ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম. হাসিবুল আলম প্রধান

সুশাসন পাল্টে দিতে পারে কোন দেশের সামগ্রিক চিত্র

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সুশাসন পাল্টে দিতে পারে কোন দেশের সামগ্রিক চিত্র

২৮ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। এবারও বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়েছে। দুর্নীতি বন্ধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্য অধিকার আইন যেন শক্ত ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্য জনগণকে এই আইন সম্পর্কে সচেতন করতে আন্তর্জাতিকভাবে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। আমাদের দেশেও কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়েছে। তথ্য দেবো, তথ্য নেবো, দেশ গড়ায় অংশ নেবো’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে এ বছর বৃহত্তর আঙ্গিকে দেশে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশ তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পার্শ¦বর্তী রাষ্ট্র ভারতে এই আইনের ব্যাপক সফলতা জনগণকে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক উৎসাহিত করেছে। আমাদের দেশে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ নামে একটি আইন থাকলেও সচেতনতা ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার অভাবে মানুষ আইনটি দুর্নীতি বন্ধে একটি ফলপ্রসূ অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেত পারছে না। কিছু সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাও তাদের জবাবদিহিতা জনগণের কাছে যাতে নিশ্চিত না হয়, সেজন্য আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে নানা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগ উঠেছে। গত বছরের ১৬ নবেম্বর থেকে ১৯ নবেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ে টএঈ ঝঢ়ড়হংড়ৎবফ একটি জাতীয় সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে জরমযঃ ঃড় ওহভড়ৎসধঃরড়হ অপঃ রহ ইধহমষধফবংয : অ ঈৎরঃরপধষ অঢ়ঢ়ৎধরংধষ রহ ঃযব খরমযঃ ড়ভ ঃযব জবধষরঃু এই শিরোনামে আমি একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। আবার এ বছর ২৮ ও ২৯ আগস্ট দুই দিনব্যাপী ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য অধিকার আইনের উপর একটি জাতীয় সেমিনারে যোগ দেই। সেখানে ওসঢ়ষবসবহঃধঃরড়হ ড়ভ জরমযঃ ঃড় ওহভড়ৎসধঃরড়হ অপঃ রহ ইধহমষধফবংয : ঈযধষষবহমবং ধহফ চৎড়ংঢ়বপঃং- শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। বাংলাদেশের তথ্য অধিকার আইনের প্রায়োগিকতার উপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ করে ভারতের জনগণের ব্যাপক আগ্রহও রয়েছে। প্রবন্ধ দুটি লিখতে গিয়ে আমার কাছেও মনে হয়েছিল, ভারতে যে ব্যাপকহারে তথ্য পাবার আবেদন ও তথ্য না দেয়ায় যে হারে তথ্য কমিশনে অভিযোগ আসছে, সেই তুলনায় আমাদের দেশে এটা অনেক গুণে কম। শুধু তাই নয়, এই প্রবন্ধ দুটি উপস্থাপন করতে গিয়ে দেখলাম, আইনটি প্রণয়ন করার পর জনমনে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা দিয়েছিল তাতে যেন কিছুটা ভাটা পড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তথ্য চাইতে জনগণকে ভোগান্তিও পোহাতে হচ্ছে। আবার আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং কিছু সরকারী ও বেসরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না, এমন কি আইন অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদে ৩৯-এ স্পষ্টভাবে মতপ্রকাশের অধিকার এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে দুর্নীতি নির্মূল করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের উদ্যোগে ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ নামে একটি আইন মহান জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। এটি ছিল একটি কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকার দুর্নীতি দমনে অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেই এরকম একটি জনস্বার্থমূলক সাহসী আইন প্রণয়ন করেছিল। তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ আইনের আওতায় দেশের প্রতিটি জনগণ সকল সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পেতে পারে। এটি তার আইন স্বীকৃত নাগরিক অধিকার। দুর্নীতি বন্ধ করতে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে এই আইনী অধিকার দেয়া হয়েছে। এই আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হলে সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, সেজন্য এই আইনটি প্রণীত হলো। তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং তথ্যের অধিকার খর্ব করার অভিযোগ শুনানির জন্য আমাদের দেশে এই আইনের অধীনে ইতোমধ্যে একটি তথ্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। আইনটি প্রণয়নের পর তথ্যের অধিকার লাভের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে তথ্য লাভ করতে গিয়ে জটিলতা, আইনের দুর্বলতা, জনকাঠামোর অভাব এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনাগ্রহের কারণে এই আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে একটি বিষয়ে সকলে একমত, আইনটির কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন এনে আইনটিকে গতিশীল করলে এবং তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতি