ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মো. জগলুল কবির

হারিয়ে যেতে নেই মানা

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৫ অক্টোবর ২০১৫

হারিয়ে যেতে নেই মানা

বাতাসের অস্তিত্ব তখনই বোঝা যায় যখন তা আমাদের শরীরে অনুভূত হয়। বড় বা ছোট যে কোন গাছ, যা সবুজে স্বর্গীয়ভাবে বিস্তার করে আছে, তাতে যখন বাতাস দোলা দেয়, তখন পাতাগুলো তার যৌবন প্রকাশে মত্ত হয়ে ওঠে, কখনও উপরে আসে আবার পরক্ষণেই নিচে দোলে। ঝির ঝির বাতাসের দোলায় ছন্দে ছন্দে দোলে, যা দেখলে তনুমন আর চোখ ভরে আসে, আবার একটু বেশি বাতাস এলে তার ছন্দ পাল্টিয়ে এলোমেলো বেশে যৌবনের প্রকাশকে ভিন্ন আবেদনে ছড়িয়ে দেয়। মানুষ যার হৃদয় এই সুন্দরকে অনুভব করতে চায়, সে অবশ্যই সেই স্নিগ্ধ বাতাসের রূপ ও প্রকৃতির গন্ধকে, কি দারুণ মানসিক শান্তিতে নিজের মন, প্রাণ আর হৃদয়ে ভরে নেয়। একেই আমি বলব ‘সুখ’। আবার আরেক বাতাস যা হলো দমকা হাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়, এখন নতুন নতুন নাম দেয়া হয় যেমন সিডর, আইলা, কোমেন এটা সেটা, সেগুলো তখন আর বাতাস থাকে না, তখন তা হয় প্রলয়ঙ্করী ঝড়, বা বাড়িঘর গাছ-পালা সবকে রাক্ষসের মতো নিমিষেই ধ্বংস করে যায়, সেই বাতাসের গন্ধ বা রূপ কোন মানুষের জন্যই সুখের নয়, ধ্বংসের। অর্থাৎ অ-নিয়ন্ত্রিত বাতাস অ-সুখের কারণ। মানুষ বা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেয়। দেখেন তো গানের কলিগুলো কানে ভাসে কি না? ‘ঐ ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় আমার ইচ্ছে করে, আমি মন ভেজাব ঢেউয়ের মেলায় তোমার হাতটি ধরে’... অসাধারণ লাগে এ গান আমার। সাগরপাড়ের ঢেউয়ের সৌন্দর্য, ঢেউয়ের দোলা, সঙ্গে দখিনা হাওয়ার যে রূপে প্রকৃতিকে সুন্দরের রানী বানিয়েছে তা কত না কবি, লেখক, চলচ্চিত্রের রূপকাররা যুগে যুগে স্ব স্ব জায়গা থেকে আমাদের জন্য তাদের সৃষ্টি রেখে গিয়েছে। আর এই প্রকৃতির থেকে নিজেকে সুখের সাগরে ভাসাতে মানুষ চলে যায় ওই সাগরপাড়ে, শহরের কোলাহল আলো বাতাস রেখে কিছু সময়ের জন্য আলাদা করে প্রকৃতির কাছে। ‘আকাশ থেকে ফেলবে ছায়া মেঘের ভেসে যাওয়া, শুনব দুজন কি বলে যায় উদাস দখিন হাওয়া’ এই গানের মর্মবাণী উপলব্ধি করার জন্যই তো প্রিয়তমার হাত ধরে সাগরপাড়ে পা ভিজিয়ে হেঁটে চলা, জীবনের কিছুক্ষণ সময়ে সুখের পরশে নিজেকে দোলা দেয়া। এই তো কিছু আনন্দ কিছু সুখের জন্য আমাদের চেষ্টা। সাগরের ঢেউ এত মধুর কখন হয়? যখন ঢেউগুলো একবার ওপরে উঠে আবার নিচে নামে আবার উপরে উঠে আবার নিচে নামে, তারপর সমুদ্রের পাড়ে আছড়ে পড়ে, আর যখন শুধু দখিনা হাওয়া ঢেউয়ের ওপর পরশ বুলিয়ে দিয়ে সাগরপাড়ে আমাদের ছুয়ে যায়। এই দখিনা হাওয়া