ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৬ অক্টোবর ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

কয়েকটা দিন গেল বেশ আরামে আয়েশে; কারও কারও ঈদের ছুটি যেন ফুরোতেই চায় না। ঢাকাবাসী যারা ঈদ উপলক্ষে ঢাকার বাইরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্ভার নিরবচ্ছিন্ন কয়েকটা দিন কাটাতে গিয়েছিল, একে একে তাদের ফিরে আসতে হয়েছে জীবিকার প্রয়োজনে। রোববার থেকে পুরো দমে শুরু হয়ে গেছে কর্মচাঞ্চল্য; ঢাকা ফিরে পেয়েছে তার পুরনো চিরাচরিত রূপ। অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় তাপমাত্রা পঁয়ত্রিশ ছুঁইছুঁই করছে। এটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করতেই একটু সন্দেহবশত গত বছর এ সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা কীরকম ছিল পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি- ও মা, ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যেই ওঠানামা করেছিল পুরো সপ্তাহের তাপমাত্রা। মধ্যরাতে গরমে হাঁসফাঁস যারা ঘরের বাইরে তাকিয়েছেন, তারা দেখতে পেয়েছেন স্থিরচিত্রের মতোই স্থবির হয়ে আছে চারপাশের দৃশ্য। একটুও হাওয়াবাতাস নেই। মশারি খুলে ফেললে সিলিং ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগে বটে। কিন্তু তার কি যো আছে? একদঙ্গল মশা ছেঁকে ধরবে নির্ঘাত। অবশ্য এসি চালিয়ে যারা ঘুমোন তাদের কথা আলাদা। নিদ্রাদেবী তাদের শরীরে স্বস্তি ও শান্তির পরশ বুলিয়ে দেন। ভাবছিলাম, যাদের ঘরে ফ্যান নেই, ঢাকায় তারা রাত পার করছেন কিভাবে! আর যাদের ঘরই নেই, তারা! বাস-মিনিবাসে অনিয়ম কেউ কি বিশ্বাস করবেন যদি বলি উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের একমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিআরটিসি বাসের সার্ভিস ঈদ উপলক্ষে পাক্কা ১৫ দিন বন্ধ ছিল? এই বাসে আমি যাতায়াত করি বলে আর কেউ বিশ্বাস না করুক, সত্যটি আমার জানা। ঈদের আগে ৫ দিন, ঈদ থেকে ঈদের পরে মোট ১০ দিন- এভাবে ১৫ দিন এই রুটে এসি বাস চলেনি। কর্মচারীরা কি ছুটিতে গিয়েছিল? তা নয়। উত্তরবঙ্গে বাসগুলো যাতায়াত করেছে। মহানগরীর অভ্যন্তরীণ পরিবহনের বাস কিভাবে দূরপাল্লায় যায়? একদিন-দুদিন নয়, পনেরোটা দিন বাস সার্ভিস বন্ধ রাখা হয় কোন শক্তিতে? এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার লোক নিশ্চয়ই আছে। তারা নীরবতা অবলম্বন করেন। এই অন্যায়ের বিচার করবে কে? রাজধানীর গণপরিবহন নিয়ে অভিযোগ ও ভোগান্তির অন্ত নেই। এর ওপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নামে যাত্রী হয়রানি। এতে রীতিমতো পকেট কাটা হচ্ছে যাত্রীদের। সিএনজির দাম বাড়ায় ঢাকা ও এর আশপাশের জেলায় এবং চট্টগ্রামে এই গ্যাস চালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া প্রত্যেক যাত্রীর জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা বৃদ্ধি করে সরকার। মাসের পয়লা দিন, অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার থেকে এই নতুন ভাড়ার হার কার্যকর হয়েছে। নতুন হার অনুসারে বড় বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা। মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৬০ পয়সা। এখনও অধিকাংশ বাসে সরকারী ভাড়ার তালিকা টাঙানো হয়নি। কিছু কিছু বাস-মিনিবাসে যে তালিকা টাঙানো হয়েছে, তা সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা নয়। মালিক সমিতিগুলো নিজেরাই এসব তালিকা তৈরি করেছে। বলাবাহুল্য এসব পরিবহন যাত্রীদের পকেট কাটছে। উদাহরণস্বরূপ, ৩ নং লোকাল বাসটি মহাখালী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আগে যাত্রীপ্রতি ভাড়া নিত ১০ টাকা। এখন আদায় করা হচ্ছে ১৫ টাকা। ১০ পয়সা হারে ভাড়া বাড়লে মহাখালী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দূরত্ব ধরা হবে ৫০ কিলোমিটার। এভাবে যুক্তি দিলে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বচসা বেধে যাচ্ছে। অবশ্যই এর বিহিত করতে হবে। তা না হলে পথেঘাটে বাসে-মিনিবাসে গোলমালের অবসান হবে না। এক সময় মানুষ আর বাস মালিকদের দুষবে না। তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর প্রতি বিরূপ হবে। আরও স্পষ্ট করে বলতে হয় এই স্বেচ্ছাচারিতার জন্য মানুষ মনের গভীরে সরকারের ওপরেই ক্ষোভ লালন করবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত দু-একজনের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি কেন নষ্ট হবে? আন্তরিক উৎসব গত সপ্তাহে রাজধানী প্রত্যক্ষ করেছে এক আকস্মিক আন্তরিক উৎসব। বহির্বিশ্বে মাতৃভূমির গৌরব বৃদ্ধি পেলে তা উৎসবের উপলক্ষ হওয়া স্বাভাবিক। বাঙালীর আবেগ কিছুটা বেশি। অল্প শোকে সে কাতর হয়, অধিক শোকে পাথরও। বড় আনন্দে তার খুশির ছটাও হয় দেখবার মতো। বাঙালীর একটা সমস্যা হচ্ছে, সে বিভক্তি মেনে নেয়। আমি যাকে পছন্দ করি না তার অর্জনে আমার মুখে কোন আনন্দের অভিব্যক্তি ফোটে না। বরং ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরতে থাকি। তবে ব্যক্তির উর্ধে দেশ, দেশের অর্জনে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জনে, দলমতনির্বিশেষে দেশের নাগরিকের গৌরব বোধ করাই সমীচীন। জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের দেয়া ‘আইসিটি এ্যাওয়ার্ড’ পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেটি বর্ণিল উৎসবেই পরিণত হয়। শনিবার বেলা দেড়টার দিকে বিমানবন্দরে নামার পর থেকে গণভবনে পৌঁছানো পর্যন্ত নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের শুভেচ্ছা আর ভালবাসায় সিক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান হাজারো নেতাকর্মী। পতাকা উড়িয়ে, ফুল ছিটিয়ে, হাত নেড়ে নেত্রীকে স্বাগত জানান তাঁরা। নেত্রীকে ভালবাসা জানানোর জন্য সকাল থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল রাজধানীতে। ভিড় ও যানজটের জন্য পথে অনেকটা সময় আটকে থাকতে হবে ভেবে সাবধানী মানুষরা আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। ব্যান্ড পার্টি, ভুভুজেলা বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো হয়। নেত্রীর উদ্দেশে হাত নাড়েন তাঁরা। হাতে থাকা ছোট পতাকা উড়িয়ে স্বাগত জানান। কখনও ছিটিয়ে দেন ফুল। প্রধানমন্ত্রীও গাড়ি থেকে তাঁদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। নাগরিক নাকি আরণ্যক! নাগরিকদের কা-জ্ঞান নিয়ে মাঝেমধ্যেই এ কলামে কথা বলি। একটু সচেতন করার চেষ্টা আরকি। তবে অনেক সময় এটি অরণ্যে রোদনের মতোও শোনায়। তবু আমাদের দায়িত্ব পালন করে যেতেই হবে। পাঁচজনও যদি নিজেকে শুধরে নেয় তাহলেও তো রাজধানী সুস্থতার পথে সামান্য হলেও এগোয়। চলতি পথে চোখ খোলা রাখলেই দেখবেন নর্দমার পাশে কিংবা দেয়ালের সামনে কিংবা একটা একলা গাছকে অবলম্বন করে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করছেন। ইউরোপ-আমেরিকাতেও বাঙালীর এ বদভ্যাস যায় না! এই কুশ্রিতা দেখে দেখে হয়ত অনেকেরই চোখ সয়ে গেছে, কিন্তু এটা কত বড় অসভ্যতা তা কে কাকে বলে দেবে! এটা ঠিক যে, ঢাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়নি। যে শহরে খুব বেশি হলে দশ লাখ মানুষের বসবাস করা সমীচীন সেখানে দেড় কোটি মানুষ বসবাস করলে কিভাবে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব? যত যুক্তিই আমরা কপচাই না কেন, রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে হুটহাট দাঁড়িয়ে প্যান্টের জিপ খুলে কিংবা লুঙ্গি তুলে মূত্র ত্যাগ করতে দাঁড়িয়ে বা বসে যাওয়ার মতো গর্হিত কাজকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। লোকটিকে লজ্জা দেয়া কর্তব্য। বিশ্ব বসতি দিবস বিশেষ দিবস রয়েছে প্রায় প্রতিটি দিনই। এমনকি