ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আরএসএসের চাপের মুখেও মোদি সরকার সুসম্পর্ক রক্ষায় সচেষ্ট

কোরবানির আগে গরু নিয়ে সতর্ক অবস্থানে ঢাকা-দিল্লী

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কোরবানির আগে গরু নিয়ে সতর্ক অবস্থানে ঢাকা-দিল্লী

তৌহিদুর রহমান ॥ গরু নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব যেন না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক এখন ঢাকা-দিল্লী। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গরু নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশই এখন বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে। এদিকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধে কঠোর উদ্যোগ নিতে বিজেপির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস)। ঢাকা-দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানায়। প্রতি বছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে গরু আসে। তবে এবার ভারত থেকে গরুর সরবরাহ কমে আসায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোরবানির ঈদে গরুর কোন সঙ্কট হবে না। তবে গরুর বিষয়টি উভয় দেশের জন্যই একটি ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়। আর এ নিয়ে দুই দেশের গভীর সম্পর্কে কোন ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে উভয় দেশই এখন সতর্ক। নয়াদিল্লীতে গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন আরএসএস’র শীর্ষ নেতারা। তারা দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে বাংলাদেশে গরু পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন। গরু পাচার নিয়ে সরকার যেন কোনভাবেই আপোস না করে সে বিষয়ে তাগিদ দেন আরএসএস নেতারা। তারা জানান, বাংলাদেশে গরু পাচার কমলেও তা মোটেই বন্ধ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন জেলার কোন কোন এলাকা দিয়ে বছরের কোন কোন সময় কত গরু বাংলাদেশে পাচার হয়, তার একটা বিস্তারিত বিবরণও রাজনাথ সিংকে দিয়েছেন আরএসএস নেতারা। বিজেপি সরকারের ওপর আরএসএসের প্রবল প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে বিজেপি সরকারকে আরএসএস আগাগোড়া পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কখনও কখনও চাপ প্রয়োগও করে থাকে কট্টরপন্থী আরএসএস। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারতের বিজেপি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বরাবরই সুসম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পরে গত জুন মাসে বাংলাদেশ সফর করেছেন। ইতোমধ্যেই দুই দেশ দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত চুক্তি সমস্যার সমাধান করেছে। এখন তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই গরু নিয়ে কোনভাবেই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছে দিল্লী। গরু নিয়ে একদিকে ভারতের মধ্যে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর চাপ মোকাবেলা। অপরদিকে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। উভয় দিক বিবেচনায় নিয়ে বিজেপি সরকার এখন সতর্ক। আর ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কে যেন টানাপোড়েন না হয় ঢাকাও সতর্কতা অবলম্বন করছে। এদিকে গত সপ্তাহে ভারতের ফার্স্ট পোস্ট পত্রিকায় ‘গরু নিয়ে রাজনাথ সিংহের অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ক্ষতি করছে?’-শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গরু নিয়ে ভারতের বর্তমান অবস্থানের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে কোন নেতিবাচক সম্পর্ক সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে সতর্কও করে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ভারতের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে কারণ এর ফলে মাংসের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া সামনেই কোরবানির ঈদ। তার আগে গরুর সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে ভারতের বর্তমান অবস্থান থেকে সরে এসে গরু আসার পক্ষে মতামত দেয়া হয়। ভারতের আউটলুক পত্রিকার সাবেক ডেপুটি এডিটর এসএনএম আদবির লিখিত এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের গরু বাংলাদেশে না ঢুকলে ক্ষতি হবে দু’দেশেরই। গরু আসা বন্ধ হলে