ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

আমার কৈশোর (১৩ অক্টোবরের পর) ১৯৪১ সালে আমরা দুই ভাই যখন স্কুলে ভর্তি হলাম তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে; কিন্তু আমেরিকা এতে সরাসরি কোন অংশ নিচ্ছে না। আমেরিকা শুধু মিত্রশক্তিকে খাদ্য, রসদ ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করছে। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান আমেরিকার পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ করে এবং তখন থেকেই আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বরে জার্মানি এবং ইতালি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আমেরিকা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ফলে মিত্রশক্তি ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয় এবং আমেরিকা এই যুদ্ধে কি রকম ভূমিকা পালন করে সেটা আঁচ করা যায় এই যুদ্ধে হতাহত এবং যুদ্ধবন্দীর সংখ্যা বিবেচনা করলে। আমেরিকার ১ কোটি ৬০ লাখ সৈন্য এবং অফিসার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং প্রায় ৩ লাখ মৃত্যুবরণ ও ৭ লাখ যুদ্ধাহত হয়। যুদ্ধবন্দীদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার। ১৯৪০ এবং ১৯৪১ সালে ইউরোপে জার্মানি এবং ইতালি তাদের আধিপত্য বজায় রাখে। অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়া যেভাবেই হোক জার্মানি ও ইতালির অগ্রগতিতে বাধা দেয়। অক্ষশক্তি উত্তর আফ্রিকায়ও তাদের আধিপত্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে। অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ায় জাপান স্বদম্ভে এগিয়ে চলে, যদিও অস্ট্রেলিয়ায় তারা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং চীন রাশিয়ার মতোই বাধা দিয়ে চলতে থাকে। যুদ্ধের প্রথম দুই বছর আমরা বিশ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে তেমন অবহিত বা আগ্রহী ছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবে এ সম্বন্ধে প্রথম বোধোদয় হলো ১৯৪২ সালের শেষদিকে। আগস্টের ৯ তারিখে ভারতজুড়ে ভারতের বেশ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস সারাদেশে ব্রিটিশ শক্তির ‘ভারত ছাড়ো’ নিয়ে একটি আন্দোলন শুরু করে যা সে সময় ‘ছঁরঃ ওহফরধ’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভারতের রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আদায়ের জন্য বিশেষভাবে মনোনিবেশ করে। সম্ভবত এর একটি কারণ ছিল ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড লিন লিত গো’র একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। তিনি ব্রিটিশ রাজনীতিতে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন এবং পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে ভারত সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো তখন তিনি ভারতের কোন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা না করেই ঘোষণা করে দেন যে, এই মহাযুদ্ধে ভারতও লিপ্ত। এতে ভারতের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস খুবই ক্ষুব্ধ হয় এবং সরাসরি ব্রিটিশ শক্তিকে ‘ভারত ছাড়ো’ আহ্বান জানায়। ১৯৪০ থেকে ৪২ পর্যন্ত এই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বেশ জোর পায়। কিন্তু সে সময় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। তাই কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের পালে সবিশেষ হাওয়া লাগল না। সেই বছর অবশ্য ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু অক্ষশক্তির সঙ্গে যোগ দেন এবং বার্লিন থেকে রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে অক্ষশক্তিকে সমর্থন করেন। ১৯৪৩ সালে জুলাই মাসে তিনি সিঙ্গাপুরে ভারতীয় ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) গঠন করে জাপানের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। আমরা জানতে পারলাম যে, সুভাষ বসুর আইএনএ জাপানীদের সঙ্গে একতালে বার্মা (মায়ানমার) বিজয় করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের দ্বারপ্রান্তে কোহিমায় পৌঁছেছে। সুভাষ বসুর উদ্যোগে দুঃসাহসের যে পরিচয় পাওয়া গেল তাতে অনেকেই উদ্বেলিত হন, কিন্তু জাপান বোধ হয় এদেশে মোটেই পছন্দের দেশ ছিল না। সেজন্য ইউরোপ ও আফ্রিকায় মিত্রশক্তির সাফল্য মনে হয় ভারতে সমাদৃত হয়। ১৯৪৩ সালের ২১ মে সারা ভারতবর্ষে মিত্রশক্তির তিউনিসিয়া বিজয় মহা ধুমধামে অনুষ্ঠিত হয়। আমরা স্কুলের ছাত্র হিসেবে মিষ্টিমুখ এবং ছুটি উপভোগ করি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে একজন সচেতন ও সক্রিয় কিশোর হিসেবে যেসব অনুভূতি ও চিন্তা আমার মনে উদয় হয় তার খানিকটা বিবরণ নিচে দেয়া হলো। প্রথম অনুভূতি হচ্ছে, ৪৩-এর মন্বন্তর সম্বন্ধে, যাতে প্রায় অর্ধকোটি লোক মৃত্যুবরণ করে। চাল শুধু দুর্মূল্যই হয়নি, চাল পাওয়াটাই