ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৯৫ হাজার ফার্মেসির ৬০ হাজারের লাইসেন্সের মেয়াদ নেই

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

৯৫ হাজার ফার্মেসির ৬০ হাজারের লাইসেন্সের মেয়াদ নেই

নিখিল মানখিন ॥ সরকারী তালিকাভুক্ত ৯৫ হাজার ফার্মেসির মধ্যে ৬০ হাজারের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান বন্ধে জোরালো অভিযান শুরু হয়েছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ দোকানগুলো সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন অভিযান টিমের সদস্যরা। ওই সব ফার্মেসির মালিকরা গত দুই থেকে পাঁচ বছর ধরে লাইসেন্স রিনিউ না করে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে মাত্র ৩৫ হাজার ফার্মেসি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর অননুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা সোয়া লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ দোকানগুলো সামাল দেয়ার পর অননুমোদিত, অবৈধ দোকানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। এতে অভিযানের সফলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দোকানগুলোর ঠিকানা, বৈধতা ও অবৈধতা যাচাই করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে ওষুধের দোকান। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের চা, পান, বিড়ি, মুদির দোকানেও দেদার বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ। রাজধানীতেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। অবৈধ ওষুধের দোকান জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় অবিলম্বে লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান বন্ধে জোরালো অভিযান শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি। তার নির্দেশে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে এ অভিযান। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। আর অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন দোকানের লাইসেন্স দেয়া যাবে না। সারাদেশে সরেজমিন পরিদর্শন করে লাইসেন্সবিহীন দোকান চিহ্নিত করে দ্রুত প্রতিবেদন পেশ করতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে নির্দেশ প্রদান করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বৈঠকে স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল আহসান খান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ দীন মোঃ নুরুল হক, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইমপোর্টারস এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সুকুমার ঘোষ এমপি, এ্যাসোসিয়েশন ড্রাগস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল কবীর, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চেয়ারম্যান ডাঃ দিলীপ কুমার রায়, বাংলাদেশ ইউনানী বোর্ডের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম মুন্সীসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ ভেষজ চিকিৎসক সমিতির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এসময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ভেজাল, নকল বা অননুমোদিত ওষুধ বিক্রয় প্রতিরোধে আরও কঠোর হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ভেজাল ওষুধ ও খাবার প্রতিরোধে সরকারের অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোনভাবেই এ অভিযান বন্ধ করা হবে না। এক্ষেত্রে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চান মন্ত্রী। এসময় জাতীয় ওষুধ নীতির সংশোধনে সরকারের উদ্যোগের কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নতুন ওষুধ নীতিতেও ভেজাল ও নকল ওষুধ বিপণনের বিরুদ্ধে কঠোর বিধান রাখা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে ওষুধ ও খাবারের নকল বন্ধে কিছুদিন ধরে অভিযান চালাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ভেজাল ওষুধের কারখানা বন্ধ করা হচ্ছে। সীমিত জনবল ও সম্পদ নিয়ে সরকারের একার পক্ষে কাজটি করা দুরূহ। এ লক্ষ্যে ওষুধ প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করা হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে জেলাপর্যায়ের অফিসকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, এমনও দেখা যায় শাস্তি পাওয়ার পরও পুরনো ভেজাল ব্যবসায়ীরা আবারও একই অপরাধ করছে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতা বন্ধ করতে সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহ্বান জানান মোহাম্মদ নাসিম। এসময় মন্ত্রী বলেন, দেশের বড় বড় বিখ্যাত হাসপাতাল ও দোকানে যদি ভেজাল ও অননুমোদিত ওষুধ পাওয়া যায়, তবে দেশবাসী কোথায় যাবে? দেশবাসীকে বাঁচাতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদেরই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে দোকানে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিক্রয় বন্ধে জনমত সৃষ্টি করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে অনুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা ৯৫ হাজার ১৯৬টি। ময়মনসিংহ জেলার ১২টি উপজেলায় রয়েছে মোট ২ হাজার ৯২২টি ফার্মেসি। এ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার ১৫২টির মধ্যে ৭২টি, ধোবাউড়ার ৪৫টির মধ্যে ৬টি, ভালুকার ৩৫৪টির মধ্যে ১৪১টি, গফরগাঁও উপজেলার ২৩৯টির মধ্যে ৮৪টির, গৌরীপুরের ৯৫টির মধ্যে ৩৬টি, ঈশ্বরগঞ্জের ১৪০টির মধ্যে ৬৭টি, মুক্তাগাছার ২৭৩টির মধ্যে ৯৬টি, ময়মনসিংহ সদরের ১ হাজারের মধ্যে ৩৯৩টি, নান্দাইলের ১৪৩টির মধ্যে ৬৯টির, ফুলবাড়ীয়ার ১৭৭টির মধ্যে ৭২টি, ফুলপুরের ১৩১টির মধ্যে ৫০টি এবং ত্রিশাল উপজেলার ১৭৩টি ফার্মেসির মধ্যে ৯৫টির বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। বাকিগুলো আর রিনিউ করা হয়নি। এভাবে টাঙ্গাইল জেলার ৩ হাজার ৩৩৯টির মধ্যে ৯শ’টি, বাগেরহাট জেলার ১ হাজার ২৪১টির মধ্যে ৫১২টি, বান্দরবানের ৩২৪টির মধ্যে ১০৫টি, বরগুনার ৭৫০টির মধ্যে ৪১৩টি, বরিশালের ১ হাজার ৯৬৪টির মধ্যে ১২০৫টি, ভোলার ৬৭৩টির মধ্যে ৩৫৪টি, বগুড়ার ৩ হাজার ৪৪৪টির মধ্যে ১ হাজার ৮৪৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১ হাজার ৪৪১টির মধ্যে ৬১৫টি, চাঁদপুরের ১ হাজার ২৯১টির মধ্যে ৫৬৩টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১ হাজার ৩১৩টির মধ্যে ৭৩২টি, চট্টগ্রামের ৬ হাজার ৬৬০টির মধ্যে ৩ হাজার ৭১৯টি, কুমিল্লার ২ হাজার ৭২টির মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি, কক্সবাজারের ২ হাজার ২৩১টির মধ্যে ১ হাজার ২০১টি, ঢাকার ৩ হাজার ৭৪৫টির মধ্যে ১ হাজার ৮৩৭টি, দিনাজপুরের ১ হাজার ৫৬৭টির মধ্যে ৬৯২টি, ফরিদপুরের ১ হাজার ৬৪৩টির মধ্যে ৯১৬টি, ফেনীর ১ হাজার ১২৪টির মধ্যে ৫১৭টি, গাইবান্ধার ৭৩৪টির মধ্যে ৩৭৬টি এবং মৌলভীবাজার জেলার ১ হাজার ৩৮৭টি ফার্মেসির মধ্যে ৭৫৪টি ফার্মেসির লাইসেন্স রিনিউ করা হয়নি। অর্থাৎ এসব ফার্মেসি চলছে অবৈধভাবে। এভাবে বাকি জেলাগুলোর অধিকাংশ ফার্মেসির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফার্মেসি চালাতে অবশ্যই সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু এসব কোন নিয়মই মানা হচ্ছে না। স্বল্প শিক্ষিতরা লাইসেন্স ও অনুমোদন ছাড়াই ফার্মেসি খুলে দেদার ওষুধ বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ। ফার্মেসির লাইসেন্স গ্রহণ ও পরিচালনার পূর্বশর্ত হলোÑ ফার্মেসি পরিচালনার জন্য বাধ্যতামূলক কমপক্ষে ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট থাকতে হবে। কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ফার্মেসিগুলো ন্যূনতম প্রশিক্ষণবিহীন কথিত ফার্মাসিস্টদের দিয়েই চলছে। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রাম-গঞ্জে অবৈধ ফার্মেসির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব ফার্মেসি চালাচ্ছেন স্বল্প শিক্ষিতরা। যাদের অধিকাংশেরই প্রশিক্ষণ এবং ফার্মেসির কোন লাইসেন্স নেই। রাজধানীতেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। বাংলাদেশ কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ জানান, দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধের দোকান চলছে অনুমোদনহীনভাবে। এগুলোতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এন্টিবায়েটিক, ঘুম ও নেশাজাতীয় ওষুধ। যত বেশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া যাবে অবৈধ ফার্মেসির সংখ্যা তত বেশি পাওয়া যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানান, একজন ওষুধ বিক্রেতার অবশ্যই ওষুধ সংরক্ষণ, মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ ওষুধ বিক্রেতারই এ সম্পর্কিত কোন জ্ঞান নেই। যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বিক্রেতারা ওষুধ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ফার্মেসিগুলোতে ট্রেড লাইসেন্স এবং ড্রাগ লাইসেন্স এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে সবাই দেখতে পায়। কিন্তু খুব কমসংখ্যক ফার্মেসিতেই এ নিয়ম মানতে দেখা যাচ্ছে। এদিকে নতুন ওষুধ আইন-২০১৪ প্রণয়নে হাত দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এ আইনের একটি খসড়াও তৈরি হয়ে গেছে। এ আইনে দেশের ওষুধ প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং বিভিন্ন ওষুধ শিল্প কারখানাগুলোর নিয়মকানুন যাচাই-বাছাই করে দেখার অধিকার দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত ওই আইনে দোকানে ওষুধ নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
×