চালু করলে এই আইনের মাধ্যমে জনগণ দারুণ উপকৃত হতো এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তারা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারত। তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী ‘তথ্য’ অর্থে কোন কর্তৃপক্ষের গঠন, কাঠামো ও দাফতরিক কর্মকা- সংক্রান্ত যে কোন স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগবহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনাপত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অঙ্কিত চিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যে কোন ইনস্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য যে কোন তথ্যবহ বস্তু বা উহাদের প্রতিলিপিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আইনে তথ্যের সংজ্ঞায় অনেক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেগুলো জনগণ পেলে দুর্নীতি অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব। এই আইনে কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞাটিও অত্যন্ত বিস্তৃত যার দ্বারা সকল সাংবিধানিক সংস্থা থেকে শুরু করে সরকারের কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা কার্যালয়সহ দেশের সরকারী, বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে কর্তৃপক্ষের আওতায় এনে তথ্য প্রদানের জন্য দায়বদ্ধ করা হয়েছে। আইনের ধারা ৮ (১) অনুসারে কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন তথ্য প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট তথ্য চেয়ে লিখিতভাবে বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম বা ই-মেইলে অনুরোধ করতে পারিবেন, এ ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত আবেদনপত্রের ফরমেটটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এই আইনে তথ্য প্রদানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধারা ৮-এর উপ-ধারা (১) এর অধীন অনুরোধ প্রাপ্তির তারিখ হতে অনধিক ২০ (বিশ) কার্য দিবসের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করবেন, অনুরোধকৃত তথ্যের সঙ্গে একাধিক তথ্য প্রদান ইউনিট বা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অনধিক ৩০ (ত্রিশ) কার্য দিবসের মধ্যে উক্ত অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করতে হবে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোন কারণে তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অপারগতার কারণ উল্লেখ করে আবেদন প্রাপ্তির ১০ (দশ) কার্য দিবসের মধ্যে তিনি এটা অনুরোধকারীকে অবহিত করবেন। এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ধারা ৮ এর উপ-ধারা (১)-এর অধীন অনুরোধকৃত তথ্য কোন ব্যক্তির জীবন-মৃত্যু, গ্রেফতার এবং কারাগার হতে মুক্তি সম্পর্কিত হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনুরোধ প্রাপ্তির ২৪ (চব্বিশ) ঘণ্টার মধ্যে উক্ত বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করবেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য না পেলে বা কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে কোন ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী আপীল কর্তৃপক্ষের কাছে আপীল করতে পারবেন। ধারা ২৪-এর অধীন প্রদত্ত আপীলের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে ও ধারা ২৪-এ উল্লেখিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য প্রাপ্তি বা ক্ষেত্রমত, তথ্য প্রদান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রাপ্ত না হলে ধারা ২৫ (১) অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এই ধারার অধীন প্রদত্ত তথ্য কমিশনের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক হবে, এই আইনের আর একটি অন্যতম অনুচ্ছেদ হলো ধারা ৩২ যেটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ও সিভিল সোসাইটি কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছে এবং আইনটির বিশেষ ত্রুটি হিসেবে গণ্য হয়েছে। ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, তফসিলে উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কার্যে নিয়োজিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য হবে না। যদিও ৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে, উপ-ধারা (১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন, উক্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কোন তথ্য দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে উক্ত ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না। এই সংস্থাগুলো হলো, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স (ডিজিএফআই)। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ইউনিটসমূহ, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), বাংলাদেশ পুলিশ, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা সেল, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ এবং র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর গোয়েন্দা সেল। অনেকেই মনে করেন, এই ধারার মাধ্যমে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এক ধরনের দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে এবং জনগণ দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও এদের কাছ থেকে তথ্য পেতে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত। আইনের উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও তথ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ আইনটি একটি যুগোপযোগী আইন এবং তথ্য কমিশন আইনটির ফলপ্রসূ প্রয়োগ ও জনগণের তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে একটি সর্বোচ্চ সংস্থা। তথ্য কমিশন তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে নিঃসন্দেহে কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু এর কর্ম তৎপরতা আরও ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্য অধিকার আইনের তেমন কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না, ওয়েব সাইটগুলোতে নেই কোন তথ্য অধিকার সংক্রান্ত তথ্য। আমি ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ও গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি যে, একটি নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে একজন ছাত্র তার মূল্যায়নকৃত পরীক্ষার খাতা পর্যন্ত দেখতে পারে। ঈবহঃৎধষ ইড়ধৎফ ঙভ ঝবপ. ঊফঁপধঃরড়হ ্ ... াং অফরঃুধ ইধহফড়ঢ়ধফযুধু ্ ঙৎং মামলায় ২০১১ সালের ৯ আগস্ট ভারতের সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক রায়ের পর ভারতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়নকৃত পরীক্ষার খাতার সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করে দেখার অধিকার পরীক্ষার্থীদের আইন স্বীকৃত অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঐ রায়ে বলা হয়, সিবিএসই (সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন) বা কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন কর্তৃক অনুষ্ঠিত যে কোন পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর মূল্যায়নকৃত খাতা তথ্য অধিকার আইনের তথ্যের সংজ্ঞায় পড়বে এবং পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ বাধ্য তা পরীক্ষার্থীকে দেখার সুযোগ দিতে। শুধু তাই নয়, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি তাদের ওয়েবসাইটে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তথ্য অধিকারসংক্রান্ত সব তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি দফতর ও বিভাগের জন্য রয়েছে একজন করে তথ্য কর্মকর্তা। এছাড়া রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য সেল। এই সেলের কাছে কেউ তথ্যের জন্য আবেদন করলে সেল সেই দফতর বা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তা সরবাহ করবে। শুধু তাই নয়, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হচ্ছে এ সংক্রান্ত ফার্স্ট আপিলেট অথরিটি। দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টি সরকারের একক কোন বিষয় নয়, এ ক্ষেত্রে জনগণের এগিয়ে আসার বিষয়টিও অতি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে আমরা জনগণও অনেকটা মানসিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, আমরা কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করি না বরং খুব সহজে এবং কম সময়ে একটি কাজ আদায় করার জন্য কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করি। আমাদের দেশে প্রতিবাদ না করার যে সংস্কৃতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অবশ্যই আতঙ্কিত হবার মতো। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে দুর্নীতি বন্ধে তথ্য অধিকার আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, হতে পারে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। তথ্য অধিকার আইনের কার্যকর প্রয়োগই সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাল্টে দিতে পারে একটি দেশের সামগ্রিক চিত্র। জনগণের তথ্য পাবার পথকে আরও সুগম করতে তথ্য অধিকার আইনকে আরও জনগণের সঙ্গতিপূর্ণ এবং তথ্য কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হলো- আইনটি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীরও অনেকেই এই আইনটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যেখানে এখনও তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না, সেখানে তা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তথ্য কমিশনকে নিতে হবে। জনগণ যেন সহজে তথ্য পেতে পারে সেজন্য দেশের প্রত্যেকটি অফিসে তথ্য প্রদানের জন্য একটি যবষঢ় ফবংশ গঠন করতে হবে। তথ্য প্রদানে উৎসাহিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা তথ্য প্রদানে সক্রিয় ও সাহসী, সেসব কর্মকর্তাকে বিশেষ পুরস্কার প্রদান করার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু তাই নয়, কমিশনের ওয়েব সাইটটিকে আরও শক্তিশালী এবং আপটুডেট করতে হবে। বর্তমান সরকার দুর্নীতি রোধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই মূলত তথ্য অধিকার আইনের মতো একটি জনকল্যাণমূলক আইন প্রণয়ন করেছে। তাই এই আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্য সরকারকে তথ্য কমিশনকে আরও বেশি বেশি সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা ও আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের অগ্রদূত তাঁর কাছে অনুরোধ- ‘আপনার হাতে প্রণীত তথ্য অধিকার আইনের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করে আমাদের জনগণের প্রত্যাশিত সুশাসন উপহার দিন।’ লেখক : প্রফেসর, আইন বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×