বাংলাদেশের ক্ষতির পাশাপাশি ভারতের প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। কয়েকমাস ধরে ভারত থেকে গরুর প্রবেশ কমে এসেছে। বৈধ-অবৈধ দুই পথেই গরুর প্রবেশ কমেছে। এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে গরুর মাংসের দাম বাড়ছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গরু কেনাবেচা বন্ধ থাকলে ক্ষতি হবে দু’দেশেরই। বাংলাদেশের মানুষের কাছে গরুর মাংস প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস। গরুর মাংসের দাম বাড়লে সহজলভ্য এই আমিষ থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ। তবে এই ক্ষেত্রে ভারতেরও ক্ষতি হবে। ভারত থেকে বাংলাদেশে গরুর সরবরাহ বন্ধ থাকলে প্রতি বছরই দেশটির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি। ভারতে গরু হত্যাকে পাপ মনে করা হয়। সে কারণে গরু হত্যা বন্ধে বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়ে আসছে সেদেশের বিভিন্ন সংগঠন। আর বাংলাদেশে গরু জবাইয়ের উদ্দেশ্যে পাচার বন্ধের দাবিও ছিল এসব সংগঠনের। ইতোমধ্যেই মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় গরু জবাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর সর্বশেষ বৃহস্পতিবার জম্মু-কাশ্মীরে গরুর মাংস বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাজ্যের উচ্চ আদালত। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বিএসএফের প্রতিষ্ঠা দিবসে ভাষণে সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচার বন্ধে সবরকম চেষ্টা করতে হবে। গত বছরের শেষের দিকে এই বক্তব্য দেয়ার পরেও ভারত থেকে গরু আসছিল। তবে গত ১-৩ এপ্রিল রাজনাথ সিং বাংলাদেশ-ভারতের কয়েকটি সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি সে সময় গরু সরবরাহ বন্ধে সীমান্ত বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই বাংলাদেশে গরু আসা আরও কমে যায়। বাংলাদেশে গরু আসা নিষেধ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নীতিনির্ধারণী কমিটির সদস্য তথাগত রায় জানান, ভারত থেকে গরু রফতানি নিষিদ্ধ। গরু পাচারের মাধ্যমে যে অর্থ ভারতে আসে তা কালো টাকা। এই অর্থ সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসবাদেরও জন্ম দেয়। এক্ষেত্রে সীমান্ত হাটে গরু বিক্রির বিষয়ে ভারতের সরকার কোন ব্যবস্থা নিতে পারে কিনা। তিনি জানান, বিষয়টি দুদেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশে গরু সরবরাহ বন্ধ হলে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ গরু স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গোশালায় রাখতে হবে। এতে বছরে যে ব্যয় হবে, তা শিশুদের পুষ্টি নিরাপত্তায় ভারত সরকারের বরাদ্দ অর্থের প্রায় চার গুণ। ভারতে গরুর গড় আয়ু ১৫-২০ বছর। সাধারণত মৃত্যুর পাঁচ বছর আগেই একটি গাভী দুধ দেয়া বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের একটি গরু গোশালায় রেখে খাওয়ানো ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং এ কাজে নিয়োজিত কর্মীর বেতন বাবদ খরচ হয় বছরে ২৫ হাজার রুপী। সে হিসাবে ১ কোটি ২৫ লাখ গরুর পেছনে বছরে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে ৩১ হাজার ২৫০ কোটি রুপী। বাংলাদেশী টাকায় এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ভারতের গণমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, সীমান্তে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা বাস্তবে খুবই কঠিন। বিএসএফের সাবেক কর্মকর্তা সলিল কুমার মিত্র বলেছেন, গরু পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিএসএফের দায়িত্বটা অনেকটাই সীমিত। কারণ সীমান্ত দিয়ে যে গরু পাচার হয়, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গের নয়। মূলত আনা হয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ থেকে। এই যে শয়ে শয়ে কিলোমিটার ট্রাকে চাপিয়ে গরু নিয়ে আসা হয়, সেই রাস্তায় তো পুলিশ, শুল্ক বিভাগ, এরাও থাকে। তারা যদি সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে তো গরুগুলো সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে না। বিএসএফের অনেক অফিসারই মনে করেন, পাচার রোখার চেষ্টা না করে বরং ভারত সরকারের উচিত কীভাবে আইন মেনে গরু বাংলাদেশে পাঠানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা করা উচিত।
×