ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করতে পারবেন;###;আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক- আদালতের পর্যবেক্ষণ

অপারেশন ক্লিনহার্ট ॥ দায়মুক্তি অবৈধ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

অপারেশন  ক্লিনহার্ট ॥ দায়মুক্তি অবৈধ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ রবিবার এ রায় দেয়। এতে বলা হয়, যৌথবাহিনীর ওই অভিযানের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন এবং হাইকোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস দমনের নামে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ক্লিনহার্ট অভিযানের নির্দেশ দিয়ে শুরু করে ক্লিনহার্ট অপারেশন। সে সময় ঐ অভিযানে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। অভিযানকালে যে শব্দটি বহুল প্রচারিত ছিল, তা হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক। অপারেশন ক্লিনহার্টে ধরা পড়ে যে কেউ একটা পরিণতিই বরণ করত- তা হচ্ছে মৃত্যু। আর সেই মৃত্যুটি হতো, ‘হার্ট এ্যাটাকে।’ পরে দেশ-বিদেশের প্রচ- সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে ঐ অভিযান গুটিয়ে শুরু হয় ‘ক্রসফায়ার পর্ব’। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজ হাতে আইন তুলে নিতে পারেন না। সংবিধান অনুযায়ী একজন শীর্ষ অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে কারও মৃত্যুকে জঘন্য অপরাধ বলেও পর্যবেক্ষণে বলেন আদালত। রিট আবেদনকারী আইনজীবী জেডআই খান পান্না বলেন, দায়মুক্তি আইনটিতে বলা হয়, অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোন আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবে না। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করা যাবে না। এটা সংবিধানের মৌলিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রিটের পক্ষে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথবাহিনীর অভিযানের হত্যাকা-ের ঘটনায় ৪০টি পত্রিকা কাটিং রিটে সংযুক্ত করেছি। ওই সময় নিরাপত্তা হেফাজতে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। ওই আইনের ১৪ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে ও এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। ফিলিপিন্সে এটা করা হয়েছে। ভারতের সুপ্রীমকোর্টও এ ধরনের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে অনেক রায় দিয়েছে। যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩’র মাধ্যমে যেসব হত্যাকা- ঘটেছিল তৎকালীন সরকার সংসদে আইন পাস করে তার বৈধতা দেয়। রবিবার তা বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বা ব্যক্তিগতভাবে যদি কাউকে দোষী মনে হয়, সাক্ষী-প্রমাণ থাকে থানায় অথবা কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথবাহিনীর ওই অভিযান চলে। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩’ করা হয়। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী জেডআই খান পান্না ২০১২ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে এই রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৯ জুলাই বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ রুল দেয়। রুলে ওই আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। আইন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র সচিব, সেনা সদর দফতরের কমান্ডার ইন চীফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে এর জবাব দিতে বলে হাইকোর্ট। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৩১ আগস্ট আদালত রায়ের জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দেয়। আদালতে রিট আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম মনজুর আলম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি এ্যার্টনি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের কলঙ্কজনক দুটি নাম। ‘হার্ট এ্যাটাক’ ও ‘ক্রসফায়ার’Ñএই দুটি নাম যেন একই মায়ের যমজ সন্তান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় শুরু হয়েছে হার্ট এ্যাটাক। হার্ট এ্যাটাক থেকে ক্রসফায়ার শুরু করে তারাই। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস দমনের নামে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ক্লিনহার্ট অভিযানের নির্দেশ দিয়ে শুরু করে হার্ট এ্যাটাক। দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে অপারেশন ক্লিনহার্ট গুটিয়ে ক্রসফায়ার শুরু করার নির্দেশ দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটের রাজনৈতিক দলগুলো তখন ক্রসফায়ার বন্ধের দাবি জানিয়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দেশ-বিদেশে নিন্দিত, ঘৃণিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ক্রসফায়ারের বৈধতা দিতে মাঝে মধ্যে হার্ট এ্যাটাকের মতোই নাম বদলায়। ক্রসফায়ার হয়ে যায় এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধ। ২০০২ সালের ১৭ অক্টোবর শুরু হয় অপারেশন ক্লিনহার্ট অভিযান। