ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিক অপু

অকারণে সন্দেহ নয়

প্রকাশিত: ০৮:১৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

অকারণে সন্দেহ নয়

পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে করেছিলেন ভালবাসার মানুষটিকে। সংসার জীবন ভালই কাটছিল রায়হান দম্পতির। আট বছরের একটি ছেলেও রয়েছে তাদের। রায়হান সাহেবের বয়স ৪৫ এবং তার স্ত্রী স্বপ্নার বয়স ৪০। দু’জনই নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত। স্মার্ট দম্পতি বলতে যা বোঝায় তাদের মধ্যে সেসব গুণ বিদ্যমান। কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন যেন একটা ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠল সংসারে। একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে সন্দেহ। এই সন্দেহই সৃষ্টি করে কলহের। কারণে-অকারণে ঝগড়া হতে থাকে তাদের। এমনই এক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় আলাদা হয়ে যাওয়ার। কিন্তু সন্তানকে কেউ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। যে কারণে সব সিদ্ধান্ত আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়ে তারা রায়ের অপেক্ষা করতে থাকে। অবসান ঘটে একটি ছোট্ট সুন্দর পরিবারের। মজার বিষয় হচ্ছে, কি কারণে রায়হান দম্পতি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে তা তারা কেউই আদালতে সুস্পষ্ট করতে পারেনি। শুধু বলেছে, এভাবে প্রতিদিন ঝগড়া করে জীবন কাটানো অসম্ভব তাই তারা আলাদা হতে চায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এ কথা সত্য, আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা রীতিমতো ভাবনার খোরাক। একটা সময় ছিল যখন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি ছিল। কারণ হুজুগের বশবর্তী হয়ে নিজের জেদ ঠিক রাখতে তারা একে অপরকে ডিভোর্স দিত। কিন্তু চল্লিশোর্ধ বয়সী লোকজন যখন এ ধরনের কাজ করে তখন তা ভাবনারই বিষয় বটে। তাছাড়া তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমাজে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। তাদের সন্তানরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। কিন্তু ঘটনা তদন্তে দেখা দেয় হাতেগোনা কয়েকটি কেস শুধু বড় ধরনের ঘটনা ঘটার কারণে ডিভোর্স হয় বাকি সবই তুচ্ছ সব ঘটনা নিয়ে। তবে মানসিক বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে বেশ কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। তাদের ধারণা মতে, বয়সসীমার এ পর্যায়ে এক ধরনের মেন্টাল ডিজঅর্ডারনেস কাজ করে। ব্যক্তিভেদে একেকজনের একেক রকম হলেও কমন কিছু সমস্যা প্রায় সবার মধ্যেই বিদ্যমান। আর তা হচ্ছে বয়স ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় অর্থাৎ যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ভয়। এসব চিন্তা যারা প্রাধান্য দেয় তারা তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যায়। নিজেদের গুটিয়ে রাখে। কোন রকম পার্টিতে এ্যাটেন্ড করে না। আর এ ধরনের ভাবনা থেকেই নিজের অজান্তেই এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করে ফেলে, যা তাকে সংসার জীবনের প্রতি মায়া কমিয়ে দেয়। দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের এক গবেষণায় কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ গবেষণার জন্য চল্লিশোর্ধ এক হাজার ১০০ নারী-পুরুষের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে এক-তৃতীয়াংশ নারী বৃদ্ধ বয়সে তাদের কেমন দেখাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে ২১ শতাংশ পুরুষ এ নিয়ে ভাবে। আর শতকরা ৩২ ভাগ পুরুষ ও ১২ ভাগ নারী বৃদ্ধ বয়সে তাদের যৌন জীবন কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তা করে। এ গবেষণায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে বয়সসীমা চল্লিশ ক্রস করলেই মানুষের মধ্যে যৌনজীবন ব্যাপক একটা প্রভাব বিস্তার করে। এমনও ঘটনা ঘটেছে স্বামী বা স্ত্রী এ সময়টায় তাদের মধ্যে নিজের অজান্তেই দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলে। একসঙ্গে রাত্রি যাপনেও অনীহা তৈরি হয়। উভয়ই মনে করে সেক্সুয়ালি বুঝি তারা আনফিট। আর এটা যেন প্রকাশ না পায় সে কারণে একে অপরের কাছ থেকে লুকিয়ে বেড়ায়। আর এ লুকোচুরি থেকেই সৃষ্টি হয় সন্দেহের। স্বামীর মনে ধারণা হয় স্ত্রী বুঝি তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে আর স্ত্রীর ধারণা স্বামী বুঝি পর-নারীতে আসক্ত হয়েছে। কিন্তু কেউ কাউকে স্পষ্ট করে কিছু বলে না। যার ফলে নিজ নিজ সন্দেহে অটুট থেকে সৃষ্টি করে অস্বস্তিকর পরিবেশের। একপর্যায়ে পথ খুঁজতে থাকে এ পরিবেশ থেকে বের হওয়ার। আর সে পথ হচ্ছে ডিভোর্স। অথচ কেউ জানলও না কি তাদের