ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

মহাখালী ফ্লাইওভারের কাছ থেকে হেঁটে এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে উত্তরা যাওয়া কি মুখের কথা! বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি তাই করলেন এবং জানালেন তার সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়াতে পারছেন না। ভদ্রলোক চল্লিশোর্ধ মানুষ। তার সাহসের প্রশংসা করি। আমার সাহস হলো না। তাছাড়া আমাকে যেতে হবে নিউ ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবন থেকে। তার মানে আরও কয়েক কিলোমিটার বেশি পথ। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে বোকা বনে গেলাম। রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। শত হাজার মানুষ রাস্তায় দুদিকে জোর কদমে হেঁটে চলেছেন। একটা দোতলা বাস ফার্মগেটের দিকে না গিয়ে বাঁদিকে পান্থপথে ঢুকে গেল। ভাবলাম সামনে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে ডবল ডেকার ভিন্ন পথ নিয়েছে। ভুল ভাঙল। বাসটি কোনাকুনি করে রাখা হলো। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ব্যারিকেড দেয়া হলো যাতে করে পান্থপথে কোন গাড়ি না ঢুকতে পারে। অগত্যা ধানম-ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। রাতে লালমাটিয়ায় নিকটাত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম। আমার না হয় একটা ব্যবস্থা হলো, কিন্তু উত্তরাগামী অন্যরা কী করবেন যাদের এদিকে থাকার কোন সুযোগ নেই! প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফিয়ের ওপর সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। তারা মিছিল ও বিক্ষোভ করেছেন, রাস্তায় অবরোধ দিয়েছেন। ভাবছিলাম, হাসপাতালে যাওয়ার মতো অনিবার্য প্রয়োজনে কত মানুষই না ঘর থেকে বেরিয়ে দুর্ভোগের শিকার হলেন। স্টুডেন্টরা দারুণ সফল, তারা স্থবির অচল করে দিতে পেরেছেন মূল ঢাকাকে। হরতালে-অবরোধে তবু কিছু গাড়ি চলে, রিক্সা চলে, আর ওদের অবরোধে ঢাকার রাজপথে কেবল মানুষ আর মানুষ। যেন হঠাৎ করেই বড় বড় রাস্তা সব ঘুরে বেড়ানোর মাঠে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে বিরোধিতার কর্মসূচী ব্যর্থ হয় না। এক অর্থে নেতিবাচক কর্মসূচী, মানে বিপুলসংখ্যক মানুষকে কষ্ট দিয়ে, তাদের জীবনযাত্রা অচল করে দিয়ে, অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে বেশ সফলতা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলা দরকার, এরা কোনদিন কেন মানবকল্যাণমুখী কোন আন্দোলন গড়ে তুলে দেশের মানুষকে চমকে দিতে পারলেন না। আগামীতে পারবেন? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও সেশন ফি যথেষ্ট উঁচু। বছর বছর তার পরিমাণও বেড়ে চলেছে। পাবলিক ও প্রাইভেটÑ উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনে বিপুল বৈষম্য। এসব নিয়ে শিক্ষার্থীরা সামান্য টুঁ শব্দ তো করেন না! ঢাকার ইংলিশ মিডয়াম স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদান করতে হচ্ছে বছরের পর বছর। এনিয়ে কখনই উচ্চবাচ্য শুনিনি। ভ্যাটের টাকা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই দিতে হয়, তাহলে স্কুল বা ইউনিভার্সিটি সর্বত্র একই নিয়ম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। রবিবার আবার রাজপথে নেমে আসার আগাম ঘোষণা দিয়ে রাখায় এ দফা ঢাকাবাসী অন্তত একটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তাছাড়া সন্ধ্যার আগে অবরোধ তুলে নেয়ায় ধীরে ধীরে ঢাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে। সোমবার এই লেখা প্রেসে যাওয়ার দিনও একই কর্মসূচী আছে ওই শিক্ষার্থীদের। হাতিরঝিল পাড়ি দেয়া হাতিরঝিল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর এলাকাটি রাজধানীবাসীর জন্য রীতিমতো গর্বের হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে রাতের বেলায় এর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মনে হতো ইউরোপের কোন শহরে বুঝি এসে পড়েছি। বছর না ঘুরতেই ঝিলের পানি দূষিত হতে শুরু করল। বলা ভাল, দূষণযুক্ত পানি এসে হাতিরঝিলে মিশে পরিবেশ কলুষিত করে ফেলল। এখন পয়ঃনিষ্কাশনের নর্দমার সঙ্গে হাতিরঝিলের সংযোগ ঘটায় সেখানে দুর্গন্ধে টেকা দায়। নাক বুজে রেখে কতক্ষণ আর সৌন্দর্য অবলোকন করা সম্ভব। