ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিউইয়র্ক টাইমসের এ সপ্তাহের সেরা বইটি নিয়ে লিখেছেন আরিফুর সবুজ

এক্স সিউ গ্রাফটন

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এক্স সিউ গ্রাফটন

এ পৃথিবী ঠগবাজে পরিপূর্ণ, কথাটি নেহাৎ মিথ্যে নয়। অনেকেই তা মানতে চাইবেন না। কিন্তু আমাদের চারপাশে অসংখ্য ঠগবাজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়ত আপনি যার সঙ্গে হরিহর আত্মা ভেবে মিশছেন, সে ঠগবাজ। ঠকার পর বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা বলা চলে বিশ্বাস হারানোর কষ্ট আপনাকে কুরেকুরে নিঃশেষ করে দেবে। তাই ঠগবাজদের ব্যাপারে ইন্দ্রীয়কে সজাগ রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু সমস্যা হলো এদের সহজে চেনা যায় না। এদের বেশিরভাগই ছদœবেশি। ভদ্রলোক সেজে সমাজের সবার সঙ্গে মিশে থাকে অঙ্গাঙ্গিভাবে। তাদের আচরণ, কথাবার্তার মধ্যেও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের ঠগবাজির কোন নমুনা। এমনই চতুর এরা। সুযোগ পেলেই ক্ষতি করে। মানুষকে প্রতারিত করে চম্পট দেয়। আবার অনেক সময় এত সূক্ষ্ম কৌশলে এরা মানুষের ক্ষতি করে যে, অন্য কেউ ধরতেই পারে না এদের প্রতারণা। ঠগবাজি, প্রতারণা করেও এরা বুক ফুলিয়ে দিব্যি ভাল মানুষটি সেজে এরা ঘুরে বেড়ায়। এদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করে চলছেন কিনসে মিলহোন। ভদ্রবেশি প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচনের মহান দায়িত্ব বেশ দক্ষতার সঙ্গে পালন করে চলছেন কিনসে। গোয়েন্দাগিরি তার নেশা ও পেশা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা প্রতারকদের ছদœবেশ খুলে দিতে বদ্ধপরিকর কিনসে। এজন্য অনেক সময় অর্থের বিনিময় ছাড়াও নেমে পড়েন গোয়েন্দাগিরিতে। আবার অনেক সময় ঘটনাচক্রেও জড়িয়ে পড়েন। তবে সর্বদা লক্ষ্য অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন। দুঁদে গোয়েন্দা হিসেবে বেশ নাম কামিয়ে নিয়েছেন আটত্রিশ বছর বয়সী প্রাইভেট গোয়েন্দা কিনসে মিলহোন। তাকে নিয়েই ‘এক্স’ আদ্যক্ষর নামের বইটি। এর লেখক সিউ গ্রাফটন। ১৯৮২ সালে সিউ গ্রাফটন এ আদ্যক্ষর নাম দিয়ে একটি বই লেখেন। সে বইটি কিনসে মিলহোনের গোয়েন্দাগিরির নানা বর্ণিল ও লোমহর্ষক কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত। ওই বইটি পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। সে বইটির সাফল্যর পর ধারাবাহিক সিরিজ হিসেবে বিসিডি এভাবে আদ্যক্ষর অনুযায়ী ডব্লিউ পর্যন্ত বই বের হয়েছিল। প্রতিটি বই পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। সর্বশেষ বের হয়েছে ‘এক্স’ নামের এই বইটি। এই সিরিজ শুরুর ঠিক তেত্রিশ বছর পর আটাশতম বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এই বইটি। এরপর এই সিরিজের ওয়াই এবং জেড নামের আরও দুটি বই বের হবে। যাই হোক, ‘এক্স’ বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলারের শীর্ষে অবস্থান করছে। অনেক পাঠকের কাছে রহস্যে উপন্যাস ভাল লাগে। তবে যে রহস্যে উপন্যাসে পাঠক নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাবে, সেটার প্রতি বেশি ভাল লাগা কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। ‘এক্স’ বইটির কাহিনী খুব বেশি বৈচিত্র্যময় নয়, তবে পাঠকের কাছে লেখক এমনভাবে কাহিনীগুলো উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, পাঠক নিজেকে জড়িয়ে ফেলে ওই কাহিনীগুলোর মধ্যে। এখানেই সিউ গ্রাফটনের সফলতা। কিনসে মিলহোনকে দিয়ে লেখক পাঠকদের কাছে হাজির করেছেন জীবনের