ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেই সব শিশুর ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে

প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা নয়- প্রধানমন্ত্রী ॥ যুগান্তকারী ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা নয়- প্রধানমন্ত্রী ॥ যুগান্তকারী ঘোষণা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া টাকা লুটপাটের কারণেই দেশে সাক্ষরতার হার কমেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে অবৈধরা ক্ষমতায় আসার কারণে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা না নিতে সব স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের একটি মৌলিক অধিকার। নির্দিষ্ট বয়স হয়ে গেলে শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয়ে যাবে, ভর্তি নিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০০১ সালে বিশ্বব্যাংক সাক্ষরতার হার বাড়াতে গ্রহণ করা উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পে সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকা দেয়। বিএনপির আমলে এ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা এ কার্যক্রম আবার চালু করি। সরকারী হিসেবে দেশে বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। চেষ্টা চলছে এই হার বাড়ানোর। উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করে মানব পুঁজিতে উন্নীত করতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা না নেয়ার যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতে শিশুকে কেন পরীক্ষা দিতে হবে? শিশুকে যদি লিখতে-পড়তে শিখেই স্কুলে ভর্তি হতে হয় তাহলে স্কুল তাকে কী পড়াবে? তাছাড়া ক্লাস ওয়ানে ছাপানো প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হবে কেন? স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেই সব শিশু যাতে ভর্তি হতে পারে তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক রুহুল আমিন সরকার, ঢাকায় নিযুক্ত ইউনেস্কোর আবাসিক প্রতিনিধি বিয়াট্রিস কালডুন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উল আলম, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক রুহুল আমীন সরকার প্রমুখ। ১৯৯৬ সালের ১৭ নবেম্বর জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশুদের জন্য শিক্ষা হতে হবে আনন্দময়। প্রথম শ্রেণীতেই শিক্ষার্থীদের ওপর বই আর পড়ার বোঝা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এমন কোন পাঠ্যসূচী নেয়া ঠিক হবে না, যা শিশুদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে। বইয়ের বোঝায় শিক্ষার প্রতি তাদের যাতে অনীহা সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিক্ষা জীবনে প্রবেশ করতে কোমলমতি শিশুদের ওপর যেন কোন চাপ তৈরি না হয় তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিলে পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। বইয়ের বোঝা, তেমন পড়ার বোঝা এবং হোম ওয়ার্ক। এত বেশি হোম ওয়ার্ক দেয়া হয় যেদিন স্কুলে ঢুকল তার পরই স্কুল সম্পর্কে শিশুদের একটা ভীতি সৃষ্টি হয়ে যায়। এটা করা যাবে না। একটা বাচ্চা ৫ বছর বয়সে স্কুলে গেল, তখনই তাকে সব বিদ্যা শিক্ষা দিতে হবে তা নয়। বাচ্চারা তাড়াতাড়ি শিখে কিন্তু আগেই যদি বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে ধীরে ধীরে পড়াশুনার প্রতি একটা অনীহা সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। তাই খেলাধুলাসহ অন্য যেভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয় সে ধরনের উদ্যোগও তাদের জন্য নিতে হবে। শিক্ষক ও স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা মৌলিক অধিকার। আর এ অধিকার নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া নিরক্ষরতা কমাতে নানা উপ আনুষ্ঠানিক কর্মসূচীও রয়েছে সরকারের। সরকারী হিসেবে দেশে বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। চেষ্টা চলছে এই হার বাড়ানোর। জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সফলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করছে তার সরকার। প্রধানমন্ত্রী সরকারী স্কুলগুলোকে অবকাঠামোগত ও শিক্ষার মানগত দিক থেকে আরও উন্নত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এছাড়া দেশের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ আরও উন্নত করতে জরাজীর্ণ স্কুলগুলোকে সংস্কারের নির্দেশ দেন তিনি। এ বিষয়ে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শহর এলাকায় সব শ্রেণীর অভিভাবক যাতে সন্তানকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহী হন, সেজন্য এসব স্কুলের মানোন্নয়ন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরেই শিক্ষা কাঠামোকে এগিয়ে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এলাকাভিত্তিক সরকারী স্কুল করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সরকারী স্কুল করতে জায়গার অভাব রয়েছে। অবার অনেকে বেসরকারী স্কুল করেছে কিন্তু চালাতে পারছে না। কোন এলাকায় স্কুল নেই তা চিহ্নিত করে এলাকাভিত্তিক স্কুল হওয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা। জাতির পিতা বিশ্বাস করতেন, একটি শিক্ষিত প্রজš§ ছাড়া সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলা দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জাতির পিতাই ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তিনি ৩৬ হাজার ১শ’ ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭শ’ ২৪ জন শিক্ষকের পদ সরকারীকরণ করেন। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর শিক্ষা কমিশনের অন্যান্য সুপারিশ আর বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষাঙ্গনে নেমে আসে চরম নৈরাজ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর আমাদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশ। তিনি বলেন, দেশের সাক্ষরতা বৃদ্ধির বিশাল অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮’ লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর সরকারের সফলতা তুলে ধরে বলেন, ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নে আমরা অত্যন্ত সফল। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে মানবপুঁজিতে উন্নীত করতে পারলে উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সবার জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা থাকলেও ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি আমরা নিশ্চিত করেছি। প্রতি বছরের মতো এবারও বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি নতুন পাঠ্যবই বিতরণ করেছি। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ঝরেপড়া রোধে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। মিড-ডে মিল চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল স্কুলে মিড-ডে মিল চালু করা হবে। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসাবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে।
×