অপরাধ। নিরাপরাধ হয়ে অপরাধীর কাঠ গড়ায় দাঁড়ায় তারা। এটা কখনই সঠিক সমাধান হতে পারে না। এ সম্পর্কে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউশনের সহকারী অধ্যাপক ড. জহির উদ্দিন বলেন, কনজিউমার লাইফ নিয়ে এখনও আমাদের দেশের মানুষ খোলামেলা আলোচনা করতে অভ্যস্ত হয়নি। অর্থাৎ এক্সপার্টদের কাছে গিয়ে নিজের মনের সমস্যা বলে সলুউশন নেয়াতে অভ্যস্ত হয়নি। যার ফলে দেখা গেছে মনের মধ্যেই কথা চাপা রেখে এক ধরনের অস্বস্তিতে ভোগে। আবার অনেকে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে শেয়ার করে ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ফলে ঘটনাটি হিতে বিপরীত হয়। মানুষ যে কোন সময়ে মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে পারে। এর সমাধানও রয়েছে। সমাধান খুঁজে পেলে মানসিক শান্তি ফিরে আসবে। অথচ এই সহজ ব্যবস্থাকে আমরা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আরও জটিল করে তুলি। আমাদের এখান থেকে কাউন্সিলিং করে অনেকেই সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছে। অবশ্য এর জন্য সচেতনতারও প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারগুলো যত বেশি মানুষকে বোঝানো যাবে তত বেশি তারা আশ্বস্ত হবে। দাম্পত্য জীবনকে শুধু সেক্সুয়াল লাইফ হিসেবে ট্রিট করলে হবে না। এখানে অনেক বেশি শেয়ারিং এবং কেয়ারিংয়ের ব্যাপার রয়েছে। একে অন্যকে ভালভাবে বুঝতে হবে, প্রয়োজনে নিজেকে এমনভাবে মেলে ধরতে হবে যাতে পার্টনার সহজেই বুঝে নিতে পারে। বিয়ে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমেও জীবনকে সাজিয়ে নেয়া যেতে পারে। বিবাহিত জীবনে অনেকেই একটা পর্যায় গিয়ে সেক্সুয়াল লাইফ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে, যা তার অন্যান্য চিন্তা শক্তিকে নাশ করে। অথচ এ চিন্তাটি কখনই বড় করে দেখার কিছু নেই। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই মানুষের বেড়ে ওঠা। একেক স্টেজে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ একেক রকম হবে এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে মুষড়ে পড়ার কিছু নেই। তাছাড়া মেডিক্যাল সায়েন্স এখন অনেক বেশি আপগ্রেড। যে কোন সমস্যার সমাধান এক্সপার্টদের সঙ্গে আলোচনা করলেই পাওয়া সম্ভব। এসব নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমরা অনেকেই নিজেদের সচেতন মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। তার পরেও দেখা গেছে, মানসিক সমস্যা কিংবা শারীরিক কিছু সেনসেটিভ সমস্যা নিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে অনীহা প্রকাশ করি, যা মোটেও ঠিক নয়। এতে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। স্বামী বা স্ত্রী দুজন যদি দু’জনের আন্তরিক না হতে পারে তাহলে সমস্যা বৃদ্ধি পায়। একে অপরের কাজের প্রশংসা বা সমালোচনা করে কাজের গতি বাড়াতে পারে। শারীরিক বা মানসিক সমস্যায় একে অপরকে উৎসাহমূলক কিংবা ইতিবাচক সাজেশন দিয়ে হেল্প করতে পারে। ঘরে যতটুকু সময় পাওয়া যায় ততটুকুই উপভোগ্য করে তুলতে পারে। দাম্পত্য জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় ঝগড়া হলে আগের মতো কেউ কারও মান ভাঙ্গাতে রাজি হয় না। ব্যাপারটা এমন অটোমেটিকলি সলুউশন হলে হলো, না হলে নাই। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। এ সময়ও দু’জনের যে কোন একজন যদি সমাধানে এগিয়ে আসে দেখা যায় সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। এতে করে কেউ কারও কাছে ছোট হয়ে যায় না। ছোটখাটো এসব বিষয় যদি গুছিয়ে নেয়া যায় তাহলে সংসার জীবনটা অনেক শান্তির মনে হবে। সামান্য অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে আমরা যেভাবে ছুটে যাই ঠিক সেভাবে মনের অস্বস্তি দূর করতে আমরা বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হই না। অথচ একটু কাউন্সিলিং জীবনের গতিপথ যে পরিবর্তন করতে পারে তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। অতএব, ভাঙ্গা-গড়ার জীবন নয়, অটুট বন্ধনের জীবনই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত। তাছাড়া শুধু নিজেদের জন্য নয়, সন্তানকে সুস্থভাবে বড় করে তোলার জন্যও সুস্থ পরিবেশ দরকার। বেড়ে ওঠার সময় যদি সন্তান পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে তাহলে সে প্রকৃত মানুষরূপে বেড়ে ওঠে না। মেধা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। একপর্যায়ে সমাজের বোঝা হিসেবে তাদের গণ্য করা হয়। অতএব, একটি ভুল সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনে কতটা হুমকিস্বরূপ তা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। সব সমস্যার সমাধান নিজেদের হাতে। প্রয়োজন শুধু মন থেকে একে অপরকে মেনে নেয়া। মডেল : তূর্য ও স্বর্ণা
×