ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

আয়লানকে কেন্দ্র করে সভ্যতা রক্ষার শেষ যুদ্ধ!

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আয়লানকে কেন্দ্র করে সভ্যতা রক্ষার শেষ যুদ্ধ!

শিশু আয়লানকে সমুদ্র তীরে ঘুমিয়ে থাকার মতো হৃদয় ভগ্নকারী ছবিটি সংবাদপত্রে দেখে বহুদিন পর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললাম। এ কান্নাকে বন্ধ করতে পারছিলাম না, এত ফুটফুটে অবোধ শিশুটি মানুষের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কিছুই না বুঝে লাল টুকটুকে টি-শার্ট, নীল প্যান্ট, জুতো-মোজা পরে কেন, কোথায় বাবা, মা, ভাইটিসহ তাকে নিয়ে নৌকায় উঠেছে, সেসব না জেনে চিরতরে চলে গেল এ নিষ্ঠুর নির্দয় পৃথিবী থেকে, স্বদেশ থেকে! এবং সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে আসা তার প্রাণহীন সুন্দর দেহটি বড় মমতায় একজন পুলিশ কোলে তুলছে- সে জানে না এ ছবিটি কঠিন, বিমুখ পৃথিবীর লাখো মানুষকে মানবতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাতারাতি আকস্মিকভাবে মমতাময়ী মায়ের মতো হয়ে উঠল। হায়! মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংসকারী আইএস জঙ্গীদের শত ধিক! তাদের আগে পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানে, বর্তমানে সিরিয়া, ইয়েমেনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর যে বর্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে, তার লক্ষ্য ছিল একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিস্তার রোধ করা, অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ গ্রাস করা। পশ্চিমাদের এ উদ্দেশ্য দুটি আফগানিস্তানে তালেবান-আল কায়েদার ক্ষমতা দখল এবং পরে সাদ্দাম, গাদ্দাফী হত্যার পর মিসর, ইয়েমেনী সেনাশাসকদের ক্ষমতাচ্যুতির পর বেশ কিছুটা সফল হয়েছিল। তবে সেই সঙ্গে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, সাদ্দাম অনুগত, গাদ্দাফী অনুগত বাহিনীর সদস্যরা কি ওই অন্যায় যুদ্ধে, মানবতার ধ্বজাধারীরা যে নিষ্ঠুর বর্বর পন্থায় সাদ্দাম, গাদ্দাফীকে হত্যা করেছিল, লাখো নিরপরাধ আরব নারী, পুরুষ, শিশুকে যে অন্যায় বোমা হামলায় হত্যা করা হয়েছিল, সেসব অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে একটি ভয়ঙ্কর বর্বর দলের জন্ম দেবে না?Ñ এটা তো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আরেকটা বড় অন্যায়ে আরবরা কিছুতেই দশকের পর দশক নানা পন্থায় চেষ্টা করেও যখন একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি ষাট-সত্তর বছর পরও, তখন কেন ওই মধ্যপ্রাচ্যেই পশ্চিমাবিরোধী বর্বর, নিষ্ঠুর গোষ্ঠীর উত্থান হবে না? হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? মধ্যপ্রাচ্যের আরব সর্দারদের কাছ থেকে পশ্চিমারা যুদ্ধবিমান পরিচালনার স্থান লাভ করে। অথচ তারাই রক্তচক্ষুর সাহায্যে এই কম্পিউটার যুগেও নারীদের গৃহবন্দী রাখে। এই মাত্র ক’দিন আগে আরব নারীদের ভোটদানের অধিকার দিয়েছে। বর্তমানে সিরিয়ানরা প্রেসিডেন্ট বাশার ও আইএস জঙ্গী, যারা বাশারবিরোধী সুন্নি জঙ্গী তাদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধাবস্থা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে ইউরোপে প্রবেশ করছে লাখো সিরীয় উদ্বাস্তু, যেমন এক কোটি বাঙালী নারী-পুরুষ, শিশু ’৭১-এর যুদ্ধের সময় ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করেছিল। যে কোন যুদ্ধাক্রান্ত দেশ থেকে মানুষ উদ্বাস্তু হবে, এটা স্বাভাবিক। তবে মধ্যপ্রাচ্যকে ল-ভ- করে নতুন সীমানা টেনে নতুন মানচিত্র গড়ার যে পরিকল্পনা পেন্টাগন, সিআইএ ও যুক্তরাষ্ট্রের আছে, বর্তমানে উদ্বাস্তু আরবদের মানবেতর অবস্থার দায়ভারের সিংহভাগ সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। স্মরণ করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক সরকার উচ্ছেদের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তালেবান, আল