ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুব রেজা

রেহমান সোবহান অন্ধকারের বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৮:০৯, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

রেহমান সোবহান  অন্ধকারের বাতিঘর

অর্থনীতির মানুষ হলেও রাজনীতিটা আর দশজনের চেয়ে ভালই বুঝতেন। শুধু বুঝতেন একথা বললে বোধকরি ভুল বলা হবে। বরং বলাই শ্রেয় যে, তিনি রাজনীতির সুলুক সন্ধানের বিষয়-আশয় রাজনীতিকদেরও ভাল করে বুঝিয়ে দিতেন, কখনও কখনও ধরিয়েও দিতেন। রাজনীতিকরা অনেক সময় নানান কারণে গ-িবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনÑ নিজের কিংবা নিজেদের বোঝার বাইরে তারা যেতে চান না বা যেতে পারেন না। রাজনীতিকদের সেই খামতির কথা কখনও কখনও মুক্তবুদ্ধির মানুষরা মোটা দাগে তুলে ধরতেন। কালে কালে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। দেশের আন্দোলন-সংগ্রাম, বিপর্যয় কিংবা অনিশ্চয়তার সময় মুক্তপ্রাণের মানুষরা তাদের যুক্তি, বুদ্ধি, দর্শন, চিন্তা দিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা তাদের উদার চিন্তা, তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন বাতিঘর। অন্ধকারের ভেতর বাতিঘর যেমন দিকভ্রান্ত মানুষকে আলোর সন্ধান দেয় তেমনি তারাও পথ নির্দেশ করেন মানুষকে। সামনের দিকে নিয়ে যেতে ব্রতী হয় জাতিকে। রেহমান সোবহান। অর্থনীতির জটিল বিষয়কে সহজিয়া ভাষায় মানুষের মধ্যে প্রোথিত করার বাইরেও এক অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে নিজেই হয়ে উঠেছেন অনন্য-অসাধারণ এবং অনুকরণীয়। অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে-বিদেশে নমস্য ব্যক্তিত্ব তিনি। রেহমান সোবহান মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালের ১২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়। বাবা উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। পড়াশোনায় বরাবরই তুমুল মেধাবী ছিলেন রেহমান সোবহান। পড়াশোনা করেছেন দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী সেন্ট পলস স্কুলে। কলেজ লাহোরের অ্যাচিসন কলেজে। পড়াশোনায় সব সময় ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে তার নাম ছিল অবধারিত। পড়াশোনার পাশাপাশি শিল্প সংস্কৃতি, সাহিত্য, খেলাধুলা, গান-বাজনায়ও ছিল সমান আগ্রহ। কলেজ শেষে ভর্তি হলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৫৬ সালে ক্যামব্রিজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর অর্থনীতি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনার সময়ই রেহমান সোবহানের সামনে পাকিস্তানের অস্থির সময়ের রাজনীতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছিল। দেশভাগের পর রাজনীতি যেন রাতারাতি চলে গেল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হাতে। পূর্ব ও পশ্চিমের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যেখানে মানুষ মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল। বৈষম্যের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখানো হলো এদেশের মানুষের প্রতি। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সকল প্রাপ্তি যোগ থেকে বঞ্চিত। শোসনের কড়া বেড়াজালে পশ্চিমের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে যেন একঘরে করে রাখল পূর্ববাংলার মানুষ । কোনকিছুতে অধিকার খাটাতে পারবে না। শোসন-বঞ্চনার এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জন দিন দিন বাংলাদেশের মানুষের জন্য মূর্ত হয়ে উঠতে লাগল। বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষ তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে একাট্টা হয়ে উঠল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। শোসন-বঞ্চনা-অবহেলা এ অঞ্চলের মানুষকে নানাভাবে বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তিতে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলল কী রাজনৈতিকভাবে, কী সামাজিকভাবে, কী সাংস্কৃতিকভাবে, কী অর্থনীতিকভাবেÑ সব ক্ষেত্রেই মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠল। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদ্ভুত জাদুকরী নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় দেশের মানুষ ফুঁসে উঠল। একত্র হতে লাগল। সময়টা রাজনৈতিক কারণে বেশ উত্তাল। ১৯৫৭ সাল। রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেন। এর এক বছরের মাথায় দেশে সামরিক শাসন জারি করা হলো। দম বন্ধ করার মতো এক পরিবেশ। সামরিক শাসক ক্ষমতায় বসেই সংবিধান স্থগিত করলেন। রাজনীতির ওপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করে রাজনীতিকেও দুর্বিষহ করে তুললেন। রাজনৈতিক কর্মকা- যাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেতে না পারে সে জন্য রাজনীতিকদের ওপরও স্টিমরোলার চালাতে শুরু করলেন। চারদিকের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠল। তরুণ প্রভাষক- তার ওপর মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলে রেহমান সোবহান সামরিক শাসকদের এইসব জগা-খিচুড়ি টাইপের পরস্পরবিরোধী কর্মকা-কে সমর্থন করতে পারলেন না। তিনি রাজনৈতিকভাবে এসব জগা খিচুড়ি মার্কা নীতির জবাব