ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুব রেজা

সবকিছু ধোঁয়াটে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সবকিছু ধোঁয়াটে

ছবিটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। ছ্যাঁৎ করে উঠল কলজে। এক নজর দেখেই তার বুকের ভেতরটা কেমন হিম হয়ে গেল। ছবিটা দেখার পর মনে হল, কে যেন প্রচ- এক ঝাঁকুনি দিয়ে গেল তাকে। তার সারা শরীর কাঁপছে। অথচ এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। কী সুন্দর একটা সকাল আজ। শরতের সকালে পাশের বাড়ি থেকে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ দেয়াল উজিয়ে তাদের ঘরে একটা মিষ্টি সুবাস ঢেলে দিচ্ছিল। সেই সুবাসে সে মন-প্রাণ উজাড় করে শ্বাস নিচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে সে নিয়ম করে দরজার দিকে তাকায়। হকার ছেলেটা খুব কায়দা করে পত্রিকাটা দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে ভেতরে দিয়ে যায় যাতে তার লাখ টাকা দামের ঘুম নষ্ট না হয়। ঘুম থেকেই উঠেই তার চোখ প্রথমে যায় দরজা বরাবর। পত্রিকাটা পাখির ডানার মতো ভাঁজ ভাঙ্গা অবস্থায় দরজার নিচে উঁকি মারে। আজও ঘুম থেকে উঠে চুলা জ্বেলে কেটলিতে পানি চড়িয়ে দিয়ে সে বাথরুমে গেল। সাত-আট মিনিটের মধ্যে পানি কলবল করে ফুটতে থাকে। কাপে রেডি টি ব্যাগ ফেলে গরম পানি ঢেলে পত্রিকা নিয়ে মেঝেতে বসে রোজকার মতো চোখ বুলিয়ে নেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। কিন্তু এ কী! পত্রিকার প্রথম পাতায় যে ছবি ছাপা হয়েছে তা দেখে সে রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়ে। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছবিটা সে আবার ভাল করে দেখল। আবার আবার। যতবার সে ছবিটা দেখেছে ততবারই তার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কী ভয়ঙ্কর! কী সাংঘাতিক! সাগর উপকূলে তিন বছরের এক শিশুর মৃতদেহ পড়ে আছে। নাম আয়লান। মুখ উপুড় করে শুয়ে আছে শিশুটি। সমুদ্রের নোনা ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে তার গাল। পরনে তার টুকটুকে লাল জামা। নীল রঙের জিন্স। পায়ে একজোড়া জুতো। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে আয়লান তার দু’বছরের বড় ভাই গালিব ও বাবা-মা ডুবে গিয়েছিল। সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে ওরা উন্নত জীবনের আশায় ওরা যাচ্ছিল ইউরোপে। তাদের বাবা কোনমতে প্রাণে বেঁচে গেলেও শিশু আয়লান, গালিব ও তার মা বাঁচতে পারেনি। করুণভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে। শিশু আয়লানের মৃতদেহ প্রথমে খুঁজে পান আলোকচিত্রী নিলুফার ডেমির। আয়লানের অমন নিষ্পাপ ফুটফুটে চেহারা তাঁকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল মুহূর্তেই।শিশু আয়লানকে ওভাবে সাগর উপকূলে পড়ে থাকতে দেখে নিলুফার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। তিনি ছবিটা তুলে নিয়ে ভাবলেন, বিশ্ববাসীর সামনে এ রকম ভয়ঙ্কর অমানবিক ছবি কিভাবে তিনি তুলে ধরবেন? এ ছবি প্রকাশ হলে মানুষের সামনে বিপন্ন মানবতাবোধ কি আর সমুন্নত থাকবে? নিলুফার ডেমিরের সামনে শিশু আয়লানের মুখ উপুড় করে পড়ে থাকা ছবি যেন অপার্থিব বিষাদের জ্বলন্ত প্রতীক হয়ে উঠল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই ছবি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলে উদ্বাস্তু জীবনের করুণ পরিসমাপ্তিসহ শরণার্থী সমস্যা- সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ছবিটা সে ছেড়ে দিল গণমাধ্যমে। এরপর আয়লান হয়ে উঠল বিশ্বমানবতার প্রতিচ্ছবি। ইউরোপের দেশে দেশে শুরু হলো অভিবাসী গ্রহণে তোড়জোড়। বিশ্বমোড়লরা তাদের পুরনো হিসেব নিকেশ বাদ দিয়ে নতুন করে হিসেব করতে বসল শরণার্থীদের ব্যাপারে। সকাল বেলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকার পাতার সব খবরের হেডিংগুলো সে একবার দেখে নেয়। ভাল লাগলে পড়ে- না লাগলে জাম্প করে। আজ কি হলো তার? কোন শিরোনামই তার আর পড়তে ইচ্ছে করল না। তার চোখ বারবার আটকে যাচ্ছে ছবিতে। চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেও তা কোনভাবে সম্ভব হচ্ছে না। ঘুরে ফিরে এসে আটকে যাচ্ছে আয়লানের ছবিতে। জানালা দিয়ে শরতকালের বাতাস এসে ঘরে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। শিউলি ফুলের গন্ধও কি এসে লুটিয়ে পড়ছে না তার ঘরে! সে এসবের কিছুই টের পায় না। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে হঠাৎ দেখতে পায়, তার চোখের সামনে মানে পত্রিকার পাতা থেকে একটা ছোট্ট পুতুলের মতো বাচ্চা নড়ে-চড়ে উঠল। আর কি আশ্চর্য বাচ্চাটা শুধু নড়েচড়েই উঠল না তাকে অবাক করে দিয়ে গুটি গুটি পায়ে পুরো ঘরময় হেঁটে বেড়াতে লাগল। চায়ের কাপ থেকে কু-লী পাকিয়ে উঠে যাওয়া ধোঁয়ায় পুরো ঘর যেমন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ধোঁয়ার ভেতর সে পরিষ্কার দেখতে পায় সব। সবকিছু। [email protected]
×