রূঢ় বাস্তবতা। অনেক অজানা সত্য। চারশ পৃষ্ঠার এই বইটিতে কিনসে তিনটি রহস্যের সমাধান করেছেন। প্রতিটি রহস্যে সমাধান তিনি এত কৌশলগতভাবে সম্পন্ন করেছেন যে পাঠক বিস্মিত না হয়ে পারে না। বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার, সেটা হলো বইয়ের কাহিনীগুলো ১৯৮৯ সালের প্রেক্ষাপটে রচিত। ওই সময়টাতে আজকের মতো ইন্টারনেটসহ অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। ফলে তখনকার গোয়েন্দাগিরিতে বেশ বেগ পোহাতে হতো। আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে ছাব্বিশ বছর আগের পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা বিশেষ করে রহস্যে উন্মোচন কাহিনী এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে , পাঠকের মনে হবে সে সেই সময়টাতে বিদ্যমান। প্রথম কাহিনীটিতে আমরা দেখি হালি ব্যাটনকোর্ট নামের এক সম্পদশালী মহিলা কিনসের সাহায্য চেয়েছে তার ছেলে ক্রিস্টিয়ান স্যাটারফিল্ডকে খুঁজে পেতে। তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি জেল ফেরত আসামি ছিল। ব্যাটনকোর্ট যখন ১৫ বছর বয়সী ছিল তখন দুর্ঘটনাক্রমে সে কনসিভ করে। বাবা মা চেয়েছিল গর্ভপাত করে ফেলতে। কিন্তু ব্যাটনকোর্ট গর্ভপাত করাননি। কিন্তু ছেলে হওয়ার পর তাকে দত্তক দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ছেলে সামান্য অপরাধে জেল খেটেছে। তাকে খুঁজে বের করতে চান তিনি। এমন করুণ কাহিনী কিনসেকে ভাবাবেগ তাড়িত করে ফেলে। কিন্তু যখন কিনসে তদন্ত শুরু করে তখন বুঝতে পারে ব্যাটনকোর্ট তাকে অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যে বলেছে। এক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে কিনসে জানতে পারে আসল সত্য। পারিবারিক দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই এমন নাটক সাজিয়েছেন ব্যাটনকোর্ট। এই রহস্যে উদঘাটন অনেক সহজ মনে হলেও, আসলে তা নয়। অনেক কাঠখড় পেরিয়েই এ রহস্যের সমাধান করেন কিনসে। দ্বিতীয় রহস্যের সমাধানও সহজ ছিল না। কিনসের বান্ধবী রুথ তার কাছে সাহায্য চাইতে আসে। রুথ কঠিন এক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তার মৃত স্বামী পিট ওলিনোস্কির রেখে যাওয়া এক বাক্স কাগজপত্রই সমস্যা সৃষ্টি করছে। কাগজগুলোর জন্য তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কী আছে এই পুরনো কাগজপত্রের মধ্যে? কিনসে সেই বাক্সপেটরা ঘেটে খুঁজে পায় ১৯৬১ সালে পোস্ট করা একটি সাঙ্কেতিক চিঠি। সেই চিঠির রহস্যে উদ্ধার করতে গিয়ে কিনসে বুঝতে পারে, ওলিনোস্কি সম্পর্কে তার যে ধারণা ছিল, তা সম্পূর্ণ ভুল। সে জড়িত ছিল ভয়ঙ্কর কিছু কর্মকা-ের সঙ্গে। আর তৃতীয় রহস্যেটি কিনসের বাড়িওয়ালা হেনরি পিট এবং তার পাশের প্রতিবেশী দম্পতি জোসেফ ও এডেনাকে নিয়ে। হেনরির পানি সঞ্চয়ের প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে দিচ্ছিল এই দম্পতি। কিন্তু কেন, এই রহস্যে উদ্ঘাটন করতে গিয়ে কিনসের কাছে উন্মোচিত হয় ভয়ঙ্কর কিছু দৃশ্যপট। কিনসে বুঝতে পারে, ভদ্রতার আড়ালে মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকে কত হিংস্রতা। ‘এক্স’ বইটির তিনটি রহস্যে কাহিনী অতি সাধারণ মনে হলেও ভাবের গভীরতায় এর গুরুত্ব অনেক। বইটির মধ্যে দিয়ে পাঠক শুধু রোমাঞ্চই অনুভব করে না, উপলব্ধি করতে পারে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ভদ্রবেশি প্রতারকরা কিভাবে মানুষকে অহরহ ঠকিয়ে চলে, কিভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যর জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে ফেলে। সবমিলিয়ে বইটি অনবদ্য।
×