ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

১৭ বছর পর একক প্রদর্শনী

জল্পনার নভেরা সৃষ্টির আলোয়, আবিষ্কারের দুর্লভ সুযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৮ অক্টোবর ২০১৫

জল্পনার নভেরা সৃষ্টির আলোয়, আবিষ্কারের দুর্লভ সুযোগ

মোরসালিন মিজান ॥ আশ্চর্য এক প্রতিভার নাম নভেরা। মহান এই ভাস্কর যথেষ্ট প্রতিকূল সময়ে শুরু করেছিলেন। তখন ষাটের দশক। ধর্ম চিন্তা থেকে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালীর চিন্তার স্বাধীনতা সামান্যই। আর শিল্পী মানস হলে তো কথাই নেই। অসহযোগিতা, আক্রান্ত হওয়ার ভয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন বাস্তবতা কতটা আর ডিঙানো যায়? অথচ নভেরা তাই করেছেন। পায়ে মাড়িয়ে দিব্যি সামনে হেঁটে গেছেন নারী ভাস্কর। প্রচলিত ধ্যানে বুঁদ হয়ে থাকেননি। ব্যাপক ভাংচুরের মধ্য দিয়ে গেছেন। এভাবে নিজের পথটি খুঁজে নেয়া। গড়ে নেয়া। এই অসাধ্য সাধন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি। তবে অভিমানে ডুবেছিলেন। এমনকি ছেড়েছিলেন প্রিয় স্বদেশ। কোন ধরনের যোগাযোগও রক্ষা করেননি। এসব কারণে নভেরা শুধু পথিকৃত ভাস্কর হিসেবে নয়, রহস্যমানবী হিসেবে অন্য রকম স্বীকৃতি পেয়েছেন। না, সেই রহস্য আর উন্মেচিত হবে না কোনদিন। নভেরা তা-ই থাকবেন, যা তিনি থাকতে চেয়েছিলেন। কারণ, এরই মাঝে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। নভেরা বিদায় নিয়েছেন। তবে তার সৃষ্টিরা আছে। বাংলাদেশের হয়ে আছে। বহুকাল পর সেই সব দুর্লভ ভাস্কর্য দেখার সুযোগ করে দিয়েছে জাতীয় জাদুঘর। আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের অনন্যসাধারণ রূপকার নভেরার দেখা-অদেখা বেশ কিছু ভাস্কর্য নিয়ে বুধবার থেকে নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে শুরু হয়েছে একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি কামাল চৌধুরী। চমৎকার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক লালারুখ সেলিম। জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজক প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। সমাপনী বক্তব্য রাখেন জাদুঘরের কীপার জাহাঙ্গীর হোসেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ভাস্কর নভেরাকে নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করে। বরেণ্য শিল্পীকে বাংলাদেশে আনার সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছিল। তাঁর সম্মতিও পাওয়া গিয়েছিল। কোন ফ্লাইটে কীভাবে তিনি আসবেন, কোথায় থাকবেন, কার কার সঙ্গে দেখা হবেÑ সবই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ পরে গিয়ে আহত হওয়ায় সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। নভেরা বিদেশে থাকলেও সারা জীবন বাংলাদেশী পাসপোর্ট বহন করেছেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, খ্যাতিমান ভাস্কর দেশকে ভুলে থাকেননি। মনের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। শিল্পী তাঁর কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন আশা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, নভেরার উপর যে কোন ধরনের কাজ ও গবেষণায় সরকার সহায়তা করবে। নভেরার ভাস্কর্য পাকিস্তান ও ফ্রান্স থেকে দেশে আনার ব্যাপারে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এর আগে নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে নভেরা ও তাঁর কাজ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন লালারুখ সেলিম। ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান জানান, নভেরার অনেক ভাস্কর্য পাকিস্তানে রয়ে গেছে। ফ্রান্সেও আছে বড় একটি সংগ্রহ। এসব দেশ থেকে কাজ সংগ্রহ করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান তিনি। অন্য বক্তারাও নভেরার জীবন ও শিল্পকর্ম বিষয়ে আলোকপাত করেন। বলা বাহুল্য, নভেরার একক প্রদর্শনী একটি ঘটনা। একই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে ভাস্করের প্রথম প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। এর পর দ্বিতীয় প্রদর্শনী। মাঝখানে লম্বা সময়। ১৭টি বছর। নতুন প্রজন্মের ভাস্কররা, শিল্পীরা নভেরার হাতেগোনা কিছু কাজ দেখে কাটিয়েছেন। বাকি কাজ দেখেছেন ছবিতে। এরই মাঝে সম্প্রতি প্যারিসে মৃত্যু হয় মহান শিল্পীর। এ খবরে আবারও ভক্ত অনুরাগীদের চোখ জলে ভরে ওঠে। আর তার পর প্রিয় ভাস্করকে তার সৃষ্টির আলোয় দেখার সুযোগ। প্রদর্শনী ঘিরে তাই ব্যাপক কৌতূহল। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর গ্যালারিতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণে আছে মোট ৪০টি ভাস্কর্য। সেখান থেকে ৩৪টি দিয়ে সাজানো হয়েছে গ্যালারি। সেইসঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে শিল্পীর আঁকা ২৮ ছবির অনুকৃতি। বিচ্ছিন্নভাবে দেখা কিছু ভাস্কর্য রাখা হয়েছে। আছে একেবারে কম দেখা এবং অদেখা বেশ কিছু কাজ। সিমেন্ট ও রডে তৈরি ফিগারেটিভ ওয়ার্ক দেখে সত্যি চোখকে বিশ্বাস করা যায় না। মানুষের প্রতিকৃতি, বাবা মা সন্তান যেমন আছে, তেমনি গোয়ালের গরুটি। প্রায় প্রতিটি ভাস্কর্যের মসৃণ গড়ন। বিমূর্ত ভাবনার বিস্তার। তবে প্রথম দিন সময় কম থাকায় খুঁটিয়ে দেখা যায়নি। সে সুযোগ থাকছে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। সৃষ্টির আলোয় নভেরাকে আবিষ্কারের সুযোগ নিশ্চয়ই কাজে লাগাবেন শিল্পপ্রেমী মানুষ।
×