ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিনায় শোকের পাহাড় ॥ পাথর নিক্ষেপের সময় পদপিষ্ট হয়ে ৭৬৯ হাজীর মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

 মিনায় শোকের পাহাড় ॥ পাথর নিক্ষেপের সময় পদপিষ্ট হয়ে ৭৬৯ হাজীর মৃত্যু

বাবুল হোসেন, মক্কা থেকে ॥ হজ পালনকালে সৌদি আরবের মিনায় গত বৃহস্পতিবার পদদলিত হয়ে রবিবার সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মতে ৯ বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের ৭৬৯ হাজীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৯৪৩ জন। রবিবার সৌদি সরকার হতাহতের এই হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। তবে আরও বাংলাদেশী হাজী মারা গেছেন কিনা সে সংক্রান্ত সঠিক তথ্য সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনও মক্কায় বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তারা পাননি। স্বজনদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা নিখোঁজদের সন্ধান নিচ্ছেন। সৌদি সরকার রবিবার ৬৫০ হাজীর ছবিসহ নাম পরিচয় প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ বাংলাদেশী হাজীকে শনাক্ত করেছে। ৩২৩ ইরানী হাজী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মিনায় শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপের সময় হুড়োহুড়ি বাধলে এই সহিংস ঘটনা ঘটে। এতে ৯৮ বাংলাদেশীসহ আহত হন ৯৪৩। মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য জায়গায় নেমে আসে শোকের ছায়া। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। গত ২৫ বছরের মধ্যে হজ পালনকালে এত বড় দুর্ঘটনা আর ঘটেনি। রবিবার ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা (২ পৃষ্ঠা ১ কঃ দেখুন) মিনায় শোকের (প্রথম পৃষ্ঠার পর) আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী বলেছেন, বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনায় সৌদি প্রশাসনের ক্ষমা চাওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, সৌদি প্রশাসন এ ঘটনা নিয়ে স্রেফ দোষারোপের খেলায় মেতেছে। ইরান মিনার ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের পর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী এই দাবি জানালেন। এ ঘটনায় এক হাজারের বেশি হাজী মারা গেছেন বলে দাবি ইরানের। তিনি বলেন, এই ঘটনাটি ভুলে যাওয়া যাবে না এবং গুরুত্ব¡ দিয়ে এ ব্যাপারে লেগে থাকা উচিত। সৌদিদের দায় স্বীকার করে হতাহতদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। শনিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন বৈঠকে বক্তব্যদানকালে ইরানী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও মিনা ট্র্যাজেডির জন্য সৌদি প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেন। জাতিসংঘে ইরানী প্রেসিডেন্টর এ ধরনের বক্তব্যের পর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের বলেন, এই ধরনের ঘটনা নিয়ে ইরান বরাবরই রাজনীতি করে আসছে। জাতিসংঘে দেয়া এক ভাষণে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি জাতিসংঘের মাধ্যমে ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন। তদন্তের দাবিতে ইন্দোনেশিয়া ও নাইজারও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মিনায় পদদলনের ঘটনার জন্য অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে ইরানের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে তদন্তের দাবি তোলার পর হুড়োহুড়ির ওই ঘটনার জন্য একদল ইরানী হজযাত্রীকে দায়ী করে প্রতিবেদন এসেছে সৌদি গণমাধ্যমে। দৈনিক আশরাক আল আসওয়াতের বরাত দিয়ে সৌদি গেজেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৩০০ ইরানীর একটি দল ‘নির্দেশনা না মেনে’ ভুল সড়কে গেলে অতিরিক্ত চাপে পদদলনের এই ঘটনা ঘটে। ইরানী হজযাত্রীদের তত্ত্বাবধানে থাকা এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আরব নিউজের রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় তিন শ’ ইরানীর ওই দলটি নিয়ম অনুযায়ী মুজদালিফা থেকে নিজেদের ক্যাম্পে না ফিরে সরাসরি জামারাতের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর তারা আবার উল্টো পথে ২০৪ নম্বর সড়ক ধরে এগোলে এ ঘটনা ঘটে। অপরদিকে এক প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ভিড় নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাই