ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

নিজের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

নিজের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা যা তৎকালীন বিশ্বে অসম্ভব সাহসী কাজ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যে কারণে, জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছিল। আলবদর বন্ধু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সংবিধান থেকে এই মূলনীতি উৎখাত করেছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এই মূলনীতি আবার সংবিধানে সংযোজন করেন। কিন্তু, ইসলামী পৌরনীতিতে কী বলা হচ্ছে- আজ পড়ুন শেষ কিস্তি। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা সে যে ভুল এই ইসলামী পৌরনীতি না পড়লে তা জানতাম না। আসলে যা জানি এখন বৃদ্ধ বয়সে এসে দেখি তার সবই ভুল। জামায়াত সম্পর্কে লেখকের বয়ান দেখেন- ‘জামায়াতে ইসলামী’ শিরোনামে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে সর্বাধিক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিকে এ উপমহাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যাবলী ছাড়াও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানবতার পাশে সব সময়ই জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে। এদেশে ইসলামী অর্থনীতি চালুর প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীর বলিষ্ঠ ভূমিকা মুখ্য। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছে। পুস্তক প্রকাশনা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রভৃতি প্রণয়নে জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি বিশেষ অবদান রেখেছে। [পৃ. ৫৯১] আরও আছে। আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটালাম না। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তাতেও অনেক বিভ্রান্তি ও ভুল আছে। আমি ধর্ম বিশেষজ্ঞ নই সে জন্য এ বিষয়ে আর আলোচনা করলাম না। সামীম এ নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা করেছেন। যেমন ‘প্রথম মদকে একটি নেয়ামত ও আকর্ষণীয় পানীয় হিসেবে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।’ বারবার [দাখিল শ্রেণীর হাদিস শরীফ] জিহাদকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব বইতে যে আরবি ভুল লেখা হয়েছে ও শব্দের অর্থও ভুল করা হয়েছে তা তিনি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। কওমি মাদ্রাসায় কী পড়ানো হয় আগেই লিখেছি তা বলা দুষ্কর। কারণ, একেক মাদ্রাসায় একেক রকমের বই। এর ওপর সামীম আফজাল একটি জরিপ করলে পারতেন। তবে তা যে আরো ভয়ঙ্কর হবে এ ধারণা আমাদের আছে। আমাদের ধারণা যে ভুল নয়, তার প্রমাণ পেলাম ৬ সেপ্টেম্বর জনকণ্ঠে প্রকাশিত বিভাষ বাড়ৈর রিপোর্টে। তিনি লিখেছেন, বেফাক যে সব পাঠ্যবই পড়ায় তাতে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানই বহাল আছেন। শুধু তাই নয়, কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের মহাসচিব কিছুতেই বঙ্গবন্ধুকে মানতে রাজি নন। বাড়ৈ লিখেছেন- “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয় বেফাক। তাদের পাঠ্যপুস্তকে তাই জিয়াউর রহমানই ঘোষক। কথিত সংস্কারের পরেও একই অবস্থা রাখা হয়েছে। এতে প্রকৃত ইতিহাস থেকে দূরে থাকছেন কওমির শিক্ষার্থীরা। জানছেন ভুল, শিখছেন ভিন্ন ও বিকৃত ইতিহাস। বেফাক বলছে, জেনেশুনেই তাদের পাঠ্যপুস্তকে ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘোষক মানতে তাদের আপত্তি রয়েছে। পঞ্চম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যা শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশবাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমনি এক সময়ে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা শুনে বাংলার জনগণ অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রবন্ধে জিয়াকে স্বাধীনতার ‘ঘোষক’ বলা হলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু হিসেবেও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন সে বিষয়েও কোন তথ্য দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও আদালতের রায় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের মহাসচিব মুহাম্মাদ আব্দুল জব্বার জাহানবাদী বলেন, ‘আইন করে’ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলাটা ‘জুয়াচুরি’। সরকার আইন করে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক বলাটা ভুয়া আইন, জুয়াচুরিÑ এটা হয় না। