ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরবরাহ হ্রাস হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি বিপাকে জুট মিল ও রফতানিকারকরা

এবার পাটের মজুদদারি

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৬ অক্টোবর ২০১৫

এবার পাটের মজুদদারি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ হঠাৎ করেই বাজারে পাটের দর বেড়ে গেছে। সেইসঙ্গে হ্রাস পেয়েছে বাজারে পাটের সরবরাহ। বর্তমানে ভাল মানের পাট দুই হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এতে কৃষক লাভবান হলেও বিপাকে পড়েছে পাট শিল্পের উদ্যোক্তা ও কাঁচাপাট রফতানিকারকগণ। তারা অভিযোগ করেন, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুদদারগণ কাঁচাপাট মজুদ করছে। ফলে বাজারে পাটের সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। এ কারণে দেশের পাটকলসমূহ উপযুক্ত মূল্যে কাঁচাপাট ক্রয় করতে পারছে না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে পাটকলসমূহে কাঁচাপাটের অভাবে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশন সোমবার এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, বর্তমানে পাটের ভরা মৌসুমে বাজারে কাঁচাপাটের সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং মূল্য পরিস্থিতি অত্যন্ত উর্ধমুখী। প্রতি মণ উন্নতমানের কাঁচাপাট বর্তমানে ২০০০ থেকে ২১০০ টাকা এবং নিম্ন মানের পাট ১৬৫০ থেকে ১৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত হাট-বাজারে কাঁচাপাটের নিয়ন্ত্রণ এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুদদার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে এক শ্রেণীর অসাধু কাঁচাপাট ব্যবসায়ী কাঁচাপাটের মজুদ শুরু করেছে। এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কাঁচাপাটের বাজার নিয়ন্ত্রণে পাট মন্ত্রণালয়ের নেয়া সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। কারণ পাটকলসমূহ বন্ধ হয়ে গেলে বিশেষ করে ক্ষতি সাধিত হবে দেশের পাট চাষীদের এবং পাট শিল্পের। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর কাঁচাপাটের বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চার দফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসকগণদের অনুরোধ জানানো হয়। পদক্ষেপগুলো হলো- ক) কাঁচাপাটের ডিলার/আড়তদারগণ যাতে ১০০০ মনের বেশি কাঁচাপাট এক মাসের বেশি সময় ধরে মজুদ না রাখে, খ) লাইসেন্সবিহীন অসাধু ব্যবসায়ীদের কাঁচাপাটের ক্রয়/বিক্রয় ও মজুদ হতে বিরত রাখা, গ) ভিজা পাটের ক্রয়-বিক্রয় রোধ করা এবং ঘ) বাজারে কাঁচাপাটের সরবরাহ নিশ্চিত করা। দেশের কাঁচাপাটের বাজারের পরিস্থিতি উন্নয়নের স্বার্থে এ্যাসোসিয়েশন থেকে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছিল বাংলা তোসা রিজেকশন (বিটিআর) এবং বাংলা হোয়াইট রিজেকশন (বিডব্লিউআর) গ্রেডের কাঁচাপাট রফতানি যেন অনতিবিলম্বে বন্ধ করা হয়। বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশে উৎকৃষ্ট মানের কাঁচাপাট উৎপাদিত হয় এবং বাংলাদেশই একমাত্র কাঁচাপাট রফতানিকারক দেশ। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট কাঁচাপাট রফতানি হয় ৯.২৪ লাখ বেল, এর মধ্যে বিডব্লিউআর গ্রেডের কাঁচাপাট রফতানি হয় ৪,৩২৩ বেল এবং বিটিআর গ্রেডের কাঁচাপাট রফতানির পরিমাণ ২.৬০ লাখ বেল। দুই গ্রেড মিলিয়ে মোট ২.৬৪ লাখ বেল, যা মোট পরিমাণগত রফতানির ২৮.৬৬ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যা ছিল ২৯.৬৭ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ছিল ৪৮.