ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নেপাল ভুটান মিয়ানমারে যৌথ উদ্যোগে জলবিদ্যুত উৎপাদন

বিনিয়োগের জন্য কোম্পানি গঠন করছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বিনিয়োগের জন্য কোম্পানি গঠন করছে সরকার

রশিদ মামুন ॥ নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারে যৌথ উদ্যোগে জলবিদ্যুত উৎপাদনে বিনিয়োগের জন্য সরকার নতুন একটি কোম্পানি গঠন করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে ভারত এবং চীন কয়লাবিদ্যুত উৎপাদনে পৃথক কোম্পানি করেছে। একইভাবে এই কোম্পানিও কাজ করবে দুই দেশের সরকারী পর্যায়ে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এ্যাগ্রিমেন্টের আলোকে এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের জ্বালানি এবং বিদ্যুত সঙ্কট সমাধানে এক সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। এর আগে এসব ইস্যুতে ভারতের মতভেদ থাকলেও এখন দেশটি জলবিদ্যুত উৎপাদনে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারে জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া ভারত তাদের অরুণাচল প্রদেশে উৎপাদিত জলবিদ্যুত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সঞ্চালনের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এতদিন বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন সার্কের ফ্রেমওয়ার্ক এ্যাগ্রিমেন্টের পর দেশগুলো এই ইস্যুকে প্রাধান্য দিচ্ছে। নেপাল, ভুটানে বিপুল জলশক্তি থাকলেও দেশ দুটি বিপুল বিনিয়োগের অভাবে তা কাজে লাগাতে পারছে না। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে দেশ দুটিতে বিদ্যুতের বড় বাজার না থাকায় বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এখানে বড় বিনিয়োগ করতে চাইছে না। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ এই এলাকায় উৎপাদিত বিদ্যুতের বড় ক্রেতা হতে পারে। সঙ্গতকারণেই এখন কোন কোন কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন নেপাল ও ভুটানে সরকার জলবিদ্যুত উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এ বিষয়ে দেশ দুটির সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। দেশ দুটি এতে সম্মতিও দিয়েছে। এছাড়া নেপালের সঙ্গে জলবিদ্যুত উৎপাদনে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু নেপালের ভূমিকম্পের পর তা পিছিয়ে যায়। দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝক্কি কাটিয়ে ওঠার পর এমওইউ স্বাক্ষর হবে বলে জানা গেছে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, হাইড্রো কোম্পানি গঠনের জন্য গত ৩ সেপ্টেম্বর বিদ্যুত বিভাগ থেকে পিডিবির কাছে কোম্পানির গঠন প্রণালী প্রস্তুত করে পাঠাতে বলা হয়েছে। দেশে কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্পে দীর্ঘ সময় বিদ্যুত উৎপাদনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু যেহেতু প্রাকৃতিক জলশক্তির ওপর এই বিদ্যুত উৎপাদন নির্ভরশীল তাই দেশে নতুন করে কোন জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব নয়। তবে দেশের বাইরে যৌথ উদ্যোগে এ ধরনের কেন্দ্র করে বিদ্যুত আনা সম্ভব। এখন পিডিবি, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি চীন এবং ভারতের সঙ্গে কোম্পানি করে দেশে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। দেশে এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে। একইভাবে আমরাও সেখানে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারি। আর সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বিদ্যুত সঞ্চালনে একটি কমন গ্রিড লাইন হবে। এই গ্রিড দিয়ে বিদ্যুত আমাদের দেশে আনাটাও কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, ২০১০ সাল থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশের কাছে জলবিদ্যুত বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ওই বছর শেষের দিকে মিয়ানমারের বিদ্যুতমন্ত্রী (উৎপাদন) ইউ জ মিনের নেতৃত্বে দেশটির একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল বৈঠকে করে। মিয়ানমারে প্রায় ৪০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে তারা ভারত ও চীনের কাছে এসব বিদ্যুত বিক্রির জন্য ইতোমধ্যে চুক্তি করে ফেলেছে। মিয়ানমার রাখাইন প্রদেশের উদ্বৃত্ত বিদ্যুত বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে আগ্রহী। ২০১৯ সাল নাগাদ রাখাইনে ৬০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদন হবে। কিন্তু রাখাইনের বিদ্যুত চাহিদা খুবই কম। বর্তমানে তাদের চাহিদা রয়েছে ২০ মেগাওয়াটের মতো। রাখাইন প্রদেশ থেকে ভারত বা চীনের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় তাদের কাছে বিদ্যুত বিক্রিও সম্ভব নয়। এখানে বাংলাদেশ চাইলে নতুন করে কেন্দ্র নির্মাণও করতে পারবে। এর বাইরে নেপালে ৮০ হাজার মেগাওয়াটের জলবিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তারা মাত্র ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করছে। বাকি সম্পদই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুতেই দৈনিক ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যাপক জলবিদ্যুত উৎপাদনের বেশিরভাগ উৎসেরই ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, অন্য কারণের সঙ্গে এতদিন নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলায় সেখানে বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণে কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখায়নি। এখন এই অস্থিরতা কমে যাওয়ায় নেপাল সরকার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে তাদের জলবিদ্যুতের ব্যাপক উৎস দেশটির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। নেপাল সরকার চাইছে দ্রুত বিদ্যুত প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করতে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে বিদ্যুত কেন্দ্র করার চিন্তা করছে। ভারতের বেসরকারী খাতের সঙ্গে তাদের দুটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। ভারতীয় কোম্পানি জিএমআর নেপালে দুটি বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ করছে। বিদ্যুত প্রকল্প দুটির একটি আপার (উজান) কর্নালী এবং অন্যটি মাছরাঙ্গির উজানে নির্মাণ করা হবে। এর একটি ৫০০ মেগাওয়াট অন্যটি ৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করবে। জিএমআর বাংলাদেশের কাছে এই বিদ্যুত বিক্রির প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত ক্রয়ে সম্মতি জানায়। প্রকল্প দুটির বিদ্যুত সঞ্চালনে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংকের গ্রুপ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প দুটি অনেকদূর এগিয়েছে। তৃতীয় কোন দেশে বিদ্যুত বিক্রি করার বিষয়ে আইএফসির এক ধরনের চাপ রয়েছে। আইএফসি বাংলাদেশে বিদ্যুত বিক্রির বিষয়ে জিএমআরের সঙ্গে মধ্যস্থতা করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশ আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে নেপাল থেকে অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট এবং ভুটান থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুত সাশ্রয়ী মূল্যে আমদানি করতে পারে। এই লক্ষ্যমাত্রার কাছে পৌঁছতে হলে এখনই বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট পেতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ ভারতের বিদ্যুত সরবরাহের ক্ষেত্রে নিজেদের ভূখ- ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে তাই বাংলাদেশকেও ভারত সেই সুবিধা দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
×