কায়েদা এবং লাদেনের জন্ম দিয়েছিল। এর ফলে শুধু আফগানিস্তানেই জঙ্গী-জেহাদীদের স্থান হয়নি, এদের শাখা-প্রশাখা পাকিস্তানেও জন্মলাভ করেছে, যারা এখন এই দুটি দেশের শান্তি, জানমাল, রাষ্ট্রের অবকাঠামো, প্রশাসনÑ সবকিছুই ধ্বংস করে চলেছে। এসব যুদ্ধে জিহাদী-জঙ্গীদের সুইসাইড বোমা হামলায় এ অঞ্চলে লাখ লাখ আফগানী, পাকিস্তানী, আরব নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়েছে এবং হচ্ছে। তারপরও এ যুদ্ধ, এ বোমা হামলা, ড্রোন হামলা অব্যাহত আছে। জঙ্গী যত মারা যায়, তার চেয়ে অনেক গুণ মারা যায় নিরীহ বেসামরিক নাগরিক, নারী ও শিশু। ইরাক যুদ্ধ শুরুর সেই সময়ে আমরা এ যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে যখন ঢাকার রাজপথে বিশাল বিশাল সমাবেশ করেছি, ইউরোপসহ সব দেশে আসন্ন ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শান্তিকামী মানুষ রাজপথে নেমেছে, তখনও বিশ্ব জনমতের চাপে প্রেসিডেন্ট বুশ, ডিক চেনী, রামসফিল্ডরা বিচলিত হয়নি! হাজার হাজার ফুটফুটে শিশুর মৃতদেহ দেখে, ক্রন্দনরত এতিম শিশুদের দেখে কেঁদেছিলাম এবং সে সময়ে নেদারল্যান্ডসের টিম লিডারের সঙ্গে গবেষণার কাজ করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, ‘আমি শিশুদের এ ক্রন্দন সইতে পারছি না, আমি ইরাকী ওই এতিম শিশুদের মায়ের আদর দেব, প্লিজ আমাকে যাওয়ার সুযোগ করে দাও, এসব কাজ করে কী হবে?’ ও বলেছিল, ‘ওখানে তুমি বিশেষ কিছু করতে পারবে না, কঠিন কষ্টকর যুদ্ধাক্রান্ত ওই জায়গায় ভাষা না জেনে সমস্যা হবে, চাইলেও অনেক সময় অনেক কাজ করা সম্ভব হয় না। তুমি তোমার দেশেই কাজ কর শিশু ও মায়েদের জন্য।’ এর আগে ইসরায়েলী বোমা হামলায় প্যালেস্টাইনী ক্যাম্পগুলো গুঁড়িয়ে দেয়ার সময় ফুটফুটে শিশুগুলোকে সেবা দেয়ার জন্য প্রাণ কেঁদেছিল। এখনও আয়লানদের বাঁচাতে, আদর দিতে প্রাণ কাঁদছে! আবেগ দূরে সরিয়ে যে কথা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, কেন মানবতা এভাবে নিরপরাধ মানুষকে এক মুহূর্তে লাশে পরিণত করছে? এক মুহূর্তে লাখ লাখ শিশুকে তাদের জীবনের একমাত্র আশ্রয় মা-বাবাকে হারিয়ে এতিমে পরিণত করছে? এই অর্থহীন কতিপয় উন্মাদের যুদ্ধোন্মাদনার ফলে ক্ষতিগ্রস্তের ক্ষোভ, ক্রোধ জন্ম দিচ্ছে জঙ্গী, জিহাদী যারা হত্যার নেশায়, ধর্ষণের নেশায় উন্মাদ! যারা ধ্বংস করছে মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক কীর্তি এবং অবলীলায় পশ্চিমা, আরব ত্রাণকর্মী-সাংবাদিক ও মুসলিম শিয়াদের গলা কেটে হত্যা করছে। স্মরণে পড়ছে, মার কাছে ছোটবেলায় গল্প শুনতে শুনতে শুনেছিলাম পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সময়ে একজন জালেম বের হবে, সে যাকে ইচ্ছা তাকে হত্যা করবে, ধ্বংস করবে চারদিক। এ কাহিনী শুনে ভীষণ ভীত হয়েছিলাম, কখন সেই জালেমের আবির্ভাব ঘটবে! আফগানিস্তানে লাদেন ও তালেবানের রূপে আবির্ভূত হয়েছিল কি সেই জালেম? আবার বুশ-চেনীর রূপে ইরাক, লিবিয়া, মিসর, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেনে ওই জালেম আবির্ভূত হয়েছিল কি? ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্র্রেলিয়া এবারকার উদ্বাস্তু সিরিয়ানদের মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছে, যা তাদের অভিবাসী উদ্বাস্তুদের একজন, ফুটফুটে শিশু আয়লানের নিষ্প্রাণ দেহ দেখার পর পরই তাদেরই উদ্ভাবিত মানবতার দাবিকে উস্কে দিয়েছে। প্রথম বৈশিষ্ট্যÑ এই সিরীয়রা অধিকাংশই কুর্দি জাতিসত্তার অন্তর্গত, যারা জঙ্গী-জিহাদী আইএস দ্বারা হত্যার শিকার ও গৃহহারা হয়েছে এবং যারা একেবারেই পশ্চিমাবিরোধী জঙ্গীদের বিপরীতে অবস্থান করে। দ্বিতীয়ত, আয়লানসহ এই কুর্দি শিশুরা দেখতে একেবারেই ককেশীয় ইউরোপীয় শিশুদের মতো, যারা অতি সহজে ইউরোপের কাছে আদরনীয় হতে পেরেছে। এর বাইরের কারণ, জার্মানির যে বিপুল শ্রমিক প্রয়োজন তারা যদি গায়ের রঙে, দৈহিক গঠনে জার্মানদের কাছাকাছি হয়, তাহলে তারা অবশ্যই ভিন্ন রঙ ও গঠনের আফ্রিকান ও এশিয়ানদের চেয়ে ইউরোপের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরাও তো ফুটফুটে আয়লান, সিরীয় শিশু অভিবাসীদের দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু অপরদিকে অভিবাসীরা বলছে, ‘আমরা আগামী দিনে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই, অন্য দেশে থাকতে চাই না।’ এমন হতেও পারে, এই প্রবাসীদের মধ্যেই সিরিয়া-ইরাকের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে উঠবে, যারা সম্ভবত ইউরোপ-আমেরিকার সহায়তায় জঙ্গী উৎখাতে আমাদের মতোই এক হানাদার খুনী বাহিনীর সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে লড়াইয়ে নিয়োজিত হবে। হয়ত আইএস দমনে কুর্দি ও আরবরা ঐক্যবদ্ধ হবে, প্রগতিবাদী সুন্নিরাও বর্বর, কট্টর আইএসকে পরাস্ত করতে কুর্দিদের সঙ্গে হাত মেলাবে। কেননা, আইএস পুরোপুরি ’৭১-এর আলবদরের মতোই, বর্তমানের জামায়াত-শিবির, আনসারুল্লাহ, হামজা ব্রিগেডের মতোই উদার, সেক্যুলার, প্রগতিশীল লেখক, কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিচারক, সাংবাদিক, শিল্পী, রাজনীতিকদের মুরতাদ ও হত্যাযোগ্য ঘোষণা দিয়েছে এবং সে হত্যার কাজটি অবিচলিতভাবে কার্যকর করে চলেছে। আইএস বা আল কায়েদার বিভিন্ন শাখা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিস্তার লাভ করে সেসব দেশেও যে বর্বরতার পরিচয় দিচ্ছে, তাদের মধ্যে আল শাবাব ও বোকো হারামের মতো জঙ্গীগোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলোর জনগণ ও সরকারও আইএসবিরোধী ফ্রন্টে যোগ দেবেÑ এতে সন্দেহ নেই। সব রকম সম্ভাবনার যোগফল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতোই একটি মিত্রবাহিনী গড়ে ওঠার পটভূমি দেখা দিয়েছে। কেননা, এই মুহূর্তে পৃথিবীর জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি সর্বোপরি মানবতার মূল্যবোধ আজ আইএসের হাতে যেভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তার একমাত্র উদাহরণ জার্মানিতে হিটলারের উত্থান! হিটলার ও নাজী বাহিনীকে পরাজিত করতে ওই সময় যেমন সোভিয়েত রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স মিলে মিত্রবাহিনী গঠন করে ‘ফল অব বার্লিন’ সম্পন্ন করেছিল, এখন সময়ের দাবি, গৃহহারা অভিবাসী উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যা এবং আইএসের চরম বর্বরতা তেমনই যেন একটি মহাযুদ্ধের প্রয়োজনকেই সামনে নিয়ে এসেছে। এটা ঠিক যে, আমরা মানবিক, উদার ধারার পক্ষের শক্তি যুদ্ধকে পরিত্যজ্য মনে করি। কিন্তু যখন বর্বর, খুনী পিশাচদের শায়েস্তা করে উৎখাত করার প্রয়োজন পড়ে, তখন যেমন আমরা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তখন যেমন যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না, তখন যুদ্ধই হয় কাক্সিক্ষত, যে যুদ্ধ মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে। মাতৃভূমির মুক্তির জন্য এমন এক যুদ্ধের প্রয়োজনে সিরীয়, ইরাকী, কুর্দি, শিয়া, ইয়াজিদী সম্প্রদায় পুরো বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে। একটি বড় যুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত বোধ হয় এ যুগের নাজী-আইএস, তালেবান, আল কায়েদা, বোকো হারামের হিংস্র দলগুলোকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হবে না। একটি যুদ্ধ দেখা যাচ্ছে আরেকটি যুদ্ধের বীজ বপন করে। আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং মধ্যপ্রাচ্যে বুশের যুদ্ধ শুরু করার মধ্যেই আজকের আইএস, তালেবান, আল কায়েদার জন্ম ঘটেছিল। এখন এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে মারার জন্য আরেকটি যুদ্ধ লড়তে আবার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার দেশগুলো মিলে একটি মিত্রবাহিনী গড়ে তুলবে। এরপর আইএস, আল কায়েদাদের নির্মূল করা সম্ভব হবেÑ বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক
×