০৩ শতাংশ। বাংলাদেশ যে পরিমাণ কাঁচাপাট রফতানি করে তার মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশ ‘রিজেকশনের’ নামে লং জুট রফতানি হয়ে যাচ্ছে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য বিটিআর ও বিডব্লিউআর গ্রেডের কাঁচাপাট রফতানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) অপর এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত কোরবানির ঈদের আগে হঠাৎ কাঁচাপাটের দাম মণপ্রতি ১৫০ টাকা বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে তোষা ক্রোস পাট ১৯৫০ টাকা থেকে ২১০০ টাকা, সাদা ও মেস্তা ক্রোস পাট ১৮৫০ থেকে ২০০০ টাকায় দাঁড়ায়। ঈদের পর বর্তমানে প্রতি মণ পাটের দাম আরও প্রায় ৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে তোষা ক্রোস পাট ২১৫০ টাকা, সাদা ও মেস্তা ক্রোস পাট ২০৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেইসঙ্গে বাজারে কাঁচাপাটের সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। অথচ কাঁচাপাট ব্যবসায়ীরা বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে আগের দরে কাঁচাপাট রফতানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর হঠাৎ দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে। এমনকি বিজেএমসি ও বেসরকারী জুট মিল মালিকগণও একই সমস্যায় পড়েছে। ফলে কাঁচাপাট রফতানিকারকগণ বিদেশে কাঁচাপাট রফতানি করতে পারছে না। কারণ চুক্তিকৃত পাট বিপুল লোকসানের বিনিময়ে রফতানি করতে হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অব্যবসায়ীরা (যাদের কোন ট্রেড লাইসেন্স এবং টিন সার্টিফিকেট নেই) কাঁচাপাট মজুদ করছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী এক সভায় টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। কাঁচাপাটের বাজার বেসামাল হওয়া সত্ত্বেও সহকারী পরিচালক ও মুখ্য পাট পরিদর্শক কোন রিপোর্ট পেশ করছে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক, ইউএনও অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানের মাধ্যমে মজুদদারদের কবল হতে কাঁচাপাট খোলা বাজারে সরবরাহের ব্যবস্থা করে রফতানিকারকদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য জোরদাবি জানানো হয়েছে। এ্যাসোসিয়েশগুলোর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে সাধারণত ৬৫ থেকে ৭৫ লাখ বেল কাঁচাপাট উৎপাদন হয়। বর্তমান পাট মৌসুমে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কাঁচাপাটের ফলন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বছরের ফলন ৫৫ থেকে ৬০ লাখ বেলের বেশি হবে না। গত বছরের কাঁচাপাটের মজুদ না থাকার কারণে এ বছর কাঁচাপাটের প্রাপ্যতা দাঁড়াবে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ বেল। বাংলাদেশের পাট শিল্পে পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য বছরে প্রায় ৫৪ লাখ বেল কাঁচাপাটের প্রয়োজন এবং রফতানির জন্য আরও প্রায় প্রায় ১০ লাখ বেল কাঁচাপাট প্রয়োজন। শিল্পের জন্য ও রফতানির জন্য প্রয়োজন প্রায় ৬৪ লাখ বেল। পাট শিল্পের প্রধান ব্যবহারকারী বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সদস্যদের জন্যই প্রয়োজন উন্নত মানের ৩৫ লাখ বেল পাট। এছাড়া বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনের জন্য ১০ লাখ বেল এবং বাংলাদেশ জুট মিল এ্যাসোসিয়েশনেরন সদস্যদের জন্য প্রয়োজন ৯ লাখ বেল। এ বছর পাট মৌসুমে কাঁচাপাটের ফলন কম হওয়ায় বিজেএসএ উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১৮ আগস্ট বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রীর কাছে একটি পত্র প্রদান করা হয়। পত্রে জানানো হয়, দেশের পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ শিল্পের কাঁচাপাটের জোগানে নিশ্চয়তা একান্ত প্রয়োজন। কাঁচাপাটের সরবরাহ বিঘœ হলে দেশের পাট কলসমূহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রায় ২ লাখ পাটকল শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে, যার ফলে শ্রমিক অসন্তোষ প্রচ-ভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং সেইসঙ্গে পাটপণ্য রফতানিতে ব্যাপক ধস নামবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।
×