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে ৪০ হাজার সদস্য দেশব্যাপী শুরু করে সন্ত্রাসী গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারাভিযান। এই অভিযানের নাম দেয়া হয় অপারেশন ক্লিনহার্ট। অপারেশন ক্লিনহার্ট চলে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত অপারেশন ক্লিনহার্টে মারা গেছে ৪৪ জন। আহত হয়েছে ১১ হাজার। ২০০২ সালের ২২ নবেম্বরের একটি ঘটনা। রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকার বাবুপুরা মার্কেটের দোকানে বসে আছে তসু মিয়া। তার সঙ্গে বিরোধ ছিল বাবুপুরা মার্কেটের দোকানি বিএনপির প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা উজির, নাজির ও বাদশার। তারাই পূর্বশত্রুতার প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় তসু মিয়াকে। সেনা ক্যাম্পে নিয়ে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তসু মিয়া সেনা ক্যাম্পে নির্যাতনের ফলে মারা যায়। তারপর রটিয়ে দেয়া হয় সেনা ক্যাম্প থেকে পালানোর চেষ্টার সময় মারা গেছে তসু মিয়া। তার স্ত্রী নয়নতারা, চার সন্তান: পলি, পলাশ, ইতি, বীথিকে শেষবারের মতো লাশও দেখতে দেয়নি। সেনা ও পুলিশ সদস্যরা তার লাশ দাফনের কথা বলে তাদের কাছ থেকে ১৩শ’ টাকাও নেয়। তারপর তাদের আজিমপুর কবরস্থানের গেটের বাইরে তার লাশ দাফন করা হয়। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করার কথা মনে করে আজও ভয়ে তাদের শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেনা হেফাজতে নিহত শ্রমিক লীগ নেতা আমিরুল হক রকেট চৌধুরীকে সেনা ক্যাম্পে এতই অমানুষিক নির্যাতন করা হয় যে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। তাকে হত্যার পর যারা তার লাশ দেখেছে তারাই শিউরে উঠেছে। ২০০২ সালের ২৩ অক্টোবর ভোলা শহরের কালীবাড়ির নিজ বাসভবন থেকে সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে নির্দয় নির্যাতন করে। নির্যাতনে সেনা ক্যাম্পেই তার মৃত্যু ঘটে। যৌথবাহিনীর হেফাজতে তখনকার নির্দয়-নিষ্ঠুর নির্যাতনের সঙ্গে একমাত্র মধ্যযুগীয় বর্বরতারই মিল পাওয়া যায়। মধ্যযুগীয় ঐ নির্যাতনের শিকার আবদুল রশীদ ওরফে কালা ফারুক। হার্ট এ্যাটাকের ভয়ে পালিয়ে সে চলে যাবে সুইডেনে। তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অর্থাৎ আজকের হযরত শাহ্জালাল বিমানবন্দরে গেছে সে। সুইডেনে যাওয়ার উদ্দেশে বিমানে উঠবে। এমন সময় খবর পেলো ক্লিনহার্ট অভিযান পরিচালনাকারীরা। বিমানে ওঠার আগমুহূর্তে তাকে বিমানবন্দর থেকে ধরে নিয়ে আসা হলো। দিনভর নির্যাতন চালানো হলো তার ওপর। আটকের একদিন পর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর ক্যাম্পে তার মৃত্যু হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরের দিন বলা হলো, তার মৃত্যুর কারণ হার্ট এ্যাটাক। জাতীয় পার্টির ক্যাডার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছিল আবদুর রশীদ ওরফে কালা ফারুক। কালা ফারুকের মতো অনেকেই এভাবে হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে। পিতাকে না পেয়ে পুত্রকে ধরে এনে ক্যাম্পে নির্যাতন করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তির পর মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু ঘটে। ঘটনাটি ঘটেছে খোদ রাজধানীর পল্লবী থানাধীন মিরপুরে। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী মীর মোহাম্মদ হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালায়। তাকে না পেয়ে পায় তার ছেলে কলেজছাত্র জহিরুল হোসেন রবিনকে। তেজগাঁও কলেজের বাণিজ্য বিভগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রবিন। রবিনকে ধরে নেয়ার সময় বলা হয়েছিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে। তারপর ৪ দিন ধরে তার আর হদিস পাওয়া যায়নি। গুরুতর আহত অবস্থায় সেনারা তাকে পল্লবী থানার কাছে হস্তান্তর করে। পুলিশ তাকে ভর্তি করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পর তার মাথায় আঘাতজনিত কারণে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, রবিন হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে। রবিন যেদিন হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে সেদিন আরও দুইজন মারা গেছে হার্ট এ্যাটাকে। কুমিল্লার যুবক ইব্রাহিম, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর আবদুল বারেক রুবেলকে সেনা ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন করার পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে চাইলে তাদের অবস্থা এতই গুরুতর যে পুলিশও তাদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের হাসপাতালে ভর্তি করার পর মৃত্যু ঘটে। তাদের মৃত্যুর ঘটনার পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় তারা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে। এভাবে যতদিন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন অপারেশন ক্লিনহার্ট অভিযান পরিচালনা হয়েছে ততদিনই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর হেফাজতে রবিন, রুবেল, ইব্রাহিম, খালেকের মতো প্রতিদিনই হার্ট এ্যাটাকে মারা যাওয়ার খবর ছিল নিত্যনৈমিত্তিক চরম নিষ্ঠুরতার নির্মম স্বাক্ষর।
×