যদি, হাওয়া না হয়ে প্রলয়ঙ্ককরী তুফান হয়ে, ঢেউগুলোকে নিচে না নামিয়ে ওপরেই উঠতে উঠতে পাড়ে চলে আসে, এ গান আর বাজে না, তখন তা হয় ধ্বংসযজ্ঞ। অর্থাৎ একবার ওপরে ওঠা ও আবার নিচে নামা এর মাঝেই সুখের অসিত্ব, গানের বাণীর অনুভূতি। অ-নিয়ন্ত্রিত বাতাস বা ঢেউ যা শুধু ওপরে উঠে তাকে বলে ধ্বংসযজ্ঞ। তাই জীবনের ‘সুখ’ উপরে ওঠা, আবার নিচে নামা আবার ওপরে ওঠার মাঝেই আছে। শুধুই ওপরে ওঠা সুখের লক্ষণ না, অ-সুখের লক্ষণ। আবার ঢেউয়ের ওঠানামা না থাকলে তা সমুদ্র হয় না, তা হয় পুকুর বা জলাশয়। তখন তা আর মানুষকে সুখের সাগরে দোলা দিতে পারে না। ‘সুখ’ যার জন্যই আমাদের জীবন সংগ্রাম সেখানেও সুখের সঙ্গে মিলন হবে যদি আমরা এই ওপরে ওঠা ও নিচে নামার ছন্দ, দোলা, মসৃণ সমতলকে পেরিয়ে যেতে পারি, তখনই আমাদের এই ‘সুখ’ অনুভূত হবে। তেমনই কোন মানুষের যদি শুধু ওপরেই ওঠা হয় তাও- অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে, তাতে নিজের ক্ষতি ও অন্যের ধ্বংসের সম্ভাবনা থাকবে। দাবা খেলাকে অনেকে বলে রাজকীয় খেলা। রাজা, মন্ত্রী, সৈন্য সামন্ত কত কি, যা কিনা বর্তমান যুগে আমার কাছে অবৈজ্ঞানিক মনে হয়। রাজা অল্প অল্প হাঁটবে, মন্ত্রীর অনেক দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু বর্তমান যুগে পুরো বিশ্বেই রাজা অর্থাৎ হেড অব দ্য স্টেটই সমস্ত দৌড়ঝাঁপ ও পাওয়ার এক্সারসাইজ করে থাকে। আমাদের সমাজে কিছু কিছু কথা প্রচলন আছে যেমন ‘তেলির মাথায় সবাই তেল দেয়’, নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা’, ‘বেশি বড় হয়ো না বাতাসে ভাঙতে পারে, বেশি ছোট হয়ো না ছাগলে খেয়ে ফেলবে’। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কথাগুলো জীবনের পরতে পরতে চলার পথে অনুভূত হয় বা আমরা এর পরম সত্যতা খুঁজে পাই। তা হলে কিভাবে এগুলো সমাজে প্রচলিত হলো? যিনি বা যারা এ কথাগুলো বলেছেন, তাহলো জীবন থেকে শিখে বলা বা লেখা, যা অবশ্যই সবচেয়ে সত্য উপলব্ধিতে আসতে হবে। জীবনের কথাগুলো ভুল হয় না, হবে না। বরং শত শত বছর মানুষকে পথ চলতে সাহায্য করবে। দাবা খেলা তো আন্তর্জাতিক স্বীকৃত খেলা, যা কম্পিউটার নিজেও খেলে, অবশ্যই কোন না কোন হাইটেকনিক বা কারিশমা আছে। কিন্তু লুডু খেলা আমাদের দেশীয় খেলা। কে, কখন কেন শুরু করল আমার জানা নাই, বাচ্চা বয়সে সবাই হয়ত ২/৪ বার খেলেছে। কোন সিরিয়াস কিছুই চিন্তায় আসে না। কিন্তু কোন সৃষ্টিই অহেতুক হয় না। সৃষ্টির পেছনে জীবনের ছোঁয়া, চিন্তাশক্তি ও মেধা খাটাতে হয়। লুডু খেলার একটা অংশ ভিন্ন, সাপ লুডু। আমার মনে হয় এই খেলা যে বানিয়েছে সে একজন বড়মাপের দার্শনিক ছিল জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চিন্তাশক্তি দিয়ে দেখেছে, জীবনের