ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘণ্টায় হাজারবার বজ্রপাত

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঘণ্টায় হাজারবার বজ্রপাত

এনামূল হক ॥ একই জায়গায় কখনও দুবার বজ্রপাত হয় না, এমন একটা কথা চালু আছে। কথাটা অনেক পুরনো আমল থেকে চলে আসা। কিন্তু কথাটার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ বজ্রপাত একই জায়গায় একাধিকবার আঘাত হানতে পারে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলায় একটা হ্রদ আছে, যেখানে বছরের অধিকাংশ দিনে প্রতি ঘণ্টায় হাজার বার বজ্রপাত হয়। এই ঘটনাটি নানা নামে আখ্যায়িত। কেউ বলে মারাকাইবোর আলোক সঙ্কেত, কেউ বলে কাটাটুমবোর বজ্র, কেউ বা বলে চিরস্থায়ী ঝড়। এই শেষের কথাটার মধ্যে অতিরঞ্জন থাকতে পারে। তথাপি এটা সত্য যে, কাটাটুমবো নদী মারাকাইবো হ্রদের যে জায়গায় মিলিত হয়েছে, সেখানে বছরে গড়ে ২৬০ দিনই ঝড় হয়। সেখানে রাতের আকাশ নিয়মিতই ৯ ঘণ্টা ধরে আলোকে উদ্ভাসিত থাকে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হাজার হাজার বার বিদ্যুত চমকানির কারণে। বিষুবরেখা বরাবর যাদের বাস তারা গ্রীষ্মকালীন ঝড়ের সঙ্গে অতি পরিচিত। সেখানে তাপমাত্রা যথেষ্ট বেশি এবং সারা বছরই আকাশ মেঘের গুড় গুড় ধ্বনিতে কম্পিত থাকে। সেন্ট্রাল আফ্রিকা দেশটিতে ডা. কংগো নামে এক জায়গা আছে, যা বিশ্বে বজ্রবৃষ্টি ঝড়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। সেখানকার পাবর্ত্য গ্রাম কিফুকায় প্রতিবছর প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৫৮ বার বিদ্যুতের ঝলকানি ও বজ্রপাত হয়। ২০১৪ সালে নাসার এক তথ্যে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বর্ষা মৌসুমের আগমনের আগে এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে যে হারে বিদ্যুতের চমকানি ও বজ্রপাত হয়, মাসিক হিসেবে তা সর্বোচ্চ। তবে সর্বাধিক বজ্রপাতের বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী হিসেবে গিনেজ বুকে স্থান পেয়েছে ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদ। প্রতিবছর সেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটার জায়গায় ২৫০টি বিদ্যুত চমকানি ও বজ্রপাত ঘটে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুটি শুষ্ক মাসে ঝড় থেমে যায় এবং তুঙ্গে ওঠে অক্টোবরের দিকে বর্ষা মৌসুমে। বছরের ওই সময়টায় মিনিটে গড়ে ২৮টি বিদ্যুতের চমকানি দেখতে পাওয়া যায়। ওই এলাকায় কেন এত বজ্রবৃষ্টি হয় তার কারণ নির্ণয়ে বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েক দশক ধরে মাথা ঘামিয়েছেন। ষাটের দশকে একটা ব্যাখ্যা ছিল এইÑ তখনকার মাটির স্তরের নিচে ইউরেনিয়ামের আধার আছে, যা অধিক বজ্রপাতের কারণ। তবে সাম্প্রতিককালে, বিজ্ঞানীরা বলেছেন, নিচের তেলক্ষেত্রগুলো থেকে নির্গত মিথেনের প্রাচুর্যের কারণে হ্রদের ওপরের বায়ুর বিদ্যুত পরিবাহিতা বেড়ে যাওয়ার ফলেই এমনটা ঘটে। তবে এই দুই ব্যাখ্যার কোনটাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়নি। তাই টপোগ্রাফি এবং বায়ুপ্রবাহের ধরনকে যুক্তভাবে এই বিস্ময়কর ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরা হয়। ড. ড্যানিয়েল সিলি নামে এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বক্র তটরেখায় বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ভূখ-ের এ ধরনের অসমতার কারণে বায়ুপ্রবাহ, তাপ ও চাপের এমন প্যাটার্ন তৈরি হতে পারে, যার ফলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। ভেনিজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাংশে রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ হ্রদ মারাকাইবো। এর জলরাশি মারাকাইবো শহর অতিক্রম করে ক্যারিবিয়ান সাগরে গিয়ে মিশেছে। এ্যান্ডিজ পর্বতমালার সন্ধিস্থলে অবস্থিত, এই হ্রদের তিনদিকে রয়েছে উঁচু শৈলশ্রেণী। দিনের বেলা বিষুব অঞ্চলীয় সূর্য কিরণের তাপে হ্রদ ও চারপাশের জলা এলাকার পানি বাষ্পে পরিণত হয়। রাত নামলে সাগর থেকে আগত শীতল বাণিজ্য বায়ু এই বাষ্পময় উষ্ণবায়ু ঠেলে ওপরে পাঠিয়ে দেয়। ওপরে গিয়ে এই জলীয় বাষ্পময় উষ্ণবায়ু শীতল ও ঘনীভূত হয়ে পুঞ্জীভূত মেঘের রূপ ধারণ করে। এই মেঘপুঞ্জ ১২ কিলোমিটার বা ৩৯ হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে উঠে। এই পুঞ্জীভূত মেঘ কিন্তু ঝড়ের মেঘ। বাইরে থেকে দেখলে এই মেঘকে হাল্কা পেঁজা তুলোর মতো মনে হবে। কিন্তু ভেতরে চলে ভয়ঙ্কর কা-। ওখানে ওপরে উঠতে থাকা জলীয় বা আর্দ্র বায়ুর পানির ফোঁটাগুলোর সঙ্গে শীতল বায়ুর বরফের স্ফটিকগুলোর সংঘর্ষ হয়ে স্থিরবিদ্যুত উৎপন্ন হয় এবং বজ্রসহ ঝড় শুরু হয়ে যায়। স্থিরবিদ্যুৎ থেকে আঁকাবাঁকা ঝলকানি ভূমিতে আঘাত হানে, কিংবা মেঘে মেঘে স্থানান্তরিত হয় অথবা মেঘের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। বজ্র নিজেই হলো শব্দের শকওয়েভ। বিদ্যুতের ঝলকানির উত্তাপে সহসা চারপাশের বায়ু চাপযুক্ত হলে এই শকওয়েভ সৃষ্টি হয়। বজ্রের তাপ সূর্যপৃষ্ঠের তাপের চেয়ে তিনগুণ বেশি উত্তপ্ত হতে পারে। শব্দ ও আলোর ঝলকানির পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টি ও শিলাপাতেরও স্পেশাল ইফেক্ট রয়েছে। কাটাটুমবোর বজ্রের ঝলকানি এতই উজ্জ্বল যে আড়াই শ’ মাইল দূর থেকে দেখা যায়। আগের দিনের নাবিকরা এই আলোকে নৌ-চলাচলের কাজে ব্যবহার করত। এই ঝড় নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত। বজ্রের আলো বহুরঙা বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে দাবি করেছে। কিন্তু আসলে ওটা আলোর খেলা। বিদ্যুত, ধুলো ও আর্দ্রতার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করার সময় সাদা আলোর কিছু অংশ শোসিত ও বিচ্ছুরিত হয়, যার ফলে আলোর ঝলকানিকে নানা বর্ণের দেখায়। এমনও দাবি করেছেন কেউ কেউ যে, কাটাটুমবোর বজ্রের কোন আওয়াজ নেই, ওটা ঘটে নিঃশব্দে। ওটাও একটা ভুল কথা। আলোর গতির তুলনায় শব্দের গতি এতই মন্থর যে, বজ্রপাতের শব্দ দূরের দর্শকের কাছে নাও পৌঁছাতে পারে।
×