ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুই তদন্ত কমিটি ॥ ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ

গুলিবর্ষণকারী সব পুলিশ কালিহাতী থেকে প্রত্যাহার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

গুলিবর্ষণকারী সব পুলিশ কালিহাতী থেকে প্রত্যাহার

স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের অভিযোগের সূত্র ধরে গত শুক্রবার পুলিশ ও জনতার সংঘর্ষে গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় শনিবারই গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের পর টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে। ওই ঘটনায় কালিহাতী ও ঘাটাইল থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা করা হয়েছে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের তরফ থেকে। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছে জেলা প্রশাসন। এলাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ঘটনায় গঠিত পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ সদর দফতরের তরফ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট এবং জেলা প্রশাসকের তরফ থেকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা মানুষকে ন্যায়বিচারের স্বার্থে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পুলিশ ও জনতাকে পরামর্শ দিয়েছেন। শনিবার পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (এমএ্যান্ডপিআর) নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী ও ঘাটাইল থানা এলাকায় সৃষ্ট ঘটনা, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং তিনজন নিহতের ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে ও দায়-দায়িত্ব নিরূপণের জন্য পুলিশের তরফ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোঃ মোখলেছুর রহমানের নির্দেশে কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে অতিরিক্ত ডিআইজি (ডিসিপ্লিন) মোঃ আলমগীর আলমকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আক্তারুজ্জামান এবং টাঙ্গাইল জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আসলাম খান। কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শনিবার তদন্ত কমিটির প্রধান ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছলে শুক্রবারের ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ কালিহাতী উপজেলার উত্তর বেতডোবা গ্রামের রুবেলের মা রুমি বেগম উপস্থিত হন। এ সময় টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মোঃ মাহবুব হোসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলের জন্য নগদ ১০ হাজার টাকা তার মায়ের হাতে তুলে দেন। তদন্ত কমিটির প্রধান স্থানীয় জনগণের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেন। তিনি ন্যায়বিচারের স্বার্থে জনগণকে ধৈর্য ধরতে বলেন। একই সঙ্গে অত্যন্ত সহনশীলতার সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পুলিশ ও জনতাকে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে জনগণের সহায়তা কামনা করেন তিনি। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জিল্লুর রহমান জানান, এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি কমিটির সদস্যের নাম প্রকাশ করেননি। গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের শনিবার প্রত্যাহার করে টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে নেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সঞ্জয় সরকারসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সময় গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের শুক্রবারই শনাক্ত করা হয়। ঘটনার পর পরই শনাক্ত হওয়া পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান। তিনি জানান, নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের ক্লোজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যেই শনাক্ত হওয়া পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করে টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে। এদিকে, শনিবার টাঙ্গাইল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিহতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা বিভাগের কর্মকর্তা মোঃ আশরাফ আলী জানান, তিনজনই বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। দুপুরে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মোঃ মাহবুব হোসেন নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা করেন। আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার জেলা প্রশাসন বহন করছে বলে জানান তিনি। এদিকে কালিহাতীর কালিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, নিহত শামীমের মা আমেনা খাতুন বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন। তিনি বলছেন, পবিত্র জুমার নামাজ পড়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় শামীম আর ফিরে আসে লাশ হয়ে। ঈদের পর শামীমের সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। তিনি তার ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেছেন। এদিকে, স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ শামীমের স্ত্রী বিথীর দুই সন্তান বাদল (৮) ও মীমকে (২) নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। তার কান্নায় সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আছে। কুষ্টিয়ার ভ্যানচালক ফারুকের বাড়িতেও একই চিত্র। ফারুকের প্রতিবন্ধী ছেলে আসিফকে (৮) জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন স্ত্রী আসিয়া বেগম। পাশেই বসে আছে তাদের মেয়ে ফাতেমা (৩)। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন মৃত্যুতে দিশাহারা পুরো পরিবার। একই অবস্থা শ্যামল দাশের (১৫) সালেঙ্কা গ্রামের বাড়িতে। সেলুনে কাজ করত শ্যামল। তিন ভাইয়ের মধ্যে শ্যামল ছিল সবার বড় ছিল। সন্তান হারানো পিতা কাঠমিস্ত্রী রবি দাশ ও মা ভারতী রানী বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। ঘটনার পর থেকেই কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড ও পার্শ্ববর্তী হামিদপুর বাজার এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম জানান, অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে সকাল থেকেই বাসস্ট্যান্ড ও হামিদপুর বাজারে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১৫ সেপ্টেম্বর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের অভিযোগের সূত্র ধরে ঘটনার সূত্রপাত হয়। মা-ছেলে থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনার রফিকুল ইসলাম রোমা ও তার ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমানকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এ নিয়ে গত শুক্রবার ঘাটাইল উপজেলার আঠারোদানা ও হামিদপুর এলাকার ৪-৫শ’ লোক বিক্ষোভ মিছিল করে কালিহাতী থানা ঘেরাওয়ের উদ্দেশে কলেজগেট এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন। ৯শ’ গ্রামবাসীকে আসামি করে পুলিশের মামলা ॥ বিডিনিউজ গভীর রাতে জানায়, পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহতের ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে ৯শ’ জনকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। শনিবার কালিহাতী ও ঘাটাইল থানায় এ মামলা দুটি হয় বলে সংশ্লিষ্ট থানার শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান। পুলিশের ওপর হামলার পাশাপাশি পুলিশের কাজে বাধা দান ও গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে এসব মামলায়। কালিহাতী থানার ওসি শহিদুল ইসলাম জানান, এসআই মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। একই অভিযোগে ঘাটাইল থানার এসআই মনসুব আলী অজ্ঞাত ৪শ’ থেকে ৫শ’ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন।
×