ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

লেন-দেনের স্লোগান ও ঈমানী স্লোগান

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

লেন-দেনের স্লোগান ও  ঈমানী স্লোগান

আজ থেকে ২৫ বছর আগে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে খুলনা যাই। এর আগে যে খুলনা যাইনি, তা নয়। স্বাধীনতার পর পর গিয়েছিলাম একবার কি দু’বার। নির্মূল কমিটির কোন সভা ছিল হয়ত। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছিলেন। প্রেসক্লাবে যাওয়ার পথে সড়কের নাম চোখে পড়ল, বড় বড় হরফে লেখাÑ খান এ সবুর রোড। বললাম, ‘শাহরিয়ার এ কী?’ ‘এটা তো যশোর রোড বলেই জানতাম’, জানাল শাহরিয়ার। ‘হ্যাঁ, ঐতিহাসিক যশোর রোডের একটি অংশ। কিন্তু, খান এ সবুর রোড হলো কিভাবে?’ শাহরিয়ারও কিছু জানে বলে মনে হলো না। প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদেরও প্রশ্ন করলাম, কেউ সদুত্তর দিলেন না। মনে হলো এ বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলতে চান না। খুব অবাক হলাম। বাংলাদেশের একটি বিভাগীয় শহরের সবচেয়ে বড় রাস্তাটা খান এ সবুরের নামে! অথচ, খুলনাবাসী তা সানন্দে মেনে নিয়েছে। খুলনায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল আছে, বাম দলগুলো আছে, আওয়ামী লীগ আছে। জানলাম, এ বিষয়ে সবার ঐকমত্য আছে। নিজেরই লজ্জা লাগল। ভেবেছিলাম, ১৯৭১ সালে আমরা একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনে সমর্থ হয়েছি। এখন দেখলাম, আমরা সম্পূর্ণভাবে জাতিরাষ্ট্র গঠনে সমর্থ হইনি। লজ্জায় বলেছিলাম, এ শহরে আসতে চাই না, যে শহরে খান এ সবুর রোড দিয়ে ঢুকতে হবে। যাই-ও নি। এক দশক পর, শাহরিয়ারের আবার জোরজবরদস্তিতে গেলাম। শাহরিয়ার বলল, অনেক জায়গাই এ অবস্থা, খুব সম্ভব ঢাকা ছাড়া। তাহলে কি আমরা ঢাকাতেই থাকব? তারপর যতবার গেছি ততবারই আলোচনা সভা বক্তৃতায় বলেছি, আপনারা মেয়রকে বলুন, আন্দোলন করুন। এটা চলতে পারে না। সবাই জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে খান এ সবুর রোড ধরে হৃষ্টমনে বাড়ি ফিরেছে আর ভেবেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করছে। এ ধরনের নামকরণ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিরই অংশ। এর লক্ষ্য, মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নসমূহ অবলুপ্তকরণ যাতে মুক্তিযুদ্ধের সেই উজ্জীবনী শক্তিটা না থাকে। পরে খবর নিয়ে জেনেছি, অনেক জায়গায় অনেক স্থাপনা রাজাকারদের নামে হয়েছে। [আমি খুলনায়ও টিভিতে বলেছিলাম, চট্টগ্রামে একটি রাস্তা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে হয়েছে। পরে জানলাম তা তথ্যগত ভুল। এ জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী]। সবাই তা মেনে নিয়েছে। এ ধারায়ই প্রথম ষড়যন্ত্রটা হলো বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে নাজিমুদ্দিনের কবর দেয়া। সেখানে কবর দেয়া হয়েছিল একে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীকে। মাঝখানের জায়গাটুকুতে খাজা নাজিমুদ্দিনের মৃত্যু হলে তার কবর দেয়া হয়। খাজা বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন। যুক্তফ্রন্টের আমলে বাংলা একাডেমি চালু করা হয় তার বাসভবনে। এখন তার উল্টোদিকে বাংলা ভাষার বিরোধী নাজিমুদ্দিনের কবর। এরপর দেখি নামকরা রাজাকারদের মৃত্যু হলে জাঁকজমকের সঙ্গে সংসদ ভবন চত্বরে তাদের কবর দেয়া হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করেনি। আজ সংসদীয় ব্যবস্থা চলছে আর তার চত্বরে বাংলাদেশ বিরোধীদের কবর শোভা পাচ্ছে। একইভাবে জিয়াউর রহমানকে সেখানে কবরস্থ করে স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে। জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের স্মৃতিসৌধের ভিত্তি তুলে ফেলা হয় যা স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেখানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, ইন্দিরা মঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল, যেখানে ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, বেছে বেছে সেখানেই শিশুপার্ক করলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু সেখানে স্বাধীনতা স্তম্ভের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর কন্যার সময় এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল শিশুপার্ক, থানা ও অন্যান্য স্থাপনা এখান থেকে সরাতে হবে। কেননা, এটি ঐতিহাসিক স্থান। সরকার এটি মানতে ইচ্ছুক নয়। শিশুপার্ক ওসমানী উদ্যানে সরানো যেতে পারে যেটি এখন মাদকসেবীদের আস্তানা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে অডিটরিয়ামের নাম রাখা হলো শাহ আজিজুর রহমান হল। সেখানে ছাত্রশিবির যেমন আছে, অন্যান্য দলও আছে। