ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

মৃত আয়লানই বাঁচিয়েছে হিউম্যান ক্যাটাস্ট্রফি

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মৃত আয়লানই বাঁচিয়েছে হিউম্যান ক্যাটাস্ট্রফি

জনসমুদ্রে জেগেছে জোয়ার, হৃদয়ে আমার চড়া। চোরাবালি আমি দূরদিগন্তে ডাকি... কোথায় ঘোড়সওয়ার? .......... জনসমুদ্রে উন্মথি কোলাহল ললাটে তিলক টানো। সাগরের শিরে উদবেল নোনাজল, হৃদয়ে আধির চড়া। চোরাবালি ডাকি দূরদিগন্তে, কোথায় পুরস্কার? [ঘোড়সওয়ার (অংশ)। বিষ্ণু দে] আবদুল্লাহ-রিহানের দুই শিশুপুত্র গালিব, আয়লান। সমুদ্রে সলিলসমাধি। আয়লান জলের ঢেউয়ে ভেসে বালুকাকূলে শায়িত। শরীর অক্ষত, অবিকৃত। পরনের পোশাক, পায়ের জুতো হুবহু সেঁটে আছে। যেন এইমাত্র পরে বালুকাবেলায় ঘুমিয়েছে। তিন বছরের ফুটফুটে সুন্দর আয়লানের এই মৃত্যু এবং মৃত্যু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি, বিশ্বময় মিডিয়ায় প্রচারিত। বিশেষত টিভির পর্দায়। মানবতার এই দুঃসহ চিত্রে মানবিক হৃদয়, বিবেক হুহু করে কেঁদেছে। বহু পিতামাতা সহ্য করতে পারেননি। এই দৃশ্য জার্মান টিভি চ্যানেলে, সংবাদ পরিক্রমায় দুইবার দেখানোর পরেই তীব্র ঝড় ওঠে। টিভি চ্যানেলগুলো বাধ্য হয় বন্ধ করতে। বন্ধ করলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। আয়লান মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত জার্মানিসহ ইউরোপ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শরণার্থী প্রবেশ নিয়ে খুব যে বিচলিত, মনে হয়নি আদৌ। এমনকি, ২৮ অগাস্ট, হাঙ্গেরি-অস্ট্রিয়া সড়ক সীমান্তে ট্রাকের ভেতর ৭১ জনের শ্বাসরুদ্ধ মৃত্যুতেও। আয়লানের মৃত্যুর চিত্র সব ওলটপালট করে দিয়েছে। জার্মানির ৭৬ ভাগ মানুষ নতুন করে (গত বছরই চার লাখের বেশি এসেছে) অভিবাসী, শরণার্থীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছিল, মুহূর্তে জনমত পাল্টেছে। পাল্টিয়েছে মৃত আয়লানের চিত্র। জার্মানির বহুল প্রচারিত দৈনিক বিল্ড (প্রচার সংখ্যা সাড়ে ৩ মিলিয়ন) লিখেছে, আয়লানের মৃতচিত্র দেখে চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মেরকেল চোখের জল মুছেছেন। খবরের সঙ্গে অবশ্য ছবি নেই। জার্মান ভাষায় বিল্ড মানে ছবি। বিল্ড-এর প্রায় প্রতিটি খবরের সঙ্গে ছবি থাকে। ফ্রাউ মেরকেল নিঃসন্তান। আয়লানের মৃত ছবি দেখে মাতৃত্বের হৃদয়ে বিপুল আঘাত হেনেছে, সন্দেহ নেই। অন্যদিকে আছে জনমত, উপেক্ষা করা কঠিন। উপরন্তু, আগামী বছরই নির্বাচন। শরণার্থী নিয়েও রাজনীতি, এই মুহূর্তে। ফ্রাউ মেরকেলের রাজনীতির ঘিলু অতিশয় পোক্ত এবং প্যাঁচালো, জানেন, কখন চটজলদি ডিসিশন নিতে হয়, পরে কিভাবে সমস্যার সামাল দেবেন, সময়মতো স্ট্রাটেজি ঠিক করেন। গত পঁচিশ বছর ধরে তাকে চিনি। যে হেলমুট কোল (প্রাক্তন চ্যান্সেলর) তাকে হাতে ধরে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন, পরিবার-পরিকল্পনার মন্ত্রী করেন (খুব রসিকতা চাউর হয় তখন, দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও নিঃসন্তান, ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর কি জানেন!) পরে প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী। দুই মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন বার চারেক ইন্টারভিউ করেছি ডয়েচে ভেলের জন্যে। তাঁকেই চাণক্যবুদ্ধির প্যাঁচে-কৌশলে সরিয়েছেন। সিরিয়া-লিবিয়া-ইরাক শরণার্থী সমস্যা সমাধানে তিনি কেন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সহজেই অনুমেয়। জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নে মাতব্বর, মাতব্বরি আসনে ফ্রাউ এ্যাঙ্গেলা মেরকেল। জার্মানি ইউরোপের পয়লা ধনী দেশ। দেশ হিসেবেও বড়ো। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানির সদস্য সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং ইইউ পরিচালনায়, তথা খরচায় জার্মানির অর্থ ৫০ ভাগের বেশি। অতঃপর ফ্রান্সের। কিন্তু, জার্মানি যা বলবে, নানা তর্কবিতর্ক শেষে ইইউর বাকি দেশগুলো তা মেনে নেবে (একমাত্র ব্রিটেন ছাড়া)। ব্রিটেনের দায়ও খুব কম। ভাবটা, আছি। না থাকলেও কিচ্ছু যায়-আসে না। তো, এত মাখামাখি, সঙ্গে পাছে থাকার কি দরকার। প্রয়োজনে একটু নাক গলাব, এই যা। ব্যাস, ল্যাঠা চুকে গেল। সাতপাঁচ ঝামেলার মধ্যে নেই। যেমন গ্রিসের বেলআউটে (আর্থিক পুনরুদ্ধারে) বা সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেই দিয়েছেন ১৫০০ শরণার্থী আশ্রয় দেবেন এবং যাচাই করে দেখবেন, আশ্রয়প্রার্থীরা আদৌ আশ্রয়প্রার্থীর যোগ্য কিনা! তার বিদেশমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড আরও এক কাঠি সরেস। বলেছেন, ওঁরা (শরণার্থীরা) ইউরোপের উন্নত জীবনযাত্রার মান-পরিবেশ কালিমাযুক্ত করতে চায়। আফ্রিকার অগণিত শরণার্থীকে যদি আশ্রয় দেয়া হয় ইউরোপ গরিমা হারাবে, গরিমায় ভাটা পড়বে, গরিমা রক্ষা করতে পারবে না (১০ অগাস্ট ২০১৫। দ্য গার্ডিয়ান)। মিস্টার হ্যামন্ড হয়তো ভুলে গিয়ে থাকবেন, আফ্রিকা-এশিয়ার রক্ত চুষেই ব্রিটেন নির্মিত, ব্রিটেনের চাকচিক্য, জৌলুস। ফ্রাউ এ্যাঙ্গেলা মেরকেল কাউকে তোয়াক্কা না করে (ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি দেশগুলোকে) গ্রিসের পক্ষে অবস্থান নেন, আর্থিক পুনরুদ্ধারে গোঁ ধরেন, ধরে, হিরো হয়ে যান, একই মেজাজে শরণার্থী সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার ঝাঁপাঝাঁপি এতটাই যে, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিককে শুনতে হয়, এটা আমাদের ঘরের (ইউরোপীয় ইউনিয়নের) সমস্যা, মানবিক সমস্যা। উপেক্ষা করতে পারি না। আর কোন আয়লানের মৃত্যু দেখতে চাই না। ৮ লাখ শরণার্থীকে (এর মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের আছে। সংখ্যায় কম।) আশ্রয় দিচ্ছি, প্রয়োজনে আরও দেব। আরও দেয়া নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার কোন প্রশ্ন করেননি। করতেই পারতেন। সিরিয়া থেকে আরও এক মিলিয়ন শরণার্থীর স্রোতের আশঙ্কা, ইরাক, লিবিয়া থেকে পাঁচ লাখের বেশি। হয়তো এই বছরেই। প্রত্যেকের লক্ষ্য জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি ধনী দেশ। ইইউ জমিনে একবার ঢুকলে ঠাঁই দিতে বাধ্য। সমস্যা দাঁড়াচ্ছে এখানে। ডাবলিন রেগুলেশনে যে নিয়ম অতিশয় বিতিকিচ্ছিরি, গোলমেলে। রচিত হয় ১৯৯০ সালে (সেপ্টেম্বরে)। তখনই সমালোচনার ঢেউ। কিন্তু ডাবলিন রেগুলেশন এখনো বহাল। আশ্রয়প্রার্থী যে দেশে ঢুকবে, সেই দেশ ছাড়পত্র দেবে ইউরোপের অন্য কোনো দেশে প্রবেশাধিকার পাবে কিনা। ৯৯.