ছিল অনেক কষ্টকর। আমার মনে পড়ে, আমরা সুনীল কাকাদের চা বাগানের কোটা থেকে কিছু চাল নিয়ে আসতাম। আমার আরও মনে পড়ে, একদিন রাতে সিলেটের মহাজনপট্টিতে একটি গুদাম থেকে আব্বার সঙ্গে গিয়ে এক বস্তা চাল নিয়ে বাড়ি ফিরি। চালের দাম তখন মণপ্রতি ৫/৭ টাকা থেকে বেড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শুধু কলকাতার রাস্তাঘাটে নয়, মফস্বল শহরে ও রাস্তাঘাটে ক্ষুধার্ত মানুষ প্রকাশ্যে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এই দুর্ভিক্ষ যতটা না প্রাকৃতিক কারণে ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ভ্রান্ত খাদ্যনীতির কারণে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডরহংঃড়হ ঈযঁৎপযরষষ এবং বাংলার লাট বাহাদুর স্যার ঔড়যহ অৎঃযঁৎ ঐবৎনবৎঃ এই দুজনের সৈন্যদের জন্য মজুদ সংরক্ষণের অযৌক্তিক একগুঁয়েমির জন্য দুর্ভিক্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। খাদ্য উৎপাদনে তেমন কমতি ছিল না, তবে বার্মা থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্য আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য পরিবহনে যুদ্ধের কারণেই বিপত্তি ঘটে। সে সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবেই অনেক যানবাহন বিকল অথবা অচল করে দেয়া হয়। ১৯৪৩ সালে খড়ৎফ ডধাবষষ ভারতের বড়লাট নিযুক্ত হওয়ার পর দুর্ভিক্ষ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বাংলার খাদ্য ও সরবরাহমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দূরদৃষ্টি এবং দক্ষতার কারণে ১৯৪৩ সালে আগের বছরের চলমান দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণে আসে এবং বাংলাদেশকে চলমান দুর্ভিক্ষের কষ্ট সইতে হয়নি। ১৯৪২ সালে বিশ্বযুদ্ধের কারণে আর একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলো। সেবার আমাদের দেশে সর্বপ্রথম আফ্রিকা থেকে সেনাবাহিনী আসল। আফ্রিকানরা ছিল গড়নে বিশাল, রঙে কালো, আমাদের চেয়ে একেবারে আলাদা। যে বিষয়টি প্রকটভাবে বুঝতে পারা গেল তা হলো এশিয়ায় ব্যাপকভাবে আফ্রিকান সেনাবাহিনীর আগমন। সিলেটেও আমরা প্রায়ই নিগ্রো সেনার পদচারণা দেখতে পেতাম। আম্বরখানা পেরিয়ে আখালি এলাকায় সেনাবাহিনীর জন্য একটি ব্যারাক স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এটি হচ্ছে বর্ডার গার্ডের ছাউনি। প্রথমদিকে আমরা ভয় পেয়ে চলতাম। পরে বুঝতে পারলাম যে, তারা অত্যন্ত সহৃদয় এবং বাচ্চাদের খুব আদর করে। তারা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির সামনে মার্চে বিরতি দিয়ে বিশ্রাম নিত। সে সময় তারা আমাদের মতো কিশোরদের ডেকে লেবেনচুষ, চকোলেট এবং ছোট ছোট টিনজাত খাদ্য দিত। তার ফলে আমাদের ভয় সম্পূর্ণ কেটে গেল এবং আফ্রো বাহিনী কখন নিতে আমাদের এলাকায় থামবে তার জন্য উদগ্রীবভাবে অপেক্ষা করতাম। জাপান আসামের দ্বারপ্রান্তে আসার ফলে আমরা যুদ্ধকালে কি ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করব সে সম্বন্ধে জোরেশোরে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। জেলা প্রশাসনে এআরপি (অরৎ জধরফ চৎবপধঁঃরড়হ) নামে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানও স্থাপিত হয়। সেই প্রতিষ্ঠানে আমার বড় মামা সৈয়দ শাহ আলম চৌধুরী, যিনি স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন, তাকে সিলেটের এআরপিতে নিযুক্ত করা হয়। তারাই শহরে প্রথম সাইরেন বাজানোর দায়িত্ব নেয়। আত্মরক্ষার জন্য আরও একটি পদক্ষেপ ছিল- বিভিন্ন এলাকায় এবং বাড়িতে বাড়িতে ট্রেঞ্চ (ঃৎবহপয) কাটা। আমাদের বলা হয়েছে যে, শত্রুবাহিনী যদি আমাদের এলাকার কাছে আসে তখনই সাইরেন বাজানো হবে এবং আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। তার একটি পদক্ষেপ হবে নিকটস্থ ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেয়া। আমাদের বাড়িতেও একটি মোটাসোটা ট্রেঞ্চ কাটি। এ সময় সিলেটে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে উত্তর প্রদেশের রফি আহমেদ কিদওয়াই, আইসিএস দায়িত্ব নেন। তিনি খুব সজ্জনব্যক্তি ছিলেন এবং আমাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। তার ভাই ভারতের একজন বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা হিসেবে প-িত নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তাদেরই এক ভাইয়ের সঙ্গে বহুদিন পর ১৯৭২ সালে আমার পরিচয় হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডোমিনিকা দ্বীপে। যাই হোক, আমরা জানতে পারলাম যে, সরকারি কর্মকর্তা রফি আহমেদ কিদওয়াইয়ের বাড়িতে আত্মগোপনে আছেন কংগ্রেস নেতা অরুণা আসফ আলী। যাকে গ্রেফতার করার জন্য দিল্লীতে হুলিয়া জারি করা হয়। এই খবরটি খুবই মুখরোচক বলে আমাদের মনে হয়। কারণ সরকার একজনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছে আর সেই তিনিই সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। চলবে...
×