উত্থান-পতনকে অবলোকন করে খেলার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। হয়ত নাম যশ সেভাবে ছড়ায়নি। কোন গ্রামের গহীনে বসবাস ছিল বা শহুরেও হতে পারে বৈকি। এখানে খেলতে খেলতে আপনি মই পাবেন ৬টি, আর সাপ পাবেন ৮টি। মইয়ের সংখ্যা কম ও মাপেও ছোট, সাপের সংখ্যা বেশি ও লম্বায়ও অনেক বড়। আপনি গুটি চালতে থাকবেন, যদি মইয়ের মাথায় পড়েন উপরে উঠবেন, আবার সাপের মুখে পড়লে ফুটুস করে নিচে পড়ে যাবেন। খেলার শ্রষ্টা একটা সাপের মুখ রেখেছেন ৯৭ সংখ্যায়, এখানে পড়লে একদম নিচে ১২ তে নেমে যেতে হয়। তাছাড়া ছোট মই দিয়ে উপরে উঠা ও ছোট ছোট সাপের মুখ পার হয়ে যেতে হবে। মানুষের জীবনের চলার সঙ্গে কি কোন মিল খুঁজে পান? অবশ্যই। ওই যে বিখ্যাত গীতিকার লিখেছেন, ‘আমি তো দেখেছি কত যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়, শুকনো পাতার মর্মর মর্মর বাজে কত সুর বেদনায়, আকাশে বাতাসে নিষ্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয়, দুঃখের দহনে করুন রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়।’ অত্যন্ত জনপ্রিয় গান। কেন? দুঃখ প্রিয় কেন? কারণ অনেক জনগণের জীবনের এটাই গল্প তাই তাদেরও প্রিয়। কিভাবে দুই জগতের দুই ভিন্ন ভিন্ন দিকের একজন দেশীয় খেলা ও অন্যজন গানের স্রষ্টা একই সমীকরণে মিশলেন? কারণ এটাই জীবনের গল্প, যার সকল সমীকরণই এক। আমাদের জীবন চলার পথটা ঠিক এমনই, বার বার সংগ্রাম করতে হয়, কখনও লিফট পেয়ে উপরে উঠে যাওয়া, আবার কখনও সাপের মুখে পড়ে নিচে পড়ে যাওয়া, এর মাঝেই আমাদের ‘সুখ’ নিহিত, কখনই হতাশ হওয়া যাবে না। ওই ৯৭ সংখ্যার জীবন চলার পথের বাধা পার হতে হলে অবশ্যই বিশ্বব্রহ্মা- স্রষ্টার বিশেষ রহমত লাগবে। তা না হলে অনেক নিচে পড়ে যেতে হবে। ওই রহমতই হলো মানুষের আল্টিমেট সফলতা ও ওই নিরঙ্কুশ ‘সুখের’ ভেলায় চড়া। তাই জীবনের সকল ছোট ছোট প্রাপ্তির মাঝেই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়, বুঝতে হবে এটাই জীবনের ‘সুখের’ একটি অধ্যায়। যে ছোট ছোট প্রাপ্তিকে উপভোগ না করবে সে কিভাবে সুখী হবে? আসলে আকাশ বলতে তো সত্যি কিছু নেই, আছে শুধু বায়ুম-ল। মেঘ না থাকলে আমরা এটাকে নীল রং অনুভব করি। এই যে নীল আকাশ কল্পনায় নিয়ে মানুষ সুখী হয়, কল্পনাতে গান হয়, কবিতা হয়, আমরা সেই গান শুনে কবিতা পড়ে আনন্দ অনুভব করি, ‘সুখ’ পাই। তেমনই সত্যিকারের ‘সুখ’ বলতে কিছু নেই, সুখের পরে দুঃখ থাকবেই অথবা দুঃখের পরেও ‘সুখ’ থাকবেই। তাই জীবনের প্রাপ্তি বা উপরে ওঠার সময় বিনয়ের সঙ্গে থাকা এবং বিপদের সময় বা নিচে নামার সময় ধৈর্যের সঙ্গে সব নেগেটিভগুলোকে পজিটিভ্লি দেখাই হলো সত্যিকারের ‘সুখ’। মোবাইল নং-০১৭১০৯২৪৬০৩ ধানম-ি, ঢাকা।
×