ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

পরিবেশবান্ধব ‘স্বর্ণসূত্র’ ফ্যাশনে সম্ভাবনা...

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

পরিবেশবান্ধব ‘স্বর্ণসূত্র’ ফ্যাশনে সম্ভাবনা...

এক দশক আগেও কারও মুখে শোনা যেত না যে দড়ি, কার্পেট, বস্তা এগুলোর বাইরেও পাট উপকারে লাগতে পারে। প্রাকৃতিক এই তন্তুটি এখন ফ্যাশন, বিলাস ও স্বস্তিদায়ক সব পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। তবে এদেশে ‘স্বর্ণসূত্র’ খ্যাত পাটের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কোন শেষ নাই। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রফতানি কমে যাওয়ায় পাটের বাজারে মন্দাভাব দেখা দিলেও ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই অবস্থার যে পরিবর্তন ঘটবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞজনেরা অত্যন্ত আশাবাদী। বছর কয়েক আগে পাটের বাজার ছিল বেশ তেজী। তাতে এদেশের পাটচাষীরাও আশান্বিত হয়ে পাটচাষে কিছুটা মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। বর্তমানের মন্দাবাজার পাটচাষীদের হতাশ করলেও বিশেষজ্ঞজনেরা মনে করে পাটের হারানো গৌরব দ্রুত ফিরে আসবে এবং তা চাষীদের মুখে হাসি ফোটাবে। উন্নয়নশীল ও উন্নত অনেক দেশ দেরিতে হলেও অনুধাবন করছে যে, পরিবেশের জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০১৬ থেকে সারা ইউরোপে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এ জাতীয় অনুপ্রেরণা থেকে অনেক দেশ এখন সবুজ পণ্যকেই টেকসই ও লাভজনক মনে করছে। আর এ জাতীয় পণ্য হিসাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাটের নামই বার বার উচ্চারিত হচ্ছে। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, অদূর ভবিষ্যতে পাটই হতে পারে পরিবেশবান্ধব পণ্যের আলোকবর্তিকা। বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের দেশ বলা হয়। আমাদের দেশের সোনালি আঁশ অর্থাৎ পাটের মান অন্যান্য দেশের চেয়ে উন্নত। পাট থেকে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা যেতে পারে অন্যদিকে বিভিন্ন শৌখিন পণ্যও তৈরি করা যেতে পারে। পাট থেকে সাধারণত চট তৈরি করা হয়। এই চট বিভিন্ন আকৃতিতে কেটে নিয়ে সেলাই ও নকশা করে নানা ধরনের শৌখিন পণ্য যেমন- ব্যাগ, ম্যাট, কলমদানী, পাপোশ ইত্যাদি তৈরি করা যায়। এগুলোকেই পাটজাত হস্তশিল্প বলা হয়। পাট থেকে কত ধরনের পণ্য তৈরি করা যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ জুট রিচার্স ইনস্টিটিউটে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। জানা যায়, জামা-কাপড়, কম্বল, ঘরের পর্দা, শাড়ি এমনকি চেয়ার-টেবিলসহ মানুষের ব্যবহার্য অনেক পণ্যই পাট দিয়ে বানানো সম্ভব। তাছাড়া জুট জিও টেক্সটাইল, জুটনসহ পাটের ঢেউটিন জাতীয় এমন কিছু পণ্য উদ্ভাবন করা হয়েছে যার ব্যবহার ও রফতানির মাধ্যমে দেশ উপকৃত হবে। পাট দিয়ে নানা খেলার সামগ্রী ছাড়াও নির্মাণ করা যায় গৃহস্থালি সামগ্রীসহ প্রাইভেটকারের বডিও। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, পুরকৌশলের বিভিন্ন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে পাহাড়ধস, নদী ভাঙ্গন ও রাস্তার ক্ষয় রোধে পাটের ব্যবহার পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আনতে পারে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ফ্যাশন অনুষঙ্গ ও লাইফস্টাইল পণ্যের বাজারও উর্ধমুখী। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বাজারে নারীদের এক্সেসরিজ বিক্রি হয়েছে ২৯ বিলিয়ন ডলারের, যার মধ্যে ফ্যাশনেবল ব্যাগই বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের। তৈরি পোশাক পণ্যের বাজারে ধীরগতির প্রবণতার কারণে ডিজাইনাররা লাইফস্টাইল ও ফ্যাশন এক্সেসরিজের দিকে ঝুঁকছেন। বিভিন্ন ধরনের শপিং ও লাইফস্টাইল ব্যাগ, প্রমোশনাল আইটেম ও প্যাকেজিং ব্যাগের চাহিদা বাড়ছে। এক্ষেত্রে জুট ফেব্রিক থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট ডেভেলপ করে এই বাজারে জুটের একটি শক্তিশালী বাজার উন্নয়ন করা সম্ভব। পাটের ব্যাগের চলটা বেশ পুরনো। তবে সময়ের সঙ্গে এর নকশায় এসেছে পরিবর্তন। নানা রং আর রঙের এমবোস, হ্যান্ডপ্রিন্টের নকশা করা হচ্ছে। পাটের তৈরি ব্যাগ আরেকটু জাঁকালো করতে কড়ি, পুঁতি, বোতাম, চামড়া এমনকি এর ওপর কাপড়ের নকশাও করা হয়। এ ব্যাগ দেখতে যেমন নান্দনিক, তেমনি ব্যবহারও আরামদায়ক। পাট ও পাটজাত দ্রব্য দিয়ে তৈরি হলেও ব্যাগের আকার ও রঙে ভিন্নতা আছে। কালো, কমলা, হলুদ, সবুজ, অফহোয়াইট রঙের ব্যাগের কোনটিতে একাধিক পকেট, আবার কোনটি পকেটবিহীন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অফিসে পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে এ ব্যাগ। পাটের ব্যাগগুলো এত হাল্কা যে চাইলে ভাঁজ করে ছোট হাতব্যাগে রাখতে পারবেন। আবার প্রয়োজন অনুযায়ী খুলে ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া পাটের ব্যাগ বাহারি রঙের হওয়ায় চাইলে পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা যায়। আকারের পাটের ব্যাগ বিভিন্ন বয়সের মানুষ অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারে। সরকারের রফতানি নীতিতে বহুমুখী পাটপণ্য উপখাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে এ খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের উদ্যোক্তাদের একটি প্রতিযোগী অবস্থান থেকে আমরা সক্ষমতা অর্জনে এগিয়ে যেতে পারি। এ খাতকে শুধু কুটির শিল্পের আওতায় চিন্তা না করে, এই শিল্প কিভাবে মধ্যম ও বৃহৎ শিল্প হিসেবে বিকশিত হতে পারে, সেই ক্ষেত্রে বিশেষায়িত খাত হিসেবে সরকার থেকে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া একদল উদ্যোক্তা তৈরিসহ আন্তর্জাতিক বাজারের ডিমান্ড অনুযায়ী ‘প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট’-এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সেইসঙ্গে মানব সম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
×