০৯ ভাগ দরখাস্তই বাতিল। ফলে, উদ্বাস্তু বা শরণার্থীর বিপদ সমূহ। এই নিয়ম, সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু স্রোতে বিপুল বাধা হয়ে দাঁড়ায়, মহাসমস্যায় পড়ে হাঙ্গেরি। দিশেহারা। কি করণীয় কূল পায় না। বুদাপেস্টের আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন কেলেটিতে দেখি ভয়ঙ্কর অবস্থা। আন্তর্জাতিক বটে (শিয়ালদহ স্টেশনের চেয়েও ছোট), কিন্তু ঠাঁই নেই শরণার্থীর স্টেশনের ভেতরে, বাইরে। হাজার-হাজার শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে সড়কে (ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী, দালাল, খাবার বিক্রেতা, পকেটমার, বেশ্যার দালালের ছড়াছড়ি।) এক গ্লাস জলের দাম দশ গুন। অনেক হাঙ্গেরিয়ান সাহায্যকারী, যারা হিউম্যান রাইটস নিয়ে লড়ছেন, সংখ্যায় কম। একজন বললেন, আমরা দিশেহারা। কতজনকে সাহায্য করবো। প্রত্যেকে সাহায্যপ্রার্থী। শিশুদের দেখলে দিশেহারা হবেন, অসহায় মুখ। চোখে জল। কান্নাও ভুলে গেছে। মানবিকতার চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয়কেই মূলধন করেছে শরণার্থীরা। লক্ষ্য করি, শিশুর অসহায়ত্ব আরও বেশি দরদী, মানবিকতা করার হরেক কৌশল, আকুতি। আপনি অসহায়, দিশেহারা। শরণার্থীর হিউম্যান রাইটস (জাতিসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী) নিয়ে সোচ্চার। এই সোচ্চারে হাঙ্গেরির সরকার বাধ্য হয়েই শরণার্থী পাঠায় অস্ট্রিয়ায়, বাসে ও ট্রেনে। হাঁফও ছাড়ে। শরণার্থীর মূল গন্তব্য অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইউরোপের ধনী দেশে। অধিকাংশের জার্মানি। শরণার্থীর কন্ঠে জার্মানি, জার্মানি। জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয় হিসেব কষে বলছে, ভয়াবহ বিপদ। কোত্থেকে অর্থের জোগান হবে? এই লাখ-লাখ শরণার্থীর ভরণপোষণে বছরে খরচ ৪৯৩ মিলিয়ন ইউরো। সাধারণ মানুষকে দিতে হবে অতিরিক্ত ট্যাক্স। আমরা জানি, মাস কয়েক পরেই ট্যাক্স বাড়বে। বিপদ ঘনীভূত হবে আরও। দোষী হবে শরণার্থী তথা বিদেশী। শনৈঃ শনৈঃ বাড়বে বিদেশী বিদ্বেষ, অপেক্ষায় আছে নিওনাতসি, চরম দক্ষিণপন্থীরা। ইতোমধ্যেই একজোট। পুড়িয়েছে বহু শরণার্থীর হাইম (বাসস্থান)। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ডে গত কয়েকদিনে দক্ষিণপন্থীরা শরণার্থীর বিরুদ্ধে মিছিল করছে, মিছিলে জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে । বাড়ুক। কিন্তু, জনজোয়ারে আজ নতুন জোয়ার। ঢেউ। উদ্বাস্তুর ঢেউ। পুরস্কার। এই পুরস্কারে চোরাবালি শক্তভূমি। শরণার্থী ছাড়া ইউরোপসহ জার্মানির পুরস্কার নেই। গত তিরিশ বছরে ইউরোপের পরিবার সমাজের হেঁসেলে ঢুকে দেখেছি। ইউরোপে শরণার্থী ঢুকবেই। দোষ ইউরোপেরই। কারণ ঐতিহাসিক। বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই। যেমন বেঁধেছে এখন। ছোট ছেলেদের চকলেট, লজেন্চুস (যেমন দিয়েছে জার্মান সরকার) দিয়ে ভুলিয়ে লাভ নেই। ছোটরাও বড়ো হবে। তখন? জার্মানি থেকে লেখক : কবি
×