ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্ণসূত্রের বহুমুখীনতা

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

স্বর্ণসূত্রের বহুমুখীনতা

পাটের সুদিন ফিরে এসেছে। বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলেছে পাটজাত পণ্যের চাহিদা। দামও ভাল। ট্র্যাডিশনাল পাটের বস্তা ও সুতার চাহিদা অতটা না থাকলেও নতুন নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে রূপান্তরিত পাটজাত পণ্য মন কাড়ে একালে সহজেই। এসব পণ্য যেমন সৌখিন, তেমনই প্রয়োজনীয়। পরিবেশবান্ধব তো বটেই। যে পাট অতীতের গৌরব হারিয়ে সোনালি আঁশ হতে এদেশের চাষীকুলের গলার ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, তা-ই আবার বিশ্ববাজারে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। অর্থনীতিতে পাটের ভূমিকা খুবই ইতিবাচক। পাটকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সবচেয়ে বড় খাতে পরিণত করার কাজটিকে এগিয়ে নেয়া জরুরী। সরকার বির্পযস্ত পাট খাতের পুনর্জাগরণের জন্য নানা কর্মসূচী নিচ্ছে; কিন্তু সেসব কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে সবই বৃথা। খুব ধীর গতিতে চলা বাস্তবায়নের কাজ সুদূরপ্রসারী কোন ফল দেবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে পাটের বহুমুখী ব্যবহার সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে। পাটতন্তু দিয়ে ব্যাগ, মেয়েদের কোট, টিস্যুবক্স, জুতা-স্যান্ডেল, ওয়ালমেটসহ নানা ধরনের নিত্য ব্যবহার্য পণ্য তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য বিদেশেও যাচ্ছে। কিন্তু দেশে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে চটের ব্যাগ বাজারজাতকরণের কথা বহুবার বলা হয়েছে। পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও বাজারে তার যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। পাটের ব্যাগের চাহিদা থাকলেও তার উৎপাদন তেমন নেই। এ খাতে পাটের বহুমুখী ব্যবহার থাকলে তা নিয়ে পরিকল্পনাও নেই, তাই প্রকল্পও নেই। পাটের দেশ হিসেবে এক সময় বাংলাদেশের কদর ও সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। পাট ছিল প্রধান রফতানি পণ্য। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো এই স্বর্ণসূত্র রফতানি করে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পূর্ব বঙ্গে গড়ে ওঠে অনেক পাটকল। নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিল। পাটশিল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জ ছিল সবিশেষ প্রসিদ্ধ। শীতলক্ষ্যা পাড়ের এই বন্দর শহরটিকে অভিহিত করা হতো তখন প্রাচ্যের ডান্ডি বলে। এছাড়া খুলনা, পাবনা, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামে স্থাপিত হয় বড় বড় পাটকল। পাটের আবাদ হতো তখন কম-বেশি দেশের সব অঞ্চলে। তৃণমূল পর্যন্ত প্রসার ঘটেছিল পাট বাণিজ্যের। পাটের ব্যবসাই ছিল সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক লাভজনক। পাট ব্যবসার প্রয়োজনে সারাদেশে কত মোকাম ও নদীবন্দরের যে বিকাশ ঘটেছিল তার ইয়ত্তা নেই। দেশের নানাস্থানে বিশালায়তন গুদাম বলতে তখন প্রধানত পাটের গুদামকেই বোঝানো হতো। সে দিন ফুরিয়ে গেছে। বিশ্ববাসী পাটকে বাদ দিয়ে কৃত্রিম তন্তু তথা পলিথিনে ঝুঁকে পড়ে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম পড়ে যায় পাটের। চাহিদা হ্রাস পায় সোনালি আঁশের। গৌরবের স্থান হতে দেখতে দেখতে পতন ঘটে যায় পাটের। সরকারী ব্যবস্থাপনায় কারখানাগুলো সেই পতন ও ক্ষয়িষ্ণুতাকে ত্বরান্বিত করেছে। জান্তা শাসকরা বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি গ্রহণ করলেও পাটশিল্প ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হয়নি। বিশৃঙ্খল ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অধিকাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। একুশ শতকের গোড়ায় বন্ধ করে দেয়া হয় আদমজী জুট মিল। পাটচাষীদের অবস্থাও বেগতিক হয়ে পড়ে। পাটের ন্যূনতম মূল্য না পেয়ে পাট চাষ কমিয়ে দেয়। বিদ্যমান এই বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের কদর বাড়লেও বাংলাদেশ রফতানি খাতে এগিয়ে যেতে পারেনি। পাট গবেষণায় গতি এলেও পাটজাত পণ্য উৎপাদন বাড়েনি। প্রয়োজন এখন পাটনীতি, দূরদর্শী পরিকল্পনা, পাটপণ্য বহুমুখীকরণে অগ্রাধিকার এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা। পরিবেশবান্ধব পাটের বহুমুখীনতা জরুরী যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। পাটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এর বহুমুখী ব্যবহারের পথ সম্প্রসারণ করাই একমাত্র পথ।
×