ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আলজাজিরায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থার বিরুদ্ধে রিপোর্ট ও জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকরা- স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৫ অক্টোবর ২০১৫

আলজাজিরায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থার বিরুদ্ধে রিপোর্ট ও জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকরা- স্বদেশ রায়

বাংলাদেশের ওপর আলজাজিরার টিভি রিপোর্টটি দেখার সুযোগ পাইনি। কয়েকজনের মুখে শুনি। সঙ্গে সঙ্গে ওয়েবসাইটে গিয়ে তাদের ৭ তারিখে আপলোড করা ‘বাংলাদেশী স্পাইস একুসড অব ব্লকিং মিডিয়া এডভারটস’ রিপোর্টটি পড়ি। আলজাজিরার অবস্থান যে বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, এর আগে তাদের বেশ কয়েকটি রিপোর্ট অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পরে কয়েকটি, কাদের মোল্লার ফাঁসির পরের রিপোর্ট সবই প্রমাণ করে দেয় সেগুলো কোন সাংবাদিকতা নয়। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হয়ে প্রচারণা চালানো মাত্র। ওই রিপোর্টগুলো দেখার পরে আমার মতো একজন ক্ষুদ্র রিপোর্টারেরও আলজাজিরার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়। অথচ সত্যি বলতে গেলে বলতে হবে, আলজাজিরার শুরুর পরে এর নিয়মিত দর্শক ছিলাম। এ নিয়ে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি এখন জাতীয় সংসদ সদস্য বলে তার সঙ্গে আর নিয়মিত কথাবার্তা হয় না তাঁর সঙ্গে বার কয়েক তর্কও হয়েছে। তিনি আমার মতো এত আলজাজিরা ভক্ত ছিলেন না। যাহোক, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে রিপোর্ট করার পরে আলজাজিরার চেহারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের অনেকের কাছে উন্মোচিত হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর ৭ অক্টোবর আপলোড করা তাদের সাইটের নিউজটি সত্যি অর্থে বাংলাদেশের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয়, এ্যালার্মিং। বাস্তবে একটি দেশের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সংস্থার বিরুদ্ধে এ ধরনের রিপোর্ট করা ওই দেশের জন্য ক্ষতিকর বললেও কম বলা হবে। এই রিপোর্টের মাধ্যমে মূলত আলজাজিরা একটি বিষয় প্রমাণ করেছে, তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর জন্য এবং তাদের সহযোগী মিডিয়া দিগন্ত টিভি, আমার দেশের জন্য যা করেছিল ঠিকই, একই কাজ তারা করল বাংলাদেশের দুটি পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলী স্টারের জন্য। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এর ভিতর দিয়ে একটি বিষয় বুঝতে সহজ হলো যে, জামায়াতে ইসলামী, দিগন্ত টিভি, আমার দেশ ও প্রথম আলো এবং ডেইলী স্টার বাস্তবে একই সমান্তরালে। কারও শত্রু পক্ষ দেখে যেমন তার পরিচয় নিশ্চিত করা যায় তেমনি মিত্র দেখেও তার পরিচয় বা অবস্থান নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু আলজাজিরার ওই রিপোর্টের বেশ কয়েকটি দিক পর্যালোচনার মতো। যেমন, যেখানে নিরাপত্তা সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলছেন, তারা এ কাজ করেন না। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সে সময়ে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা (যদিও তার নাম উল্লেখ করা হয়নি রিপোর্টে, তবে ফোন কোম্পানিটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে) বলছেন, ওই সংস্থা এ কাজ করেছে। আলজাজিরার হয়ে বাংলাদেশে রিপোর্ট করার জন্য এর আগে দু’বার এক সাংবাদিক বাংলাদেশে এসেছিলেন। একবার তাকে ফোন করলে তিনি চমৎকার বাংলায় কথা বলতে শুরু করেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানি তার বাবা বাংলাদেশী ও তিনি জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। অন্যদিকে যে ফোন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা আলজাজিরার কাছে বলছেন, ‘বাংলাদেশী নিরাপত্তা সংস্থা এ কাজে জড়িত।’ ওই ফোন কোম্পানির উর্ধতন কর্মকর্তা ফাঁসির দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদের ছেলে। অতএব বুঝতে কারও কোন কষ্ট নেই যে, কোন্্ কর্মকর্তা এ কাজটি করেছেন। এর পরে আলজাজিরার ওই রিপোর্টের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, গত ২১ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রের অংশে যাদের নাম উদ্ধৃত ছিল এখানেও তারাই আছেন। তবে এবার ডেইলী স্টারের মাহফুজ আনাম আরও সাবধানী ও সতর্ক বক্তব্য রেখেছেন। কারণ, ৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে গার্ডিয়ানের রিপোর্ট উল্লেখ না করে বলেন, কেউ কেউ বলেন, সামরিক বাহিনী আমার হাতের মুঠোয়, অর্থাৎ তারা সেটা নাড়াচাড়া করে দেখেছেন। মাহফুজ আনামের সঙ্গে এবারও ইফতেখার আছেন। এবং তিনি এমনভাবে কথা বলেছেন, যেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত শত্রুতাই এখানে প্রধান। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে, গার্ডিয়ানে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে একটা রিপোর্ট হয়েছে, আলজাজিরা একটি রিপোর্ট করেছে, দেশের ভিতর দুটি পত্রিকা সরকারের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচার করছেÑ এ আর এমন কি। একটি নির্বাচিত সরকার কি এতই দুর্বল যে, তারা এতে ভয় পাবে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের মানুষ ঘরপোড়া গরু। আলজাজিরার প্রথম দিকের রিপোর্ট, দিগন্ত টিভির নানান টক শো আর আমার দেশের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনার পর দেশের মানুষ কী দেখেছে? এই দেশের মানুষ ৫ মে দেখেছে। রাজধানীতে হেফাজতী তা-ব দেখেছে। দেশব্যাপী পুলিশ ও বিজিবি সদস্য হত্যা দেখেছে। আর সাতক্ষীরা, সাতকানিয়াসহ কয়েকটি স্থানকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত করতে দেখেছে। আর এবারও যখন আলজাজিরার রিপোর্টের পাশাপাশি দেশের ভিতরের দুটি পত্রিকার এ ভূমিকা দেখা যাচ্ছে তখন ধরেই নিতে হবে, দেশ একটি ষড়যন্ত্রের কবলে। সরকারও ইতোমধ্যে তার কিছুটা জেনে গেছে, কারণ প্রধানমন্ত্রী ১৩ তারিখের সংবর্ধনা সভায় বলেছেন, কে, কোথায়, কী করছে সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। কারণ, এ মুহূর্তে কী না চেষ্টা হচ্ছে- যেখানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি বিদেশী নিহত হওয়া সম্পর্কে বলছেন, দুফোঁটা পানিকে বৃষ্টি বলা যেতে পারে না। সেখানে আলজাজিরা যে দুটি পত্রিকার জন্য মায়াকান্না করছে তারা গত দেড় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কতভাবে যে নিউজ করছে- যে বাংলাদেশ বিদেশীদের জন্য নিরাপদ নয়। এটা সত্য যে আরেকটি ৫ মে বাংলাদেশে ঘটানো যাবে না, তবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদের রায়কে উপলক্ষ করে বাংলাদেশকে যে এক ধরনের অস্থির করার চেষ্টা চলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে যখন কোন বিশেষ গোষ্ঠী দেশের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ ধরনের অপপ্রচারে নামে, তাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের মিডিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে তা কখনই ওই দেশের জন্য ভাল নয়। এবং যারা এ কাজ করছে তারা কোন ছোটখাটো কাজ করছে না, তারা বড় একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ কাজ করছে। অন্যদিকে ১৪ অক্টোবর কালেরকণ্ঠে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হচ্ছে, ‘সাতক্ষীরা প্রতিনিধি’ ॥ ‘প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা বলেছেন, আইনের চোখে সব বিচারপ্রার্থী সমান। কে বিএনপি, কে জাতীয় পার্টি, কে আওয়ামী লীগ, কে জামায়াত- সেটা মুখ্য নয়।’ কথাটা শুনতে খুবই ভাল। একেবারে প্রথম আলো বা ডেইলী স্টার মার্কা নিরপেক্ষ মনে হবে। বাস্তবে বিচারকের চোখে তো এর বাইরে কোন কিছু হতে পারে না! কিন্তু পৃথিবীর বিচারের ইতিহাস কী তাই বলে? জার্মানি কি এখনও নাৎসী পার্টিকে রাজনীতি করার অনুমোদন দেবে? সমগ্র ইউরোপ বা আমেরিকা কি কোনমতেই হিটলার বা মুসোলিনীর দলকে এখন রাজনীতি করতে দেবে? তাদের কোন অনুসারী কি এখনও ইউরোপ বা আমেরিকায় আইনের চোখে সমান? অনেকে বার বার ভুলে যান। তাদের জন্য মনে করিয়ে দেয়া দরকার, বাংলাদেশও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের আগে ৮, ১৯৭১ ডিসেম্বর যশোর বিজয়ের পর, (যখন শান্তি কমিটির সদস্যরা ও তাদের গুরু পাকিস্তানী বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে) যশোরের জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জামায়াতে ইসলামীসহ সকল স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক অধিকার নিষিদ্ধ করেন। যা পরবর্তীতে ৭২-এর সংবিধানে স্থান পায়। এবং নিষিদ্ধ ওই স্বাধীনতাবিরোধী দলের সদস্যদের বিচার শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পাকিস্তানী আইএসআই-এর নির্দেশে এ দেশের দোসররা জামায়াতে ইসলামীসহ সকল যুদ্ধাপরাধীকে এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। তাদের জেল থেকে মুক্ত করে। তারপরের ইতিহাস এ দেশের মানুষ জানে। দীর্ঘ ত্যাগ ও সংগ্রামের পর আজ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিচার হচ্ছে। হাইকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল থেকে দেয়া একাধিক রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়েছে। এর পরে কীভাবে অন্য একজন নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের সদস্য বাংলাদেশের আইনের চোখে সমান হবে? ইউরোপ কি সেখানকার যে কোন সাধারণ নাগরিক ও একজন যুদ্ধাপরাধী বা যুদ্ধাপরাধীর অনুসারীকে আইনের চোখে একই দৃষ্টিতে দেখে? যুদ্ধাপরাধীকে সেখানে আইনের চোখে কীভাবে দেখা হয়, যে কোন বালকেও সে তথ্য জানে, তাই নতুন করে আর বলার প্রয়োজন নেই। তবে কাকতালীয় হোক আর যে কোন কারণে হোক, সাতক্ষীরায় দাঁড়িয়ে এ ধরনের কথা আইন অঙ্গনের এমন স্থান থেকে আসা দেশের জন্য ভয়ঙ্কর। কারণ, ২০১৩-এর সাতক্ষীরার অবস্থা সকলে জানেন। আবার যখন মুজাহিদ ও সাকার রায় কার্যকর হবার সময় এসেছে সে সময়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে এভাবে সমান অধিকার দিলে মূলত জামায়াতকে উজ্জীবিত করা হয়। পাশাপাশি এ ঘটনার পর সরকারের প্রতি অনুরোধ রাখব, এই বক্তব্যের পর সরকার যেন আসন্ন পুজো উপলক্ষে সাতক্ষীরার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতি আরও সতর্ক হয়। কারণ, ইতোমধ্যে সেখানে ১৫টির বেশি প্রতিমা জামায়াতের কর্মীরা ভেঙ্গেছে। এ ধরনের বক্তব্যের পর জামায়াতে ইসলামী এ ধরনের কাজ করতে আরও সাহসী হবে। [email protected]
×