ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চোখের জল

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

চোখের জল

কালে কালে ঈদ আনন্দে যোগ হয়েছে নানা অনুষঙ্গ। ঈদের খুশিকে শতগুণ বাড়িয়ে নিতে তৎপর মানুষ। এতে দোষের কিছু নেই। বছরে দু’দিনই তো ঈদ। তাই ঈদ পরিপূর্ণরূপে উপভোগের জন্য মানুষের কতই না পরিকল্পনা। তবে প্রশ্ন জাগেÑ ঈদ কি কেবল ভোগের-উপভোগের? ত্যাগে ও অন্যকে আনন্দ দানের মহত্ত্বে¡র মধ্যে কি ঈদের মহিমা নিহিত নয়? আমরা ঈদে অপরকে আনন্দ দেয়ার সুবিবেচনাবোধটুকু শিশুদের কাছে আশা করি না। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে সমাজের কিছু দাবি থাকে। ঈদের মূল বাণীটুকু তারা অন্তরে ধারণ করুক; একা নয়, সকলে মিলে ঈদের খুশিতে মিলিত হোক এমন চাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবু ঈদের দিন চোখের জলে ভাসে বহু মানুষ। হাসপাতালে নিদারুণ দুঃখকষ্টে পীড়িত অবস্থায় ঈদের দিনটি কাটে বহু মানুষের। অনেক সময় অনেকে পায় না নিকটজনদের দেখা। আবার অনেকের আপনজন বলেও কিছু থাকে না জগত সংসারে। একেকটি ঈদ তাদের কাছে আসে দীর্ঘ-দীর্ঘশ্বাস ও চোখের জলের ধারায়। আর যাদের রয়েছে স্বজন, রয়েছে নিজের সচ্ছল সন্তান তাদের ঈদ যদি কাটে নিঃসঙ্গ অবস্থায়, বৃদ্ধাশ্রমে তাহলে কবির ভাষা ধার করে বলতেই হয়- এ বড় দুর্দিন, এ বড় অসময়! আমরা পেরিয়ে এলাম কোরবানি ঈদের দিনটি। যারা পশু কোরবানি দিতে সমর্থ হয়েছেন তাদের জন্য ঈদটি ছিল তৃপ্তিকর। গরিব-দুখীদের মাঝে কোরবানির মাংস বণ্টনে নিশ্চয়ই এক ধরনের স্বস্তি রয়েছে। হৃদয়ের অন্তস্তলে শান্তির পরশ এসে লাগে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে। এটি কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে। মানুষ দিনে দিনে আরও শিক্ষিত ও আধুনিক হচ্ছে, অথচ কারও কারও ভেতর থেকে খসে পড়ছে মানবতা, বিলুপ্ত হচ্ছে পরম মূল্যবোধ। এই সমাজে এমন আত্মকেন্দ্রিক মানুষও আছে যারা জন্মদাতা পিতা কিংবা জন্মদাত্রী মাতাকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। তাই শিল্পীর কণ্ঠে সমাজের এই ক্ষতটির স্বরূপ উঠে এসেছে এভাবেÑ ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আবার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!’ স্বজনদের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর চোখের জলে এবারও নিঃসঙ্গ অবস্থায় পবিত্র ঈদ-উল-আযহার দিন কাটল গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের। ঈদে তারা পেয়েছেন নতুন কাপড় আর ভাল খাবার। কিন্তু পাননি আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয় মানুষদের দেখা। এ রীতিমতো মর্মস্পর্শী ঘটনা! মানুষ মানুষের জন্য। সমাজের বয়স্কজনদের ভরণপোষণ ও সেবাশুশ্রƒষার দায়িত্ব তাদের সন্তানদের। সন্তানরা সেই দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ালে তাদের সুপথে আনার দায়িত্ব নিকটাত্মীয় কিংবা পরিচিতজনদের ওপরই বর্তায়। রাষ্ট্র ও সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে সমাজের শিক্ষিত বিবেকবান সংস্কৃতিবান অংশের দায়িত্ব অনেক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের শিখা জ্বালিয়ে রাখা চাই। বেঁচে থাকলে প্রতিটি শিশুরই জীবনে আসবে বৃদ্ধকাল। বয়স্কদের জন্য আজকের তরুণ সমাজ যদি শ্রদ্ধা ও মমতাবোধকে জাগ্রত না রাখে তাহলে তাদের বৃদ্ধকালে উত্তরসূরিদের কাছ থেকে সে কীভাবে উত্তম কিছু প্রত্যাশা করবে? আমরা চাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাস। কিন্তু যেসব বৃদ্ধজনের সন্তানরা জীবিত নেই, কিংবা যারা সহায়-সম্বলহীন, তাদের জীবনের শেষ কটা দিন হাসি আর আনন্দে ভরিয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। আগামী কোন ঈদে একটি মানুষও যেন না ভাসে আর চোখের জলে।
×