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষকÑ আমিও এটার পক্ষে। জেনেশুনেই তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষক তো শেখ মুজিব না মন্তব্য করে তিনি বলেন, তিনি তো পাকিস্তানের জেলখানায় ছিলেন। ঘোষণা তো জিয়াই দিয়েছেন। উনি (বঙ্গবন্ধু) তো জেলখানায়, কোথায় ঘোষণা দিয়েছেন?” উল্লেখ্য, জাহানবাদী হেফাজতের একজন নেতা। বেফাকের মতে, পাঠ্যবইয়ের সংস্কার করা হয়েছে। আসলে বাড়ৈর মতে, সংস্কার যা হয়েছে তা হলো পাঠ্যবইয়ে লেখকের নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কনটেন্ট আগের মতোই রয়ে গেছে। চার. এ প্রবন্ধের উপসংহারের প্রয়োজন আছে কী? মনে হয় নেই। আমরা অনেক সময় বলি, বর্তমান সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য এত করছেন তারপরও বিএনপি-জামায়াত এত ভোট পায় কিভাবে? এর কারণ, মানস জগতে তাদের আধিপত্য। সুদীর্ঘ চার দশক তারা নতুন প্রজন্মের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। নিজেদের প্রচারমাধ্যম সৃষ্টি করেছে। ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো বিনষ্ট করেছে। মাদ্রাসার চিত্র তো দেখলেন। কিন্তু আপনারা হয়ত ভুলে গেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে বারবার পাঠ্যবই বদল করেছে, স্বাধীনতার দলিলপত্র বদল করেছে। ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের প্রচারযন্ত্র বা তাদের সমর্থক সুশীলরা ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। মাদ্রাসার পাঠ্যবইগুলোতে যা লেখা হয়েছে তা তো বিএনপিরও বক্তব্য। এবং এখনও যখন এগুলো পড়ানো হচ্ছে, তখন ধরে নিতেই হবে মানস জগতে তারা প্রতিষ্ঠা শুধু পায়নি, তা দৃঢ় করেছে। ১৪ দলীয় সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে পরিচিত হলেও তারা এ বিষয়ে আগ্রহী নয়, অন্তত তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বলে মনে হয় না। এই নিবন্ধ কি তাদের প্রয়াসের কথা তুলে ধরে? আমি এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন সমালোচনা করব না। কারোই নয়। হয়ত বই ছাপানোতে তাদের যে আগ্রহ এসব ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ নেই। তাছাড়া, আরো একটি বিষয় আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা, সচিব ও মন্ত্রী বা এমপিদের যদি কোন সমালোচনা করেন তাহলে সরকার জেদ ধরে তাকে প্রমোশন দেয় বা আরো উত্তম জায়গায় স্থানান্তরিত করে। সে জন্য আমি এদের সবার প্রশংসা করি। আমি মনে করি, সরকার অত্যন্ত দয়াবান [জেনারাস], বা গণতন্ত্রে তাদের অসীম ভক্তি, তারা মনে করে হেফাজত বা জামায়াতীরা শিশুর মতো। ওরা এরকম অনেক কিছু করে। একটু বকে দিলেই হবে। পৃথিবীতে এমন একটি নজির দেখাতে পারবেন যে সরকার নিজের নীতির বিরোধিতা, জাতির জনক ও রাষ্ট্রের প্রতি অশ্রদ্ধা, সরকারপ্রধানের প্রতি অশ্রদ্ধা [‘নারীরা দৈহিক ও প্রাকৃতিক কারণে পুরুষের তুলনায় অক্ষম। ফলে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক পদে নারী নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। আর এ কারণে বলা হয়েছে নেতৃত্বদান কেবলমাত্র পুরুষদের পক্ষেই সম্ভব’-ইসলামী পৌরনীতি, ইসলামিয়া কুতুবখানা, পৃ. ৩৩৪] প্রকাশের জন্য বছরে ২০৭৮৮৬৯৯ টাকা খরচ করে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপ্রাণ চেষ্টা করে রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও মর্যাদা কি বৃদ্ধি করছেন এদের জন্য? কে জানে? আপনি কি এখনও বিশ্বাস করেন বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ নয়?
×