ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম;###;নগর পরিকল্পনাবিদ, সভাপতি : সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ;###;সাক্ষাতকার নিয়েছেন মারুফ রায়হান

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় : ঢাকার জলাবদ্ধতা

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় : ঢাকার জলাবদ্ধতা

ঢাকার খাল উদ্ধার জলাধার সংরক্ষণ এবং নদী রক্ষা- সবগুলোই জরুরী জনকণ্ঠ : ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য শহর বলা হচ্ছে। এটা কোন সময় থেকে বলা হচ্ছে এবং কিভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলো? অধ্যাপক নজরুল ইসলাম : আমরা যারা ঢাকা নিয়ে গবেষণা করি, তারা বহুদিন থেকেই এগুলো পর্যালোচনা করছি। সেই কবে শামসুর রাহমান কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এ শহর টুরিস্টের কাছে পাতে হাত’। ঢাকা বসবাসযোগ্য শহর নয়Ñ এমনটা ইদানীং বলা শুরু করেছে ঊপড়হড়সরংঃ পত্রিকা। ঊপড়হড়সরংঃ রহঃবষষরমবহঃ টহরঃ (ইৎরঃরংয) এ কাজটা করছে; তারা ১৪০টা শহর নির্বাচন করেছে মূল্যায়নের জন্য। মূলত ব্রিটিশ কিংবা ওয়েস্টার্ন যেসব পেশাজীবী বিভিন্ন দেশে কর্মসূত্রে যায়, তারা কোথায় কী রকম পরিবেশ, শহরগুলোর অবস্থা কী রকম তা নির্ণয় করে। একটা মান তারা নির্ধারণ করে দেয়। জাতিসংঘও এ কাজ করে। তাদের লোকজন বিভিন্ন দেশে পাঠায়। ফলে তারাও নির্ণয় করে কোন শহর কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তার ঝুঁকিতো থাকেই। এসব নির্ণয় করতে গিয়ে তারা অনেকগুলো সূচক পরিমাপ করে। যেমন এর একটা হলো ভৌত অবকাঠামো। আবার তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন। এরপর হলো বিদ্যুত, পানি ও পরিবেশ। পরিবেশের মধ্যে বায়ুদূষণ সবচেয়ে মারাত্মক, এরপর শব্দদূষণ, পানিদূষণ। পানিদূষণের বিষয়টি ওরা হয়ত তেমন গুরুত্ব দেয় না, কারণ ঢাকায় তারা নিজ দেশ থেকে বোতলজাত পানি নিয়ে আসে। তবে সাংস্কৃতিক পরিবেশও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন অনেক শহরের তুলনায় ঢাকা অনেক বেশি সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত। এখানে কোন দাঙ্গা হয় না। ইউরোপের শহরগুলোতে হয়। আমেরিকায় হয়। ঢাকার এই ইতিবাচক দিকটি ওদের সূচকের মধ্যে আসে না। ১৯৮৭ সালে একটা সার্ভের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ঢাকা বিষয়ে কতগুলো সূচক আমরা নির্ধারণ করেছিলাম। তার মধ্যে একটি হলো এক লাখ জনসংখ্যায় বছরে কয়টা খুন হয়। তখন সর্বোচ্চ খুনের হিসাব ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে, এক লাখে পঁয়তাল্লিশ। ঐ সময় নিউইয়র্কে এ সংখ্যা ছিল পঁচিশ, ঢাকায় ছিল মাত্র চার। কলকাতায় সর্বনিম্ন তিন। এখন ঢাকায় তা বেড়েছে, সন্দেহ নেই। এটাকে আমরা বলি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। আর একটি হলো গোষ্ঠীগত বা জাতিগত নিরাপত্তা। সেখানে কিন্তু আমরা খুব ভাল অবস্থানে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বেলায় আমরা বড় ঝুঁকিতে আছি। আর একটা হলো রাজনৈতিক অবস্থা। এবছর টানা তিন মাস বিএনপি যা করেছে, তাতে রেটিং অনেক নিচে নেমে গেছে। এখনও রেটিংয়ে আসে নাই জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টি। এখন যা বিভিন্ন দেশে হচ্ছেÑ ইরাকে, আফগানিস্তানে, সিরিয়ায়, পাকিস্তানে, এমনকি ইউরোপে। আপনি খেয়াল করে দেখবেনÑ বাংলাদেশে তেমন অর্থে বিদেশী কেউ খুন হয়নি। এটাতো ভাল দিক। তারপর হলো সংস্কৃতিচর্চা, উদারতা। এই যে ভাষাগত একটা, তারপরে যাপিত। এসব কিন্তু তারা তাদের হিসেবে নেয় না। এই যে পহেলা বৈশাখে সারা শহর প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একেবারে সর্বজনীন উৎসব। এটাও বিদেশীদের সূচকে নেই। এগুলো নিয়ে মাথাও ঘামায় না। হোটেলে সুব্যবস্থা আছে কিনা, এসব হলো তাদের বিচারে বাসযোগ্যতা। এখন মামুলি অর্থে সাধারণ লোকের কাছে বাসযোগ্যতা হলো ভৌত অবকাঠামো। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে আসে পরিবহন। যাতায়াত, যোগাযোগের সুবিধা-অসুবিধা। এখানে আমরা তিন-চারটা জিনিস দেখি যোগাযোগে। একটা হলো পরিবহন প্রাপ্তি, অর্থাৎ যখন দরকার তখন পাচ্ছি কিনা। তারপরে হলো খরচ। আমার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। তারপরে হলো নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্য। এ বিষয়গুলো সূচকে ধরা হয়। এ বিষয়গুলোতে আমাদের ভীষণ ঘাটতি। পরিবহন একেবারেই সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এসব বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান ১৩৯ ঠিকই আছে। জনকণ্ঠ: ১ সেপ্টেম্বরে দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে আমরা ঢাকার যে রূপ দেখলাম, এমন জলাবদ্ধতা গত কয়েক বছরে দেখি নাই। তার মানে দিন দিন পরিস্থিতি কি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে? অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: বাস্তবতা হলো আমরা বছর বছর আরও খারাপের দিকে যাচ্ছি। নতুন করে ড্রেন তৈরি করা হয়নি। যেগুলো আছে সেগুলোর সংস্কারও সঠিকভাবে হয়নি। মোট কথা হলো, প্রাকৃতিক খালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সবাই বলছে বক্স কালভার্ট করা ঠিক হয় নাই। ওয়াসার এমডি সাহেব বলছেন, এগুলো হারাম। আর এসব ড্রেন করব না। জনকণ্ঠ: একজন মেয়র বলছেন, বক্স কালভার্ট সব ভেঙ্গে ফেলা হবে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: এটা দুই একজন বলেছে, উনিও তাদের সঙ্গে বলেছেন। ভেঙ্গে ফেললেতো আবার ওপেন করতে হবে। বিরাট খরচ। আর ভেঙ্গে যদি নাও ফেলা হয়, এসব পরিষ্কার করতে হবে। সেটার জন্য যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। জনকণ্ঠ: হ্যাঁ, আমাদের আরেক মেয়র বলেছেন, ড্রেন পরিষ্কারের মেশিন কিনেছি। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: সেদিন দেখলাম এসব যন্ত্রপাতির রিমোট কন্ট্রোল রয়েছে। জনকণ্ঠ: এগুলো কি তাৎক্ষণিক সমাধান দেবে? অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: তাৎক্ষণিক সমাধান কিছুটা দেবে, তবে পরিষ্কার করাটা খুব জরুরী। বছরে একবারও নাকি এসব পরিষ্কার করা হয় না। দ্বিতীয়ত, জনগণ অচেতনভাবে বর্জ্য ফেলে এগুলো ভরাট করছে। নারকেল খোসা হোক, ডাব হোক, যে কোন ময়লা তারা ফেলে, এমনকি ইট-কাঠও ফেলে। নির্মাণসামগ্রীও ফেলে। এগুলো বিরাট সমস্যা। তাছাড়া প্রাকৃতিক খালগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। ৪৩টা খালের মধ্যে হয়ত ১০-১৫টা খাল আছে। সেগুলোরও ধারণ ক্ষমতা, প্রবাহ কমে গেছে। সংকুচিত, দখল হয়ে গেছে, স্থাপনা নির্মাণ হয়ে গেছে। তবে কিছু খাল এখনও আছে, যা ওয়াসা পুনরুদ্ধার করেছে। জনকণ্ঠ: ঢাকায় যে পরিমাণ মানুষ, যানবাহন, বহুতল ভবন এবং খালি জায়গার প্রচ- অভাব। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কি কেবল দুয়েকটা খাল উদ্ধার করে আমরা ঢাকাকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচাতে পারব? অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব বিদ্যমান খাল ও ড্রেনগুলোকে সচল রাখা হলে। এখনই উদ্যোগ নিলে এক বছরে করা সম্ভব। প্রাকৃতিক খালগুলো সচল রাখা খুব জরুরি। এসব খাল ও ড্রেনের প্রবাহ নদীতে ফেলা দরকার। নদী মানে ঢাকার চারপাশের চারটা নদী। জনকণ্ঠ: ঐ চারটা নদীও বেদখল। এসব তো উদ্ধার ও খনন করতে হবে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: হ্যাঁ, বেদখল হলেও কিছু তো আছে এবং সেগুলো এখন ড্রেজিং করে অথবা যেভাবেই হোক নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। এসব নিয়ে বিরাট আন্দোলন হওয়া দরকার। সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে, টাস্কফোর্স করা হয়েছে। আদালতের হুকুম আছে। সুশীল সমাজের একটা চাপ আছে। তারপরও হয় না। কিছু প্রভাবশালী দুষ্ট লোক তা হতে দেয় না বা অনবরত নষ্ট করে। নতুন করে আবার দখল করে। আমাদের যেসব সংস্থাগুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত, যেমন ঢাকা ওয়াসা, ডিসিসি, রাজউক এরা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এদের দিয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করানো জরুরী। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে কার্যকর করতেই হবে। জনকণ্ঠ : চৌদ্দটি সংস্থাকে নিয়ে টাস্কফোর্স করার কথা বলা হচ্ছে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: এটা কেউ কেউ বলেছে, চৌদ্দটা সংস্থা নাকি এর সঙ্গে জড়িত। তবে আমি এতগুলো দেখি না। আমি প্রধানত দেখি সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ), দ্বিতীয় ওয়াসা, কারণ ঢাকা শহরের ত্রিশ ভাগের জন্য তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। তৃতীয় বা এটা প্রথমেও আসতে পারেÑ রাজউক। এই যে আপনি প্রশ্নটা করলেন, এ শহরে এত মানুষ, এসব কিভাবে চলবে। এই দায়িত্বটা হলো প্রধানত রাজউকের। তাদের সীমানাই বেশি। সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব সীমিত অংশের। এখন রাজউকের দায়িত্ব হলো পুরোটা। ওরা জানে কিভাবে শহরটাকে সাজাতে হবে। সাজানো মানে কি? এই শহরের উন্নত এলাকা কি হবে, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট কিভাবে হবে। রাস্তা-ঘাটের এলাইনমেন্ট যদি ড্রেনেজ প্যাটার্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে ঠিক হবে না। তারপরে এই যে প্রগতি সরণি এটার ফলে এদিকের পানি ওদিকে যেতে পারে না। একটা দুটো কালভার্ট বা ব্রিজ আছে রামপুরায়। এটা কি যথেষ্ট, নাকি আরও লাগবে। তারপরে বিবেচ্য, ঢাকা হলো নিচু জায়গা। ভরাট করে সামান্য কিছু উঁচু জায়গা হয়েছে। বাকি যে নিচু জায়গা, চারদিকে জলাশয়গুলো সে জলাশয়গুলো সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন, পত্রিকায় এসেছে জলাশয় সব চলে যাচ্ছে আবাসনে। প্রথম দায়িত্ব হলো ড্রেনগুলোকে পরিষ্কার করা। দ্বিতীয় হলো স্বাভাবিক যে খাল তা চালু রাখা এবং তৃতীয় নদীগুলোকে সচল রাখা। নগরীর সমস্ত পানি পড়বে গিয়ে নদীতে। নদী যদি সচল না হয়, প্রবাহমান না হয়, তার গভীরতা না থাকে, সংকুচিত হয়ে যায়, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। একটা হলো খাল বা নদী, আরেকটা হলো স্থায়ী জলাধার বা নিম্নাঞ্চল। এছাড়াও আছে ছোট পুকুর, বড় পুকুর, লেক। পূর্ব ও পশ্চিম ঢাকায় আছে জলাভূমি, নিম্নাঞ্চল। বর্ষাকালে পানি জমে, শুকনো মৌসুমে আবার শুকিয়ে যায়। এই নিম্নাঞ্চলগুলো আমরা ভরাট করে ফেলেছি। এসব সংরক্ষণ করতে হবে। এখন বলা হয়, নগরীর ২৫ ভাগ খালি রাখ। জলাভূমি রক্ষা কর দীর্ঘমেয়াদে। এই দায়িত্ব হলো রাজউকের। মোট কথা ঢাকাকে জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে হলে ঢাকার খাল উদ্ধার, জলাধার সংরক্ষণ এবং নদী রক্ষাÑ সবগুলোই জরুরি। জনকণ্ঠ : শত ব্যস্ততার মাঝে আমাদের সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম: জনকণ্ঠকেও ধন্যবাদ। শ্রুতিলিখন: কামরুল হাসান চৌধুরী
×