কোন কোন দিন একাধিক দিবসও পালিত হয়ে থাকে বিশ্বব্যাপী। গতকাল সোমবার ছিল বিশ্ব বসতি দিবস। রাজধানী ঢাকায় লাখো মানুষের বসতি নেই, হয় তারা থাকে বস্তিতে, তা না হলে খোলা আকাশের নিচে। এক সময় ঢাকাকে বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস। কেন বলা হতো? কারণ এখানে ছিল বিশাল খোলা প্রান্তর আর স্বাস্থ্যপ্রদ প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখন তার কী দুর্দশা তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। বসবাসের প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে শহরটি। একটি শহরে ২৫ শতাংশ খোলা জায়গা রাখা বিজ্ঞানসম্মত। তার মানে এটি মানবসম্মত। এর চেয়ে কম হলেই মানবজীবনে হাঁসফাঁস শুরু হয়। ২৫ শতাংশ থাকার কথা, আর আছে মোটে সাড়ে ৮ শতাংশ। এই অকিঞ্চিৎকর জায়গায় ভবন-ব্যবসায়ীদের থাবার শিকার। ঢাকা তাহলে বাঁচবে কিভাবে? জাতিসংঘ ১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর তার ৪০তম সাধারণ অধিবেশনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি হলো প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালন করা হবে বিশ্ব বসতি দিবস। ইংরেজীতে যা হয় ‘ওয়ার্ল্ড হেবিটেট ডে’। পরে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘ ‘জাতিসংঘ বসতি পুরস্কার’ প্রদান করছে। পুরস্কারের উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে মানবজাতির বসতবাড়ি ও পরিবেশ উন্নত করার জন্য অনুপ্রাণিত করা। এই বসতি বলতে ধরে নেয়া হয়েছে শহুরে জীবনের বসতিকে। এমনকি জাতিসংঘের বিশ্ব বসতির মূল কথাটি হলো- ফর এ বেটার আরবান ফিউচার। অর্থাৎ একটি উন্নত শহুরে ভবিষ্যতের জন্য। গৃহায়ণের সমস্যা হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিমা গড়ার প্রহর শরত যত ফুরিয়ে আসছে, শারদীয়া দুর্গোৎসবের সময় তত কাছে চলে আসছে। ঢাকের বাদ্য, পূজারিদের উলুধ্বনি, প্রসাদ বিতরণ আর আরতির অপেক্ষা চলছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা শুরু হতে বেশি দেরি নেই। প্রতিমা কারিগররাও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে বেশ ব্যস্ত। অচিরেই শুরু হয়ে যাবে মন্দিরে মন্দিরে প্রতিমার সাজসজ্জা ও প্যান্ডেল স্থাপনসহ অন্যান্য কাজ। চলছে মা দুর্গার লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির জরির কাজ, গণেশের ধুতিতে নকশাদার পাড় বসানো, আর মহিষাসুরের জমকালো পোশাক তৈরির কাজ। তাঁতীবাজার আর শাঁখারীবাজার ঢাকার সবচেয়ে ঘিঞ্জি এলাকা। সেখানেই ঢাকার সবচেয়ে বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বসবাস। প্রতিবছর পূজা এলেই এ এলাকার সরু অলিগলির ভেতরে দেখা যায় ৪০-৫০টি মণ্ডপ। প্রচলিত ম-পেই কারিগররা কাজ করে থাকেন। প্রতিমা তৈরির কাজটি দেখেও বড় আনন্দ। খড় ও বাঁশ দিয়ে প্রথমে বেণি বাঁধা হয়। এরপর কাঠামো নির্মাণ করে মাটি, পাট, সুতা ও খড় দিয়ে গড়া হয় পুরো প্রতিমা। সড়কে শিক্ষার্থী-পুলিশ সংঘাত মেডিক্যালে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ঈদের তিন দিনের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবস থেকেই পুনরায় আন্দোলন শুরু করেছেন। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে তারা বিক্ষোভ করছেন, মানববন্ধনে অংশ নিচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হচ্ছে। পুলিশও কখনও কখনও নির্দয় আচরণ করছেন। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ওপর পুলিশের আঘাতের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন কঠোরতার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বহু অভিভাবক। খোলা রাস্তায় অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য সব পক্ষই কি একটু সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারেন না? ৪ অক্টোবর ২০১৫ [email protected]
×