ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গৌরব জি. পাথাং

দ্রোনাচার্যের হাতে বন্দী

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৮ অক্টোবর ২০১৫

দ্রোনাচার্যের হাতে বন্দী

গুরুদক্ষিণা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রাচীনতম প্রথা। শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর তার গুরুকে মূল্যবান উপহার কিংবা মূল্যবান দান দিতে হতো। গুরু শিক্ষাদানের বিনিময়ে তার শিক্ষার্থীর কাছ হতে গুরুদক্ষিণা দাবি করতেন। শিক্ষার্থীও তা দান করতে বাধ্য ছিল। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুদক্ষিণা নেই কিন্তু বেতন দানের রীতি আছে। প্রত্যেক শিক্ষককেই বেতন দিতে হয়। অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতনই সবচেয়ে কম। তাই শিক্ষকরা অন্য পেশাজীবী লোকদের চেয়ে বেশি অবহেলিত। তাদের পরিবার ও সন্তানরা অতিকষ্টে জীবনযাপন করে। ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ‘তালেব মাস্টার’ কবিতায় একজন শিক্ষকের করুণ কাহিনী ফুটে উঠেছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার হালচাল দেখলে মহাভারতের নিষাদপুত্র একলব্য ও শিক্ষাগুরু দ্রোনাচার্যের কাহিনী মনে পড়ে। দ্রোনাচার্য ছিলেন কৌরব ও পা-ব রাজবংশের শিক্ষক। অস্পৃশ্য জাতি বা শূদ্র জাতি একলব্যকে শিক্ষা দিতে প্রত্যাখ্যান করেন। তবু সাধনার পর ধনুবিদ্যায় পারদর্শী হন। আর বনে গিয়ে দ্রোনাচার্যের মূর্তি নির্মাণ করে গুরু হিসেবে তার প্রণাম আরাধনা করতেন। এভাবে অনেক বছর কেটে গেল। একদিন দ্রোনাচার্য ও তার শিষ্যরা হরিণ শিকারে যান। দ্রোনাচার্য তার কুকুরকে হরিণ শাবকের পেছনে লেলিয়ে দেন। কুকুর শিকারের জন্য দৌড়াতে থাকে। কুকুরটিকে দেখে একলব্য সাতটি তীর ছুড়ে মারেন এবং গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন। পরে কুকুরের কান্নার শব্দ শুনে দ্রোনাচার্য এগিয়ে এসে একলব্যের দেখা পান। একলব্য বলেন, গুরুদেব, আমি আপনার প্রত্যাখ্যাত শিষ্য। আপনাকে গুরু হিসেবে মেনে তীর চালনা শিখেছি। একলব্য গুরু দ্রোনাচার্যকে পেয়ে খুবই খুশি হন। দ্রোনাচার্য বলেন, তুমি যদি আমার শিষ্য হও তবে গুরুদক্ষিণা প্রদান কর। একলব্য তাতে রাজি হন। দ্রোনাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দাবি করেন। একলব্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার মূল্যবান বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদান করেন। ফলে একলব্য তার শিক্ষা-দীক্ষা হারিয়ে ফেলেন। তীর চালানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এই কাহিনীর দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যারা অস্পৃশ্য, যারা গরিব তাদের জন্য শিক্ষা নয়। শিক্ষা ধনীদের জন্য। কিন্তু শিক্ষা সবার জন্যই হওয়া উচিত। আমাদের দেশ ও সমাজে অনেক দ্রোনাচার্য বিদ্যমান। তাদের আন্তরিক ইচ্ছা, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে কিংবা চতুরতার কারণে শিক্ষার বাণিজ্যিকায়ন হয়েছে। গুরুদক্ষিণার আধুনিক সংস্করণ হলো বেশি বেতন লাভ ও মুনাফা অজর্ন। তাই দেখি শিক্ষাবিস্তারের নামে কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টার, টিউটরিয়াল শুরু হলেও তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, অমনোযোগী ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয় কিংবা শতভাগ পাস করার নিশ্চয়তা ইত্যাদি হাজার রকমের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তাদের মন ভোলানো কথায় অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানে ভর্তি করেন। ছাত্রছাত্রীরা সেখানে গিয়ে পরীক্ষায় পাস করার জন্য অনেক কিছুই শেখে কিন্তু জীবনের জন্য কিছুই শেখে না। তাই অনেকেই স্কুল-কলেজের পড়াশোনা সমাপ্ত করেও চাকরি পায় না। জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বেকারত্ব বরণ করতে হয়। তাই শিক্ষকদের এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। সকল শিক্ষার্থী যেন ভাল শিক্ষা পায় সেদিকে নজর দিতে হবে। রামপুরা, ঢাকা থেকে
×