ব্যাখ্যা করল প্রজেক্টটি। তাদের বলা থেকে পরিষ্কার হলো, ইট পোড়ানোর সময় চুল্লির মুখ দিয়ে বিভিন্ন গ্যাস বের হয়। সেখান থেকে তারা তিন ধরনের গ্যাস সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে ইউরিয়া সার তৈরি করতে সক্ষম। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মুহাম্মদ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থীরা দেখালো নিজেদের উদ্ভাবিত থ্রিডি প্রযুক্তি। মোবাইল ফোন ও একটি প্রতিফলক ব্যবহার করে এমন থ্রিডি মুভি দেখার আনন্দ নেহাত কম নয়। শিক্ষার্থীদের পক্ষে সামিয়ার দাবি, এ প্রযুক্তিতে আস্ত সিনেমাটিও দেখে ফেলা সম্ভব! একটি টেবিল ঘিরে ছিল রাইসা, ফাহ্মি ও মাহিমা। ওয়াইডব্লিউসিএ জুনিয়র গার্লস হাইস্কুল, ইকবাল রোড শাখার এই তিন শিক্ষার্থী রীতিমতো লিফট নিয়ে হাজির! তারা চৌম্বক পদ্ধতিতে লিফটের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রয়াস নিয়েছে। বিসিএসআইআর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিয়ে এসেছে ‘হাইড্রোপোনিক প্ল্যান্টস’। ক্লাস সেভেন পড়ুয়া মোহাম্মদ পুরো প্রজেক্টটি এত দক্ষতার সঙ্গে বর্ণনা করল যে, তার চেহারার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে হলো। অবশ্য একেবারে ক্লাস থ্রি, ফোর পড়ুয়া বিজ্ঞানীদেরও সন্ধান মিলল কার্নিভ্যালে। এত ছোটদের সাধারণত প্রজেক্ট নিয়ে আসতে দেখা যায় না। ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা তাই করে দেখাচ্ছে। নামের একটি প্রজেক্ট সম্পর্কে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করার পরও আটকানো গেল না রোজাকে। আবিষ্কার সম্পর্কে সুন্দর বলে বোঝালো সে। এভাবে ১২০টির মতো প্রজেক্ট। দেখে আগামীর বিজ্ঞান ভাবনা সম্পর্কে সুন্দর একটি ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি কয়েকটি কক্ষজুড়ে ছিল দেয়ালপত্রিকার প্রদর্শনী। একটি দুটি নয়, ৭০টির মতো। বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেরা এগুলো করে নিয়ে এসেছে। মূল ক্যানভাসটি শোলার। এর উপর যত পারা যায়, ডিজাইন করা হয়েছে। রচনা সংখ্যাও কম নয়। সুন্দর হস্তাক্ষরে বিজ্ঞান ভাবনার নানা দিক তুলে ধরেছে শিক্ষার্থীরা। একটি কক্ষে প্রবেশ করতেই কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল লামিসা নামের ছোট্ট এক মেয়ে। তাদের দেয়ালপত্রিকাটি দেখার আমন্ত্রণ জানাল। কিন্তু সেকী! দেয়ালিকা যে গোলাকার পৃথিবীর আদলে! সেটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিশোরী মনের বিচিত্র বিজ্ঞান ভাবনা সম্পর্কে ধারণা দিল সে। বলল, মঙ্গল গ্রহে পানি পাওয়া গেছে। একদিন মানুষ আর এলিয়েনের বন্ধুত্ব হবে। হতেও তো পারে। বক্তব্যের পক্ষে ছবি ও লেখা যুক্ত করা হয়েছে দেয়ালিকাটিতে। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলের দেয়াল পত্রিকার মূল থিম আবার রোবট। এভাবে নানা বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় দেয়ালিকায়। একটি কক্ষে আলোকচিত্র ও স্ক্র্যাপবুকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বিজ্ঞান চিন্তা। এখানে অর্ধশতাধিক আলোকচিত্র। কার্নিভ্যালের সমন্বয়ক ফ্লোরেন্স গোমেজ জানান, স্টিল ক্যামেরা এমনকি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় দারুণ সব ছবি তুলেছে শিক্ষার্থীরা। নিজেদের চারপাশ, পরিবেশ প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করেছে আলোকচিত্রের ভাষায়। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের শিক্ষার্থী অনন প্রদর্শনী কক্ষেও ছবি তুলছিল। জানালো, ছবি তোলার জন্য এমনকি ঢাকার বাইরেও চলে যাওয়া হয়। তবে লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে নয়। স্ক্যাপবুক রাখা হয়েছে কক্ষের মাঝখানটায়। এগুলোকে শিল্পকর্ম বলা চলে। অসম্ভব যতেœ গড়া স্ক্যাপবুকের পাতায় পাতায় বিজ্ঞানের রহস্য। এর বাইরেও চলছে অলম্পিয়াড, কুইজ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে দারুণ জমজমাট এক একটি দিন। আয়োজক কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু বাড়ৈ জানান, শিক্ষার্থীদের ভেতরের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতেই এমন আয়োজন। তিনি বলেন, ছোট ছোট বাচ্চারা কত কী ভাবছে। আমরা তার সামান্যই জানি। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ভাবনাগুলো সামনে আসে। একদিন দেশের উপকারে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এত বড় আয়োজনটি সামলাচ্ছে কিন্তু শিক্ষার্থীরাই। তাদের একজন সুনন্দা জানায়, অনেক আগে থেকে কাজ করছে তারা। এখনও সকাল থেকে রাত অব্দি কাজ। বাসায় কাজ করতে হয়। তবে ক্লান্তি নেই। তার মতো বিভা, রাহা, রাকা ও নিসাদের চোখে উৎসবের আনন্দ। সত্যি এই আনন্দের তুলনা হয় না কোন।
×