ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক আদালতে দুই বিচারপতির নিয়োগ তাদের মেধার স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১০ অক্টোবর ২০১৫

আন্তর্জাতিক আদালতে দুই বিচারপতির নিয়োগ তাদের মেধার স্বীকৃতি

বিকাশ দত্ত ॥ বাংলাদেশ অর্থনীতি, রাজনীতি, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিচারিক ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যারা দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে তামাশা করেছে আজ তারাই বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মডেল হিসেবে দেখছে। ইতমধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জল ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলীকে নেদারল্যান্ডসের হেগে স্থায়ী সালিশী আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই নিয়োগে শুধু বিচার ব্যবস্থাই নয়, দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বিচারপতি নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান ও সাবেক আইনমন্ত্রীসহ আইন বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন, এদেশের বিচার বিভাগের মানের বড় ধরনের স্বীকৃতি। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। এ দেশের বিচার ব্যবস্থা এমন মানে পৌঁছেছে যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর প্রশংসা হচ্ছে; যার স্বীকৃতিও দেশে-বিদেশে মিলছে। আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতাও বিভিন্ন দেশ কাজে লাগাতে চায়। আমাদের দেশে যে সমস্ত ষড়যন্ত্র চলছে তা মোকাবেলা করতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ নেতৃত্ব প্রদান করবে। আন্তর্জাতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত ১৯০৭ সালের হেগ সম্মেলনের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরবর্তী ৬ বছরের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জল ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হেগের এ আদালত থেকেই ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। হেগের ঐতিহ্যবাহী পিস প্যালেসে অবস্থিত ১১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান স্থায়ী সালিশী আদালত। ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিবদমান বিষয়ের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং সালিশ পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জল ইসলাম সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের শাস্তির জন্য হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখাসহ বিভিন্ন দৃষ্টান্তমূলক রায় দেন। বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলী আইনজীবী হিসেবে অনেক বাণিজ্যিক মামলা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। এ ছাড়া তিনি ব্লাষ্ট্রের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। অভিজ্ঞমহল মনে করছে আন্তর্জাতিক সংঘাত যত বাড়বে সেখানেই বাংলাদেশের ভূমিকা বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর হবে। স্থায়ী সালিশী আদালতে বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জল ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলীকে নিয়োগের পর অনেকেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বিচারপতি নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিসি) ও কম্বোডিয়ান যে হাইব্রিড ট্রাইব্যুনাল (ইসিসি) আছে সেখানে বাংলাদেশ থেকে বিচারপতি যাবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে। এ ছাড়া কখনও যদি সার্ক অঞ্চলের দেশের জন্য আঞ্চলিক অপরাধ আদালত গঠিত হয় তা হলে বাংলাদেশের বিচারক বা প্রসিকিউটরবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন । সম্প্রতি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে কয়েকজন দক্ষ-যোগ্য বিচারপতি অবসরে গেছেন। তাদের বিষয়টিও ভেবে দেখা যেতে পারে। এর আগে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে যোগদান করেননি। তার আগে কম্বোডিয়াতেও একজন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন , হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে দুই বাংলাদেশী বিচারকের স্থায়ী নিয়োগ এদেশের বিচার বিভাগের মানের বড় স্বীকৃতি। তিনি বলেন, আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতাও বিভিন্ন দেশ কাজে লাগাতে চায়। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, হেগে বাংলাদেশী দুই বিচারপতি নিয়োগে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা কাটিয়ে উঠতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে বাংলাদেশ নেতৃত্বে প্রদান করবে। শুধু বিচার ব্যবস্থাই নয়, শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশে বিচার বিভাগ স্বাধীন। দেশের উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে সমস্ত মামলা রয়েছে তা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। উচ্চ আদালতসহ সারা দেশে প্রায় ২৮ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। সুপ্রীমকোর্ট সূত্রে জানা গেছে, শীঘ্রই এই পরিমাণ অর্ধেকে নেমে আসবে। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন হবার পর অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন এই ট্রাইব্যুনালে দেশীয় বিচারপতি ও আইনজীবী দিয়ে বিশ্বমানের বিচার সম্ভব হবে না। অথচ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার ৫ বছরের মধ্যে ২১টি মামলার রায় হয়েছে। তার মধ্যে ২৪ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। আপীল নিষ্পত্তি হয়েছে ৫টি। দুটি মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। দুটি রিভিউয়ের অপেক্ষায়। আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আরও নয়টি মামলা। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মানবাধিকার কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট জেট আই খান পান্না জনকণ্ঠকে বলেছেন, এক সময় টবি ক্যাডম্যানরা বলেছিল দেশীয় বিচারপতি ও আইনজীবী দিয়ে মানবতাবিরোধী বিচার সম্ভব হবে না। অথচ আমাদের দেশের বিচারপতি ও আইনজীবীগণ তা প্রমাণ করতে পেরেছেন, তারা বিশ্বে অন্যান্যের চেয়েও দক্ষ ও যোগ্য; যার ফলে দেশে বিভিন্ন অপরাধের বিচার হচ্ছে। আর যোগ্যাতার কারণেই দুই বিচারপতিকে বিদেশে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যখন জেনারেল পেনো শো, আইখম্যানদের বিচার হলো তখন ক্যাডম্যানরা বলেনি জর্মান আইনজীবী লাগবে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা খুবই উন্নত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের অল্প সময়ের মধ্যে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ করে যে, যদি সত্যিকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা থাকে এবং সংশ্লিষ্ট সবাই যদি আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হন তা হলে বিশ্বমানের বিচার সম্ভব। যেটা সমস্ত বিশ্বকে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশকে এই ধরনের বিচার করার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করবে। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের মতে, আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক সাড়া পািচ্ছ। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সবখানেই সুষ্ঠুভাবে বিচার কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এতদিন যে সন্দেহ ছিল তা দূরীভূত হয়েছে। দেশীয় ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে। আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া স্বীকার করে নিয়েছে, বাংলাদেশের বিচার একটি নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের যে গণহত্যার বিচার হতে চলেছে সেখানে বাংলাদেশের বিচারের কথা উঠেছে বার বার, মডেল হিসেবে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে যে নিদর্শন সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এদিকে ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জানিয়েছেন, হেগে বাংলাদেশী দুই বিচারপতি নিয়োগের ফলে দেশের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। এক সময় যারা বাঙালীদের ঘৃণা করত তাদের মুখ বন্ধ হয়েছে। আমি আশা করি, এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বিচারপতি ও প্রসিকিউটর নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে অনেকেই অনুসরণ করছে। এভাবেই হয়ত একদিন সারা বিশ্বে বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিসমাপ্তি ঘটবে। বিশ্বের অনেক দেশেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে; যার মধ্যে রয়েছে রুয়ান্ডা, সাবেক যুগোসøাভিয়া, কম্বোডিয়া, সিয়েরালিয়ন, বসনিয়া, জার্মানি, ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, উরুগুয়ে, চিলি, প্যারাগুয়ে, মেক্সিকো, কানাডা, লিবিয়া, ফ্রান্স, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। এ সব ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো কোনভাবেই স্বাধীন নয়। এমনকি নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালেও আসামি পক্ষের কোন আপীল করার সুযোগ ছিল না। সেদিকে থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষ আপীলের সমান সুযোগ পাচ্ছে। এ সব দেশও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে অনুসরণ করছে।
×