ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাড়তি কোটায় যাওয়াদের দুর্ভোগ চরমে

অমানবিক কষ্টে ইবাদত বন্দেগী থেকে বঞ্চিত অনেক হাজী

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

অমানবিক কষ্টে ইবাদত বন্দেগী থেকে বঞ্চিত অনেক হাজী

বাবুল হোসেন, মক্কা থেকে ॥ ‘হোটেল ও বাসা বাড়ি থেকে কাবা শরীফ দেখা যাবে। পাঁচ মিনিট হেঁটে হারামের ভেতর জামাতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও আদায় করা যাবে বাসা ও হোটেল থেকে’- এমন প্রলোভন দেখিয়ে নাটোরের সিংড়া উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ ধর্মপ্রাণ গৃহবধূ খাদিজা বেগমকে হজের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন একই এলাকার দালাল আব্দুল আজিজ ও আব্দুল হান্নান। হজে নেয়ার চুক্তি করে নগদ দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকা নিয়ে খাদিজাকে তুলে দেন ইকো এভিয়েশন এ্যান্ড ট্যুরিজমের মালিক হাজী রুহুল কুদ্দুসের কাছে। বলা হয় মাত্র আধা কিলোমিটারের রাস্তা। নিয়মমাফিক অনলাইনে আবেদন না করায় শেষ পর্যন্ত বিশেষ বিবেচনায় সরকারের বাড়তি কোঠায় সৌদি আরবে আসতে হয়েছে খাদিজাকে। হারাম শরীফ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের তাকওয়া জেলার দোরখোদাই এলাকার সমতল থেকে অন্তত ৫০ ফুট উঁচু পাহাড়ি টিলার ওপর বহুতল ভবনে হজের একদিন আগে ঠাঁই মেলে খাদিজার। এর পর থেকে দেখা নেই হজ এজেন্সির কারও। রুহুল কুদ্দুস ও আব্দুল আজিজদের কেউই ফোন ধরেনি। হোটেলের অন্তত দুই কিলোমিটারের আশপাশে খাবারের কোন রেস্তরাঁ নেই। নেই পানীয় জলের কোন ব্যবস্থাও। বাংলাদেশ থেকে সঙ্গে নিয়ে আসা শুকনো খাবার যা কিছু ছিল এরই মধ্যে সবই শেষ! তবে এজেন্সির দেয়া গাড়িতে করে মিনা থেকে আরাফাতের ময়দান ও মুজদালিফা হয়ে মিনায় গেলেও পরে হেঁটে মিনা থেকে মক্কার আবাসিক হোটেলে আসতে হয়েছে খাদিজার কাফেলাকে। দীর্ঘ পথ সফরসহ প্রয়োজনীয় খাবার ও পানিশূন্যতার কারণে বিছানায় পড়ে যান তিনি। গত ১৯ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাদিজার পেটে একদানা ভাত পড়েনি। খবর পেয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে ওই বাসার হাজীদের ৩ বেলা খাবার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শেষ সময়ে এসে সরকারের বাড়তি কোঠায় হজ পালন করতে আসা খাদিজা বেগম জানান, এর চেয়ে আসতে না পারলে আরও খুশি হতেন। কারণ এমন অমানবিক কষ্টে হজের প্রকৃত ইবাদত বন্দেগী থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। উদ্বেগ আর আতঙ্কে দিন কাটায় হজের কাজে মনোযোগ দিতে পারেননি। তিনি এমন প্রতারণার অভিযোগ তুলে দায়ী হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। যাতে করে ভবিষ্যতে কোন হজ এজেন্সি কারও সঙ্গে এমন আচরণ করতে সাহস না পায়। ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, সরকার হজ এজেন্সির গাফিলতি ও প্রতারণার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় না দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। এসব বিষয় তদারকি করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত কমিটি কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী হাজীদের সুষ্ঠুভাবে হজ পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাকওয়ার পাহাড়ের টিলায় একই বাড়িতে থাকছেন রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলার রহিমা খাতুন, নাটোরের সিংড়া উপজেলার গোলাম রসুল ও গুরুদাসপুর থানার আবু জাহিদসহ অন্তত ১৭ হাজী। এদের মধ্যে ৮ নারী হাজী রয়েছেন। নাটোরের গুরুদাসপুরের হাজী চান মোহাম্মদ অভিযোগ করেন, এ পর্যন্ত তাকে মাত্র ৪ বেলা খাবার দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার কোন খাবার পাননি তিনি। অথচ হজে আসার আগে এজেন্সি থেকে বলা হয়, হারাম থেকে ৬০০-৮০০ মিটারের মধ্যে বাসায় রাখা হবে, দেয়া হবে ৩ বেলা খাবার। রহিমার কাহিনী অন্যরকম। হজ এজেন্সি তাকওয়া জেলার ১১ নম্বর বাড়ির অপরিচিতজনদের সঙ্গে রহিমাকে রেখে সটকে পড়ে। হান্নানকে টাকা দিয়েছিলেন তিনি। হান্নানও কোন খোঁজ নেয়নি রহিমার। সঙ্গে কোন সৌদির সিমকার্ড না থাকায় ৮ দিন তিনি পরিবার ও স্বজনসহ হজ এজেন্সির কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী এক হাজীর সহায়তায় সিমকার্ড পেয়ে পরিবার স্বজন ও হজ এজেন্সির সঙ্গে যোগাযাগ করতে সক্ষম হন। এরপর রহিমার জায়গা হয় পাহাড়ি টিলার ওপর ১৩ নম্বর বাড়িতে। ছোট্ট পরিসর কক্ষের ভেতর গাদাগাদি ও দম বন্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে হাজীদের। একবার এ রকম বাসা বাড়ি ও হোটেল থেকে সমতলে নামলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না কারও। আর হারাম শরীফের ভেতর এখান থেকে জামাতে গিয়ে নামাজ আদায় করা তো দুঃস্বপ্ন। মিসফালার বাইরে তাকওয়া জেলার ১৩ নম্বর বাড়ির এসব হাজী হজ এজেন্সির প্রতারণার শিকার। এখনও তাদের মানবেতর দিন কাটছে। বাড়তি কোঠায় আনা হাজীদের এ রকম পাহাড়ের টিলার ওপর ১১, ১৪ ও ১৭ নম্বর বাড়িসহ আরও কয়েকটি বাড়িতে রাখা হয়েছে। ঘটনা জেনে ধর্মমন্ত্রীর নির্দেশে সোমবার বাংলাদেশ হজ মিশন থেকে এসব বাড়ি ঘুরে দেখেছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শহীদুজ্জামানসহ কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিব শহীদুজ্জামান জানান, বেশ দূরের ও পাহাড়ের টিলার ওপর এমন বাসা বাড়ি থেকে হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন ও হারামে জামাতে নামাজ আদায় করা বেশ কষ্টসাধ্য। এটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে জানান তিনি। হজ এজেন্সিগুলোর এমন আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ হাব নেতৃবৃন্দও। বাংলাদেশ থেকে সরকারের বাড়তি কোঠায় সৌদি আরবে হজ করতে এসে চরম বিপাকে পড়েছেন এ রকম প্রায় পাঁচ হাজার হাজী। হারাম শরীফ থেকে দূরের পাহাড়ের টিলায় রাখা এসব হাজী অমানবিক দিন যাপন করছেন। হোটেল ও বাসা বাড়ির আশপাশে খাবারের কোন রেস্তরাঁ না থাকায় খাবার ও পানীয় জলের সঙ্কটে পড়েছেন এসব হাজী। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে এসব হাজীর ৩ বেলা খাবার ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দায়ী হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে জরুরী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রবিবার মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনে এক জরুরী সভা ডেকে ধর্মমন্ত্রী হাব নেতৃবৃন্দের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রী ঘটনা তদন্তে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শহীদুজ্জামানকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এই হিসাবে মঙ্গলবার মন্ত্রীর কাছে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা রয়েছে। ধর্মমন্ত্রী মক্কায় জনকণ্ঠকে জানান, তদন্তে প্রতারণার অভিযোগ পেলে দায়ী হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হজ ও ওমরা নীতিমালা ২০১৪ অনুযায়ী প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ দ-ে হজ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল, জামানত বাজেয়াপ্ত ও জরিমাণার বিধান রয়েছে নীতিমালায়। মন্ত্রী জানান, যেসব প্রভাবশালী নেতা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে হজ মৌসুমে বাড়তি সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ‘লাব্বায়েক ট্রাভেলস’ এর মালিক জামাল উদ্দীনের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ রয়েছে। হাবের সাবেক সহ-সভাপতি আফতাব উদ্দিন চৌধুরী সোমবার মক্কায় হজ মিশনে ধর্মমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী হজ এজেন্সির মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। মন্ত্রণালয় ও হজ অফিসের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে এসব অসাধু হাব নেতাদের দহরম মহরম সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হজের আগে একই বিমানে এসব হাব নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে জেদ্দা হয়ে মক্কায় পৌঁছান। ধর্মমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হজ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কমিটিতে হাবের সভাপতি ইব্রাহিম বাহার, সিনিয়র সহ-সভাপিত মোঃ হেলাল উদ্দীন ও সহ-সভাপতি সৈয়দ আহমদ মজুমদার কমিটির অন্যতম সদস্য। অথচ তারা মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত থাকেননি। হাবের সাবেক ও বর্তমান প্রভাবশালী কয়েক সদস্য সরকারের বাড়তি কোঠায় আনা হাজীদের নিয়ে বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ধর্মমন্ত্রী মক্কা থেকে মঙ্গলবার মদিনায় যাওয়ার আগে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ধর্মমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন হাবের সাবেক নেতৃবৃন্দ। ধর্মমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা সরেজমিন কোন হাজীর সঙ্গে কথা বলেননি বলে জানা গেছে। তারা গাড়িতে চেপে পাহাড়ি টিলায় থাকা বাড়ির নম্বর সংগ্রহ করেছেন। এখন দায়ী হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে মনগড়া রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। এদিকে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় হজে আসা হাজী সুমন অভিযোগ করেছেন তাদের নিম্নমানের দূরের আবাসিক বাসায় রাখা হয়েছে। বাসায় হজ এজেন্সির পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করার কথা বলা হলেও পরে সেটি করা হয়নি। এছাড়া সরকারী জিওর মাধ্যমে আসা ২৬৭ হাজীকে যেসব বাসা ও হোটেলে রাখা হয়েছে সেখানেও নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। এসব হাজীর জন্য কোন হজ গাইড না থাকায় মক্কা, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় পথ হারিয়ে দুর্ভোগের শিকার হন অনেক হাজী। প্রতিটি হোটেলকে মোটা অঙ্কের টাকায় ওয়াইফাই সুবিধা করে দিলেও কোন হাজী এর সুফল পাননি। রাষ্ট্রের টাকা শ্রাদ্ধ করে কার স্বার্থে হোটেলগুলোতে এই ওয়াইফাই করা হয়েছে-এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বিষয়টি ভুক্তভোগী হাজীদের পক্ষ থেকে ধর্মমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে।
×