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে না! যা হোক, চটজলদি গন্তব্যে পৌঁছুনোর জন্য হাতিরঝিল পাড়ি দেয়ার সুবিধা নিয়ে থাকেন পূর্বদিকে মগবাজার, কারওয়ানবাজার পশ্চিমে রামপুরা গুলশান-বারিধারাগামী লোকজন। তবে হাতিরঝিলও যে যানজটমুক্ত নয়, এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম রমজানে। পাক্কা দেড় ঘণ্টা আটকেছিলাম হাতিরঝিলে, ঢাকাক্লাবের ইফতার পার্টিতে সময়মতো পৌঁছুতে পারিনি। তবে বছরের অন্য সময় অন্য হিসাব। অতটা জট লাগে না যানবাহনের। হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলার নিয়ম নেই। কোরবানি ঈদের পরে একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কিছু বাস চালানোর কথা রয়েছে। যদিও বছরখানেক আগে থেকেই এখানে বেশকিছু মাইক্রোবাসে করে যাত্রী পারাপার করা হয়ে আসছিল। পুলিশের সামনেই এই অবৈধ যাতায়াত চলছিল। গত সপ্তাহে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ আকস্মিকভাবে হাতিরঝিলে অভিযান চালিয়ে মাইক্রোবাসে অবৈধভাবে যাত্রী পারাপার বন্ধ করে দেয়। কুড়িটির মতো মাইক্রোবাস জব্দ করে পুলিশ। তাই এখন থেকে হাতিরঝিলে আর অবৈধ পারাপার নয়। এতে বহু সাধারণ মানুষের সাময়িক অসুবিধা হলো সন্দেহ নেই। আসন্ন ঈদের পর বাস চালু হলে আবার তারা হাতিরঝিল পাড়ি দিতে পারবেন। বৈধ উপায়েই। বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র ঈদে বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র হলো বাসের টিকেট। দুই ঈদে ঢাকা ফাঁকা করে লাখো মানুষ দেশের বাড়ি যায়। লাখো বললে কত লাখ তা কি বোঝা যায়? যায় না। একটা হিসাব পাওয়া গেল, তাতে দেখা যাচ্ছে ঈদ উপলক্ষে ঢাকাত্যাগকারী বাসের যাত্রীর সংখ্যা একুশ লাখ। বাস ছাড়া ঈদে ঢাকা ত্যাগের আরও পথও রয়েছে। জলপথ, বিমানপথ, রেলপথ। তবে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাসই উত্তম পন্থা। গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়ে ঈদ উপলক্ষে বাসের টিকেট বিক্রি শুরু হলে যথারীতি ঢাকাবাসীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যারা বাড়ি ফেরার টিকেট পাননি তাদের মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমত তাদের মন ভেঙে গেছে। যদিও এর বড় অংশই মন জোড়া লাগিয়ে ভিন্ন উপায়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই চেষ্টায় যে শতকরা একশ ভাগ মানুষ সফল হবেন না, সে তো জানা কথাই। ঈদে সরকারী ছুটি তিন দিন। অনেকেই বাড়তি ছুটি নেন। কিন্তু ঈদের দিনটিতে দেশের বাড়িতে সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাইলে ঈদের আগেই বাড়ি পৌঁছুতে হবে। সেটাই আসল কথা। যানবাহনের সংখ্যা বাড়ালে কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? রাস্তা তো আর চওড়া হবে না। তার ধারণক্ষমতা নির্দিষ্ট। তাহলে উপায় কি? এর উত্তর আমাদের খুঁজে বের করা দরকার। রাজপথ থেকে ফেসবুক থেকে ঢাকার কড়চা তুলে ধরা হয় কখনও কখনও এ কলামে। এবারে শেয়ার করছি তরুণ লেখক সুমন্ত আসলামের পোস্ট। উপার্জনের জন্য ঢাকার বিচিত্র মানুষ বিচিত্র পেশা বেছে নিচ্ছে। তারই একটি উদাহরণ এই পোস্টে মিলবে। পোস্টে লেখা হয়েছে: ‘ফার্মগেটের ওভারব্রিজের পূর্বপাশে ভিড় দেখেই ঘুরে দাঁড়ালাম। কাছে গিয়ে দেখি মাঝবয়সী এক লোক ইট খাচ্ছেন। তার সামনে বেশ কয়েকটি বড় বড় ইটের টুকরো, নরম ইটের টুকরো। ইটগুলো তিনি এমনভাবে খাচ্ছেন যেন এর চেয়ে সুস্বাদু আর কোন খাবার নেই পৃথিবীতে। পাশে দাঁড়ানো এক ট্রাফিক পুলিশ ছবি তুলছেন মোবাইলে। ভিড় বাড়ছে একটু একটু করে। মানুষটার মুখের দিকে তাকালাম আমি। এক টুকরো ইট তিনি অনেকক্ষণ ধরে চিবোচ্ছেন। ঠোঁটের কোনা দিয়ে রসও বের হয়ে এসেছে সামান্য। কিন্তু তিনি কারও চোখ কিংবা মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। সাধারণত অপরাধীরা অন্যের চোখের দিকে তাকায় না। আরও একটু পর... ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ একজন একটা পাঁচ টাকার নোট ছুড়ে দিল মানুষটার সামনে। তারপর আরেকজন আরও একটা দু’টাকার নোট। সাত-আট মিনিটে ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা। খারাপ না। বিত্তবান হওয়ার জন্য মানুষ ঘুষ খায়, ছিনতাই করে, চুরি করে। আর সাধারণ ওই মানুষটা না হয় ইট খাওয়ার অভিনয় করছেন, কারও ওপর জোর করে তো আর টাকা কামাই করছেন না। আহারে, প্রস্ফুটিত করার জন্য এক জীবনে মানুষ কত কিছুই না করে! কতকিছু করতে হয় তাকে!’ কৃতী নারীর স্বীকৃতি সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য নারীদের সম্মানিত করে আসছে নারীবিষয়ক পত্রিকা অনন্যা। পুরস্কার প্রদানে ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে এ আয়োজনের একটি ইতিবাচক অবয়বও গড়ে উঠেছে সমাজে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শনিবার অনন্যার এই অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। তবে চোখ রেখেছি অনলাইনে, ফেসবুকে খবর জানার জন্য। সম্মাননাপ্রাপ্ত কেউ অনুষ্ঠানের ছবি স্বল্পসময়ের ভেতর আপলোড করবেন- এটা সত্যি ভাবিনি। ছবিগুলো দেখে টাটকা ধারণা পাওয়া গেল অনুষ্ঠানের আবহ সম্পর্কে। অনুষ্ঠানে ১৯৯৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ২১০ জন সম্মাননাপ্রাপ্তকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এবারের অনুষ্ঠানটি ছিল সম্মাননাপ্রাপ্তদের পুনর্মিলনী। সাধারণত ‘অনন্যা শীর্ষ দশ’ সম্মাননা নামের এই অনুষ্ঠানে দশ কীর্তিমতীকেই সম্মান জানানো হয়। এবারে একাদশ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মাননা জানানো হলো অনন্যা পত্রিকারই প্রাক্তন নির্বাহী সম্পাদক এবং নারী আন্দোলনের কর্মী দিল মনোয়ারা মনুকে। এই স্বীকৃতিটুকু তাঁর পরিচিত বহুজনকে নিশ্চয়ই আপ্লুত করবে। ঢাকার অতিথি অনিন্দিতা কাজী ইদানীং ঢাকায় বেশ ঘন ঘন আসছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি অনিন্দিতা কাজী। দাদুর গান করেন, দাদুর কবিতাও পড়েন। কলকাতার একটি প্রাইভেট চ্যানেলের উঁচু পদে আছেন। ঢাকায় অনিন্দিতা নামে নজরুল সঙ্গীতের শিল্পী আছেন একজন। সাধকধর্মী শিল্পী। দু’সপ্তাহ আগে নজরুলের নাতনি ভেবেই তাঁর গান শুনতে ছুটে গিয়েছিলাম ডেইলি স্টার ভবনে। পরে দেখি ভিন্ন অনিন্দিতা। ইনি অনিন্দিতা চৌধুরী। তাই শুক্রবার অনিন্দিতা কাজী আবৃত্তি ও গান করবেন জানতে পেরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যেতে আর ভুল করিনি। অনিন্দিতা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল- বাংলা কবিতা ও গানের দুই দিকপালের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দুজনের রচনায় উভয়ের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। সে গবেষণারই রসময় কিছু নিদর্শন পাওয়া গেল অনুষ্ঠানে। ‘খামখেয়ালি সভার আড্ডা’ নামের এই অনুষ্ঠানে আড্ডার মেজাজও ধরা ছিল পুরোপুরি। অনিন্দিতাকে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপক বলেই মনে হলো। তাঁর কথা শুনতে শুনতে চোখ না বুজেও দেখতে পাচ্ছিলাম রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে আলিঙ্গনে বাঁধছেন তাঁর কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি শুনে। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ [email protected]
×