ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফাঁসের বিশেষ ডিভাইস পাওয়া গেছে, ইউজিসি কার্যালয়ে র‌্যাবের তল্লাশি

মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পরিচালকসহ তিন গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পরিচালকসহ তিন গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক সহকারী পরিচালকসহ ৩ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও বিশেষ ডিভাইস। ইউজিসির একটি কক্ষ থেকেই তাদের গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্নপত্রগুলো চলমান মেডিকেল পরীক্ষার কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিভাইসগুলো ছাত্রদের কানে লাগানো থাকে। দূর থেকে সেই ডিভাইসে প্রশ্নের উত্তরগুলো ব্লু টুথের মাধ্যমে পাঠানো হয়। কানে লাগানো সেই ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর জেনে তা লিখে দেয় ছাত্ররা। এমন অভিনব কায়দায় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছিল। শুক্রবার সকালে র‌্যাব-৪-এর একটি দল রাজধানীর আগারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ভবনের ২য় তলায় অভিযান চালায়। অভিযানে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা, কৃষি ব্যাংকের অফিসার নিয়োগ, জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র বিতরণকারী চক্রের মূল হোতা মোঃ ওমর সিরাজ (৩২), পিতা-ইসমাইল হোসেন, সাং-সোনারহোপ, থানা-শার্শা, জেলা-যশোর, তার সহযোগী রেজাউল করিম (৩২), পিতা-আনসার আলী, সাং-ভাওয়ালখোলা, থানা-আটঘরিয়া, জেলা-পাবনা ও ঈশান ইমতিয়াজ হৃদয় (২২), পিতা-আব্দুল ওয়াহেদ, সাং-গকুল, থানা-গকুল, জেলা-বগুড়াকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন ২০১৪-এর সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র ২৩টি, একই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ২টি, ২ লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংকের ৪ লাখ টাকার একটি চেক, বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের সিল, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ৩টি মোবাইল ও ১টি আইপ্যাড উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, চক্রের মূল হোতা ওমর সিরাজ সহকারী পরিচালক (বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে কর্মরত। গ্রেফতারকৃতরা মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা, কৃষি ব্যাংকের অফিসার নিয়োগ, জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র সরবরাহ করে আসছিল। ওমর সিরাজ মূলত তিন ধাপে জালিয়াতি করে থাকেন। প্রথম ধাপে বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় তার পূর্বে বাছাইকৃত একটি গ্রুপকে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রেরণ করেন। এই গ্রুপের কাজ হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কৌশলে হল থেকে বের করে অপেক্ষমাণ অপর একটি গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা। দ্বিতীয় ধাপে প্রশ্নপত্র সংগ্রাহক গ্রুপটি প্রশ্নপত্রটি দ্রুত সমাধান করে মূল হোতা ওমর সিরাজের কাছে সরবরাহ করে। শেষ ধাপে মূল হোতা ওমর সিরাজ ও আরও কিছু ব্যক্তির সহায়তায় পূর্বে থেকেই চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের মাঝে অত্যন্ত সুকৌশলে উন্নত প্রযুক্তির ডিভাইস (চীন থেকে আমদানিকৃত মাস্টারকার্ড ও ব্লুটুথ যা অতিক্ষুদ্র এবং কানের মধ্যে লুকানো থাকে)-এর মাধ্যমে উত্তরপত্র বাইরে থেকে সরবরাহ করে থাকেন। আটককৃত অপর দুই সদস্যের মধ্যে ঈশান ইমতিয়াজ ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই এবং রেজাউল করিম (স্টোর কিপার, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন-এ চাকরিরত অবস্থায়) এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। ওমর সিরাজ জানান, ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার জমাকৃত উত্তরপত্র অত্যন্ত সুকৌশলে রেজাউল করিম (স্টোর কিপার, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন) এবং কন্ট্রোলার পার্সোনাল অফিসার নাজিমের সহায়তায় বের করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের দিয়ে পুনরায় উত্তরপত্র তৈরি করে জমা করে দিত। ওমর সিরাজের কার্যালয় এবং তার বাসায় তল্লাশিকালে প্রাপ্ত জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগের উত্তরপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওমর সিরাজের স্ত্রী (সাবিনা ইয়াসমিন) এর জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগের উত্তরপত্রটিও কৌশলে বের করে পুনরায় জমা করার জন্য ওমর সিরাজের কাছে রেখেছিল। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই চক্র প্রতি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৫ লাখ, কৃষি ব্যাংকের অফিসার নিয়োগের জন্য ৬ লাখ এবং জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহকারী জজ নিয়োগের জন্য ১০ লাখ টাকা নিত। ইউজিসির উপসচিব (জনসংযোগ) মো. ওমর ফারুখ জানান, শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকলেও র‌্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে তারা সেখানে ছুটে যান। র‌্যাব তাদের সঙ্গে বা ইউজিসি’র কোন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেনি। ঘটনাটি তাদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। তারা সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজের কক্ষে অভিযান চালিয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপপরিচালক মেজর মাকসুদুল আলম জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষা কেন্দ্রে উত্তর সরবরাহের জন্য ওই কক্ষে একটি ‘ডিভাইস’ বসানো হয়েছিল, যা আনা হয়েছিল চীন থেকে। গত ৭ দিনে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৪২ জনকে আটক করা হয়েছে। র‌্যাব ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল রাজশাহী থেকে ১০ জন, গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানী থেকে কলেজের প্রভাষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের ১৩ জন ও প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষা দেয়ার সঙ্গে জড়িত ৮ পরীক্ষার্থী, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ৬ জন, চলতি বছরের ২৬ জুন কন্ট্রোলার এ্যান্ড অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নোত্তরপত্র ফাঁসকারী চক্রের ৩ জন মূল হোতাসহ ১৫ জন, গত ১৫ সেপ্টেম্বর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা জসিম উদ্দিন ভুইয়াসহ ৪ জনকে প্রশ্নপত্র বিক্রির প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতেই শুক্রবার অভিযানটি চালানো হয়।
×