না দিয়ে কৌশল নিলেন ভিন্ন এক নীতির। রেহমান সোবহান তখনই বুঝে গিয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষকে অর্থনীতির ভাষায় বোঝাতে হবে শোসনের চিত্র, বঞ্চনার চিত্র। সর্বোপরি অবহেলার চিত্র। পশ্চিমা শাসকদের এক চক্ষু নীতির চিত্রটি মানুষের সামনে বড় দাগে তুলে ধরতে হবে। অর্থনীতির বৈষম্যের সার্বিক চিত্রটি যখন মানুষ জেনে যাবে তখন সে এর নেপথ্যের রহস্য উদঘাটনেও সোচ্চার হবে। এই সোচ্চার হতে গিয়ে মানুষ রাজনীতির পার্থক্যটাও জানবে। তরুণ প্রভাষক তাই বেছে নিলেন অর্থনীতি বিষয়ক লেখালেখি। যদিও আগে থেকেই লেখালেখির বিষয়টা তাঁর মধ্যে ছিল। সামরিক শাসনের ফলে তিনি তাঁর লেখনীকে তুলে ধরলেন সুউচ্চে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় রেহমান সোবহান ‘ফোরাম’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এই ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড. কামাল হোসেন, হামিদা হোসেন, সালমা হোসেন প্রমুখ। ফোরামে তখন তাঁর হাত ধরে নানা ধরনের লেখা ছাপা হতে লাগল। ছয় দফা আন্দোলন কিংবা তারও আগে থেকে ফোরাম তার বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর লেখায় মানুষকে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধÑ সবকিছুতে ফোরাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তার ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে। শুধু ফোরাম সম্পাদনা নয়, রেহমান সোবহান এর প্রবন্ধকার, প্রতিবেদক, পরিকল্পনাকারীÑ এক হাতে তিনি ফোরামের সব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেন। ফোরাম বের করতে গিয়ে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন এক দেশে দুই অর্থনীতি, বাঙালী ও পশ্চিম পাকিস্তানের আলাদা জাতিসত্তা, দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যসহ অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-আশয়। তাঁর লেখার ধার ও যুক্তি, বুদ্ধি ও চিন্তার ঋজুতা সে সময়ের রাজনীতিবিদদের প্রেরণা ও সাহস যোগাত। একই সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা তাঁকে এসব লেখায় নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করত। ফোরামে রেহমান সোবহান একাধিক নামে সময়োপযোগী লেখাগুলো লিখতেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে বাঘা বাঘা রাজনীতিক তখন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন তখন রেহমান সোবহান ছিলেন সদা সোচ্চার। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ফোরামে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রকৃত অর্থে ষাটের দশকের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। এসব লেখায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কেই জড়িয়ে যাননিÑ তিনি তাঁর তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই চেতনার বীজটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের গোড়ার দিককার কথা। ১৯৬১ সাল। লাহোরে অনুষ্ঠিত একটি একাডেমিক আলোচনা সভায় রেহমান সোবহান তাঁর বিখ্যাত ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব হাজির করলেন। রেহমান সোবহান সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ উপস্থাপন করার পর চারদিকে বেশ হৈচৈ পড়ে গেল। তরুণ অধ্যাপক রেহমান সোবহান নানারকম তথ্য-উপাত্ত বের করে আলোচনায় প্রমাণ করে দিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কী ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। রফতানির সিংহভাগ আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে এলেও বাজেটের বেশিরভাগ বরাদ্দ পায় পশ্চিম পাকিস্তান। তিনি তাঁর আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির উদাহরণ টেনে এনে বলেছিলেন, দেশের যে অংশ পিছিয়ে আছে, সেই অংশের উন্নয়নে রাষ্ট্রের অধিক বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাঁর কথাকে আমলে নেয়নি। মূলত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে সাধারণ মানুষদের ওপর অত্যাচার, আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা সবাই জানলেও সংবাদপত্রগুলো তা নানা কারণে প্রকাশ করার সাহস রাখত না। সে সময় রেহমান সোবহান বিভিন্ন সভায় শাসকগোষ্ঠীর দ্বৈত অর্থনীতির বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। স্পষ্ট কথা বলতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতির মানুষজনকেও এই দ্বৈত অর্থনীতির বিষয়ে সচেতন করে তোলা, প্রতিবাদী করে তোলা। অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হওয়ার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আলাদা অর্থনীতির দাবিও ওঠে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান পৃথক অর্থনীতির দাবিকে কঠোর ভাষায় নাকচ করে দিয়ে এক অভিন্ন অর্থনীতির কথা উচ্চারণ করেছিলেন। সে সময় পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, ‘আইয়ুব বলছেন এক অর্থনীতি’। একই সময়ে আরেকটি পত্রিকায় সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘রেহমান বলছেন দুই অর্থনীতি’। পত্রিকায় এই পরস্পরবিরোধী সংবাদ প্রকাশিত হলে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের কাছে আইয়ুব খানের সরাসরি প্রশ্ন ছিল, ‘এই রেহমান সোবহানটা আবার কে?’ রেহমান সোবহান মুক্তবুদ্ধি, দেশপ্রেম ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এক অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলের সম্মেলনে ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করলে মানুষের মধ্যে তার ব্যাপক প্রতিফলন দেখা দেয়। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। ছয় দফার পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধরে দেশ ধীরে ধীরে এগুতে থাকে স্বাধীনতার দিকে এই সময় রেহমান সোবহান শক্ত হাতে কলম ধরে মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে তিনি লিখছেন, ছয় দফা তখন আর একটি রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি থাকে নাÑ তা হয়ে ওঠে দেশের মানুষের মুক্তির সনদ। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দুই অর্থনীতি তত্ত্ব, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা এবং ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবÑ সবই উত্থাপিত হয়েছিল লাহোরে। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, রেহমান সোবহানের দুই অর্থনীতি তত্ত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। লাহোরে যখন তিনি তাঁর ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বটি উপস্থাপন করলেন তখন থেকেই পাকিস্তানীদের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। একটি বৈরী পরিবেশে রাজনীতিকরা যেখানে শাসকগোষ্ঠীকে বিচলিত করার সাহস পায় না সেখানে একজন তরুণ অর্থনীতিবিদ তাঁর বক্তব্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠীকে ভাবিয়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছে প্রত্যক্ষ করেছেন রেহমান সোবহান। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দ্বৈত অর্থনীতির বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে তাঁকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সখ্য থাকায় তাঁকে নানাভাবে হয়রানির সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি ৩১ মার্চ দিল্লী পৌঁছেন। এরপর তাজউদ্দীন আহমদের কথামতো এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে ও এপ্রিলের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি প্রবাসী বঙালীদের সংগঠিত করেন তিনি। লন্ডন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে মুজিবনগরে ফিরে মন্ত্রিসভার কাছে রিপোর্টও পেশ করেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর রেহমান সোবহান বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থনৈতিক দূতের কাজও করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কাজ করেছেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদমর্যাদায়); শিল্প, বিদ্যুত এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং অবকাঠামো বিভাগে (১৯৭২-৭৪) যথাক্রমে চেয়ারম্যান, গবেষণা পরিচালক, মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২-৭৪ পর্যন্ত আইডিএসবিএ এমিরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া কুইন এলিজাবেথ হাউসে ১৯৭৬-৭৯ পর্যন্ত ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রেসিডেন্টের এ্যাডভাইজারি কাউন্সিল (ক্যাবিনেট মিনিস্টারের পদমর্যাদায়), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (১৯৯১) সদস্য ছিলেন। ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৪-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। এসব দায়িত্ব পালনে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ মেধা, মননের সমন্বয় ঘটিয়ে দেশকে সামনের দিকে নিয়ে গেছেন। রেহমান সোবহান সবসময়ই স্বপ্নবান মানুষের প্রতীক। তিনি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে চলেছেন নিরন্তর। তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইয়ুব খানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর সম্পর্ক, মধ্যবর্তী শাসন পদ্ধতিতে সর্বজনীন সাহসী উদ্যোগের ভূমিকা, বৈদেশিক নির্ভরশীলতার সঙ্কট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা, কৃষিজ সংস্কার, সমন্বয় নীতি সংস্করণের সমালোচনামূলক নিবন্ধ, দুঃশাসনের ব্যবচ্ছেদ, দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল। এছাড়া রেহমান সোবহান ‘মুক্তিযুদ্ধের অর্থনীতিবিদ’ হিসেবেও দেশে বিদেশে খ্যাত। অতি সম্প্রতি রেহমান সোবহানের নতুন বই ‘ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু নেশনস মাই জার্নি টু বাংলাদেশ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল এই দশ বছরে তাঁর লেখা কলাম, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় নিয়ে এই বই। বইটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি এই সময়কালে রচিত তাঁর লেখায় নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রেহমান সোবহান তাঁর নতুন বইতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা পরবর্র্তী প্রজন্মের জন্য নতুন চিন্তার খোরাক দেবে। ভিন্ন চিন্তার অবতারণা করবে। আশি বছর অতিক্রম করা রেহমান সোবহান মুক্তচিন্তা এবং প্রাগ্রসর ভাবনায় এখনও যে কোন তরুণের চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। ক্রিয়াশীল। প্রাণবন্ত।
×