ছিল না মিনায়। তাঁদের অভিযোগ, হজযাত্রীদের ক্যাম্পে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে মাত্র একটি পথই খোলা ছিল। ফলে ওই রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ে। বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আরব দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর। ওই প্রতিবেদনের দাবি, বৃহস্পতিবার মিনায় গিয়েছিলেন সৌদি বাদশাহর ছেলে মহম্মদ বিন সালমান। অভিযোগ, শাহজাদার নিরাপত্তা কড়াকড়ির ফলে হজযাত্রীদের যাতায়াতের পথ বদল করা হয়। তড়িঘড়ি পরিবর্তনের জেরেই ঘটে দুর্ঘটনা। তবে এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে সৌদি প্রশাসন। ইরানের পর নিহতদের মধ্যে মরক্কোর হাজীর সংখ্যা ৮৭, ক্যামেরুনের ২০, নাইজারের ১৯, মিসরের ৩৭, ভারত ও পাকিস্তানের ১৮, শাদের ১১ জনসহ বিভিন্ন দেশের ৭৬৯। অভিযোগ সৌদি সরকারের গাফিলতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেই এত বড় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে সৌদি সরকার ঘটনার পর থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এতবড় আয়োজনের দায়িত্ব সৌদি সরকারের ওপর থেকে সরিয়ে ওআইসির অধীনে নেয়ার দাবি হাজীদের। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ হজ মিশন ১৪০ জন নিখোঁজ বাংলাদেশীর একটি তালিকা করে। তবে প্রকৃত কতজন আসলে হতাহত হয়েছে সে বিষয়ে এখনো সঠিক তথ্য তাদের জানা নেই বলে জানিয়েছেন সৌদি দূতাবাসের প্রথম সচিব জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য না জানালে আনুষ্ঠানিক কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে দূতাবাসের পক্ষ থেকে মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিনায় দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশী হাজীদের উৎকণ্ঠিত স্বজনরা তাদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজ পাচ্ছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে তারা ৯৮ নিখোঁজ বাংলাদেশী হাজীর তালিকা তৈরি করেছেন’। নিখোঁজ ২৬ জনকে খুঁজে পেয়েছে হজ মিশন। এদিকে সৌদি সরকার মিনায় আল নুর হাসপাতালে নিহত ও মিনার কেন্দ্রীয় মর্গ মোয়াইজামে রাখা লাশের ছবি টাঙিয়ে দিয়েছে। নিহতদের গোসল করানোর পর ছবিসহ আঙ্গুলের ছাপ রাখা হয়েছে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে সংরক্ষিত ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ দেখে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও পরিচয় প্রকাশ করবে সৌদি সরকার। আহতদের মিনা আল নূর হাসপাতাল, মক্কার কিং আব্দুল আজিজ হাসপাতাল, কিং ফয়সাল হাসপাতাল, কিং আব্দুল্লাহ মেডিক্যাল সিটি, মিনা আল জিসর হাসপাতাল ও হেরা হাসপাতালসহ সাতটি হাসপসাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে গুরুতরদের জেদ্দা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মিনা ও মক্কার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা চিকিৎসক ডাঃ খিজির জানান, আহতদের বেশিরভাগই কালো চেহারার। বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের চেহারা প্রায় একই রকম বলে অচেতনদের দেখে বাংলাদেশী কিনা শনাক্ত করা কঠিন। মক্কায় বাংলাদেশ মিশনের কনস্যুলার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, নিখোঁজের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের সন্ধান মিলেছে। প্রকৃত নিখোঁজ হাজীদের নামের তালিকা রাতে (বাংলাদেশ সময় রাত বারোটায়) জানানো হবে। এদিকে শনিবার মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনে হাজীদের খোঁজ নিতে আসা স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, হজ মিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সঠিক কোন তথ্য দিচ্ছে না। কর্মকর্তারা ব্যস্ত ভিআইপিদের প্রটোকলসহ হজ এজেন্সির তদ্বির নিয়ে। মিনা ট্র্যাজেডি নিয়ে হজ মিশনের কোন মাথাব্যথা নেই বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। মিনায় পায়ে পিষ্ট হয়ে নিহত হাজীদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পরিচয় জানা গেছে। নিহতরা হচ্ছেন জামালপুর সদরের হাটচন্দ্রা এলাকার মোল্লা বাড়ির খন্দকার সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ফিরোজা খানম, সুনামগঞ্জ শহরের হাজীপাড়া এলাকার মকুল হুদার স্ত্রী জুলিয়া হুদা, ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার তাহেরা বেগম ও তার ভাই নূর আলী মিন্টু এবং দিনাজপুরের কেরামত আলী। নিয়ম অনুযায়ী মিনায় নিহত হাজীদের হারাম শরীফের ভেতর হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর বাড়ির উত্তর পাশে জান্নাতুল মুয়াল্লায় কবরস্থ করা হবে। আর মদিনায় নিহত হলে জান্নাতুল বাকীতে কবরস্থ করার বিধান চালু রয়েছে। সৌদি সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ৭১৭ হাজী নিহত হয়েছেন এবং আরও প্রায় হাজারের বেশি হাজী আহত হয়েছেন। আহত বা নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে দুর্ঘটনার দিনে আহতদের উদ্ধার করে মিনা অঞ্চলের সাতটি হাসপাতালসহ অনেক ক্লিনিকে নেয়া হয়। উদ্ধার কাজে অংশ নেয় প্রায় ৪ হাজারের বেশি কর্মী। ঘটনাস্থল থেকে আহতদের হাসপাতালে নিতে ২২০ এ্যাম্বুলেন্স সর্বক্ষণিক কাজ করেছে। হেলিকপ্টারও যোগ দেয় এ সময় উদ্ধার কাজে। সৌদি আরবের মিনায় বড় জামারাতে (বড় শয়তানকে) পাথর ছুড়ে বের হয়ে আসার সময় গত বৃহস্পতিবার পায়ে পিষ্ট হয়ে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এই দৃশ্য যারা চোখে দেখেছেন তাদের মধ্যে আছেন ময়মনসিংহের সাদেক আলি সরকার। এই ঘটনাকে অত্যন্ত হৃদয় বিদারক হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি জানান, চোখের সামনে হাজার হাজীকে (বড় শয়তান) পাথর মেরে বের হওয়ার পথে ২০৪ নম্বর সড়কের কাছে জামারাত সেতুর (ওভার ব্রিজ) প্রবেশমুখে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ। ময়মনসিংহ সদরের দলিল লেখক হাজী ইউসুফ আলীর অভিযোগ, শত শত হাজী একসঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখলেও পুলিশ তাদের সাহায্যে কাউকে এগিয়ে আসতে দেয়নি। লাশগুলো ময়লা পরিষ্কারের যন্ত্র দিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে। এর আগে মহিলা ও পুরুষদের লাশ আলাদা করে রাস্তার ওপর স্তূপ করে রাখা হয়। বাংলাদেশ থেকে আসা মেডিক্যাল টিমের প্রধান ডাঃ খিজির হায়াত খান জানান, এমনিতেই তাপমাত্রা ছিল ৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তারওপর আরাফাত ময়দান ও মুজদালিফা হয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিনায় আসার পর অনেকে ছিলেন ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। পানিশূন্যতায় ভুগছিলেন অনেকে। এমন অবস্থায় প্রখর রোদে ব্যারিকেডে আটকাপড়া হাজীরা হিটস্ট্রোকে রাস্তার ওপর পড়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটা (বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টা) মিনার ২০৪ নম্বর সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এই সড়কে আরব ও আফ্রিকান দেশ থেকে হজে আসা নারী-পুরুষ মিনায় আসা যাওয়া করেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার হাজীরা সচরাচর এই সড়ক ব্যবহার করেন না। তবে পথ ভুলে অনেকেই এ সড়কে এলেও আসতে পারেন মনে করেন অনেকেই। ৯ জিলহজ মোজদালিফায় সারা রাত অবস্থান শেষে পরদিন সকালে এই সড়ক দিয়ে শয়তানকে পাথর মারার উদ্দেশ্যে মিনায় আসছিলেন। এখানে কয়েকটি ফ্লাইওভার ও সংযোগ সড়ক রয়েছে। এত লোক এক সঙ্গে না ঢুকে সুশৃঙ্খলভাবে আসার জন্য কর্তব্যরত নিরাপত্তা বাহিনী সড়কে আগেই ব্যারিকেড দেয়। আর তখনই ঘটে এই বিপত্তি। সবার মধ্যে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। আফ্রিকান ও আরবের অন্য দেশ থেকে হজে আসা হাজীদের মধ্যে বাগ্বিত-া শুরু হয়। এরপর ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি। পাথর মারতে আসা হাজীরা প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার হেঁটে এই সড়কে পৌঁছেছিলেন। এদিন প্রচ- গরম ও রাত জেগে মোজদালিফায় থাকায় সকালে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত ছিলেন। তাই বয়স্ক ও নারীদের হাঁটার গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। পেছনের মানুষের হাঁটার গতি ছিল বেশি। আর এ অংশে ছিল আফ্রিকা থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। প্রত্যক্ষদর্শী হাজী ও ময়মনসিংহ পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ সুলতান আহমেদও আকস্মিকতায় এর মধ্যে আটকে পড়েন। তিনি বলেন, ‘নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। এমন ভয়াবহ দৃশ্য কখনও দেখিনি। মোজদালিফায় সারারাত জেগে দুর্বল ছিলাম। উপরন্তু প্রচ- গরমে হাঁসফাঁস করছিলাম। ভুল করে এ পথে এসে আমি আটকে যাই। আমি কিভাবে বেঁচে গেছি তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।’ তিনি অঝোরে কেঁদে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগে সকলের মধ্যে ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। আরবী ভাষায় একে অপরের মধ্যে উচ্চবাচ্য চলছিল। নারী-পুরুষের কান্নাকাটি চেঁচামেচি শুনতে পাচ্চিলাম। এ দৃশ্য দেখে ভেবেছিলাম আমি হয়ত আর বাঁচব না। কিন্তু ঠেলাঠেলির মধ্যেই আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি আপনাআপনি নিরাপদ স্থানে চলে যাই। না হলে হয়তো আমাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হতো।’ ঘটনার পর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হওয়ায় হজে আসা হাজীদের খোঁজ নিতে দেশ থেকে স্বজনরা ফোন করেন। মিনায় অবস্থানরত একাধিক হাজীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে স্ত্রী, বাবা, মা, ছেলে মেয়ে বন্ধুরা ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন। সুস্থ আছি কিনা সেই খবর বার বার জানতে চেয়েছেন। আবার দেশ থেকে টেলিফোন করে যারা তাদের মোবাইলে পাচ্ছিলেন না, তাদের মধ্যে তখন উৎকণ্ঠা বেড়েছে। স্বজনদের মধ্যে কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। সত্যতা নিশ্চিত হতে বাধ্য হয়ে হজে আসা পরিচিত অন্যদের কাছে ফোন করেছেন। ফোন ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হজ করতে আসা স্বজনদের খোঁজ জানার চেষ্টা করেছেন অনেকে। সরেজমিন মিনায় তাঁবুতে থাকা বাংলাদেশী হাজীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্ঘটনার দিন তাঁবুতে অবস্থান নেয়া হাজীদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। বাংলাদেশের হাজী কেউ মারা গেছেন কিনা সেই খবর জানতে খুব উদগ্রীব ছিলেন তারা। অনেকেই ঘটনাস্থলে আসার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বেষ্টনীর বাইরে যেতে দেয়নি। তবে পায়ে পিষ্ট হয়ে নিহত ও নিখোঁজদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশী রয়েছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে হজে আসা ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানসহ অন্যান্য মন্ত্রী ঢাকায় সৌদি দূতাবাসকে নির্দেশ দেন। হাসপাতালসহ ঘটনাস্থলে যেতে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়। মিনায় ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে জোহর, মাগরিব ও এশার নামাজে নিহত হাজীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মিনায় বিশেষ দোয়া মোনাজাত হয়েছে। জানা যায়, এবার ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলিম হজ পালন করছেন। এর আগেও হজ পালন করতে গিয়ে নানান সময়ে পায়ে পিষ্ট হয়ে হাজীরা মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৯০ সালে মক্কায় পায়ে পিষ্ট হয়ে ১ হাজার ৪২৬ হাজীর মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে মিনায় বড় শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপকালে ১৮০ হাজীর মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে মিনায় মারা যান ৩৫, ২০০৬ সালে মিনায় পাথর নিক্ষেপের সময় দুর্ঘটনায় ৩৬০ জনের বেশি হাজী, চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর হজ চলাকালে মক্কায় মসজিদুল হারামে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ক্রেন ভেঙ্গে ১১১ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরও ৪০০। ইতোমধ্যে নিহত- আহতদের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে সৌদি সরকার। তবে এ পর্যন্ত এত বিপুল সংখ্যক হাজীর মৃত্যুর ঘটনায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য বেদনাদায়ক বলে অনেকেই মনে করছেন। সংসদ রিপোর্টার জানান, সৌদি আরবের মিনায় পদদলিত হয়ে হাজীদের মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় সংসদের স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার ও চীফ হুইপ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার শোকবাণীতে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নিহত হাজীদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি আহত হাজীদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। পৃথক শোকবাণীতে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া এবং চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ নিহত হাজীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।
×