ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আরিফুর সবুজ

ইউরোপে শরণার্থী সমস্যা ও অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ইউরোপে শরণার্থী সমস্যা ও অর্থনীতি

একটি ছবি, কেবল একটি ছবি যে হাজারো শব্দ থেকে শক্তিশালী, তা প্রমাণিত হয়েছে তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দীর প্রকাশিত এক ছবির মধ্য দিয়ে। এই শিশুটির পরিবার তুরস্ক থেকে গ্রিসে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠেছিল। দুর্ভাগ্য, শিশুটির বাবা ছাড়া সবাই মারা যায় নৌকাডুবিতে। আর সমুদ্র সৈকতে শিশুটির উপুড় মৃত দেহের ছবিটি জাগ্রত করে দিয়েছে ইউরোপিয়ানদের ঘুমন্ত বিবেককে। সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের হাজার হাজার শরণার্থীকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে। কিন্তু ইউরোপ ছিল নিশ্চুপ। বিশ্বায়ন, মানবাধিকার ইত্যাদি বুলি আওড়ালেও, ইউরোপ শরণার্থীদের মানবিক বিপর্যয়ে চোখ বন্ধ করেই ছিল। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) হিসাব মতে, চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে এক হাজার ৭২৭ জন মারা গেছে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল তিন হাজার ২৭৯ জন। ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া এই মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল নারী ও শিশু। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা ছিল অনেকটাই নিশ্চুপ। তবে, পরিস্থিতি বদলে গেছে। বদলে দিয়েছে তিন বছরের শিশু আয়লান। ইউরোপ নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে। এ বছর ইতোমধ্যে তিন লাখ বাষট্টি হাজার শরণার্থী ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। প্রতিদিনই হাজার হাজার শরণার্থী প্রবেশের চেষ্টা করছে। জার্মানি, গ্রীস, ইতালি, হাঙ্গেরী, ডেনমার্কসহ ইউরোপের প্রায় সবদেশেই শরণার্থীরা ঢোকার চেষ্টা করছে। জার্মানি আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, দেশটি এ বছর আট লাখ অভিবাসী নেবে। এছাড়া অন্যান্য দেশগুলোও নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থীদের গ্রহণ করছে। কিন্তু এই শরণার্থীরা ইউরোপের অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্তর গবেষণা। দীর্ঘদিন মন্দা কাটিয়ে অঞ্চলটি সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, এর মধ্যে শরণার্থীদের এ চাপ অর্থনীতিকে আবারও ভঙ্গুরতার দিকে নিয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। জার্মানির মতো শিল্পোন্নত দেশে জনসংখ্যার ঘাটতি রয়েছে। ক্রমাগত জনসংখ্যা কমছে। এতে ভবিষ্যতে জার্মানিকে শ্রমশক্তির সঙ্কটে পড়তে হতে পারে। এ সংশয় দূর করতে পারবে শরণার্থীরা। সিরিয়া থেকে যে শরণার্থীরা জার্মানি বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে, এদের প্রায় সবাই শিক্ষিত ও কর্মক্ষম তরুণ। জার্মানির ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর ঘাটতি এরাই পূরণ করতে পারবে। জার্মানি ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হলেও, এখনও যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদন করতে পারছে না। এই সমস্যার সঙ্কটে ভূমিকা রাখবে সিরিয়ার শরণার্থীরা। শুধু জার্মানিই নয়, ইউরোপের প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে কর্মক্ষম জনশক্তির সংখ্যা। উপরন্তু বাড়ছে বয়স্ক ও পেনশনভোগীর সংখ্যা। জনসংখ্যা স্থিতি রাখতে যেখানে ২.১ জন সন্তান জন্মদান দরকার, সেখানে ইউরোপে গড়ে ১.৫ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা কমপক্ষে স্থিতি রাখার জন্য এদেশগুলো নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখন এই শরণার্থীরাই হয়ে উঠতে পারে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রচেষ্টার অন্যতম হাতিয়ার। শরণার্থীরা ইউরোপের বোঝা নয়। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ওইসিডির সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, অধিকাংশ শরণার্থীরা যে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে, তার থেকেও বেশি ট্যাক্স দিয়ে দেশগুলোর অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে চলছে। যদিও প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে শরণার্থীদের কারণে দেশগুলোকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে, আসলে তা নয়। শরণার্থীদের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হবে, তা আসলে বিনিয়োগ এবং এই বিনিয়োগের রিটার্ন অনেক বেশি। এটা ইউরোপিয়ানরা বেশ ভালভাবেই জানে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। একদিকে আইএস অনুপ্রবেশ করতে পারে শরণার্থী বেশে যা ইউরোপের জন্য হুমকিস্বরূপ আর অন্যদিকে সিরিয়ান মুসলিম শরণার্থীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে ব্যত্যয় ঘটতে পারে ইউরোপিয়ানদের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের। মূলত এ দুটি কারণে শরণার্থীদের কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সুবিধা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও ইউরোপ এখনও মানবিক দিকটিকে তত্ত্ব গুরুত্ব দিতে পারছে না। হাঙ্গেরী, ডেনমার্কের মতো দেশগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
×