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ জানায়নি। ইসলামীকরণের নামে বঙ্গভবনে কোরানের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে আরবীতে বিমানবন্দরের নাম লেখা হয়েছে, যাতে বোঝা যায় আমরা মুসলমান। বাঙালী মুসলমানের মতো হীনম্মন্যতায় আর কোন দেশের মুসলমান ভোগে বলে মনে হয় না। মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মারডেকা স্কোয়ার দেখুন, কি ছিমছাম। মারডেকা স্কোয়ারের দীর্ঘ স্তম্ভটি শিবলিঙ্গের প্রতীক। আরবীতে কোন কিছু লেখার প্রয়োজন হয়নি। কুয়ালালামপুরেও তাই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এগুলো তেমন কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু অনেক কিছু। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি বিলুপ্ত, হয়ে যাচ্ছে বিলুপ্ত, দেশ এখন দু’ভাগে বিভক্ত। স্বাধীনতার পক্ষের ও স্বাধীনতার বিপক্ষের। যারা বিপক্ষের তাদের চ্যালেঞ্জটা এ রকম যে, আমাদের স্থান যদি না থাকে দেশে বা আমরা যদি অপাঙ্ক্তেয় হই বা মানুষের মনে যদি আমাদের জন্য দরদ না থেকে থাকে, তাহলে আমরা আছি কিভাবেÑ স্মৃতিসৌধে, সড়কে, স্থাপনায়? এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য। প্রতিক্রিয়াশীলরা বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যখন কিছু করে তখন সরাসরি করে ফেলে; কেউ বাধা দেয় না বা বাধা দেয়ার সাহসও রাখে না। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরাসরি কিছু করতে পারে না; চিন্তা-ভাবনা করে, করবে কি করবে না, ভাবে অনেক কিছু। এবং যখন কিছু করেও তা প্রতিপক্ষের অনুসরণেই করে। দু’একটা উদাহরণ দিই। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম ছিল ঢাকা বিমানবন্দর। বিএনপি বা এরশাদের আমলে [আমার ঠিক মনে নেই] এর নাম হয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ক্ষণিকের জন্য পর্যটন ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলে, বিমানের অভ্যন্তরের ঘোষণায় আবার ঢাকা বিমানবন্দর হিসেবে বিমানবন্দরটিকে অভিহিত করা হতে থাকে। বিমানবন্দরের নাম সরকারীভাবে তখনও বদল হয়নি, সাইনবোর্ডও সরানো হয়নি। মিডিয়ায় তখন এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। আবার তখন বিমানবন্দর জিয়া বিমানবন্দর নামে অভিহিত হতে থাকে। চট্টগ্রামের বিমানবন্দরের নাম করা হয় এমএ হান্নান বিমানবন্দর। ওবায়দুল কাদের তখন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। আমাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। তিনিই দেখেছি ঝটপট অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সুফিয়া কামাল মারা গেছেন। গেছি তাঁর বাসায়। মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরও গেছেন শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। আমাকে বললেন, মুনতাসীর, খালাম্মার [সুফিয়া কামাল; আমাদের সর্বজনীন খালাম্মা] জন্য কিছু একটা করতে হয়। কি করা যায় বলুন তো তাড়াতাড়ি। তাঁর মধ্যে সব সময় তাড়াহুড়োর একটা ভাব আছে। আমি বললাম, যারা আপনাদের ক’জের [পধঁংব] জন্য বা প্রগতির জন্য লড়াই করেছেন তাদের জন্য তো কিছুই করা হয় না। এক কাজ করুন, পাবলিক লাইব্রেরির নাম সুফিয়া কামাল গণগ্রন্থাগার ও অডিটরিয়ামের নাম শওকত ওসমান অডিটরিয়াম রাখুন। ওবায়দুল কাদেরের একটি গুণ, পরামর্শ মনে ধরলে ঝটপট করে ফেলেন এবং এর জন্য নিজের কৃতিত্বও দাবি করেন না। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তিনি পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। মিডিয়ার মতামত অনুসারে বিখ্যাত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর নাম বদলে দিয়ে বলেছিলেন, কোথাকার কোন্ নজরুল ইসলাম! মিডিয়ার তো লেজ বাধা প্রতিক্রিয়ার কাছে, তাই এ নিয়ে তেমন শোরগোল পড়েনি। না হলে তারাও লিখত, কোথাকার কোন্ সাইফুর রহমান! সাধারণ এক এ্যাকাউন্ট্যান্ট। স্বৈরশাসকের কৃপায় অর্থমন্ত্রী। আমরা দু’একজন যারা পত্রিকায় লিখি তারাই প্রতিবাদ করেছিলাম। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে প্রথমেই এ সমস্ত নাম বদলে ফেলে। জনকণ্ঠ, ডেইলি স্টারÑ এ রকম দু’একটি পত্রিকায় এর সমালোচনা বেরিয়েছিল বা আমরা লিখেছিলাম। তারপর সব নিশ্চুপ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জিয়া বিমানবন্দরের নাম বদলে শাহজালাল বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানতের নাম [যা বিএনপি দিয়েছিল] তা কিন্তু বদল হয়নি। খুব সম্ভব, সরকারী এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বাকি সব স্থাপনার নাম যা বিএনপি আমলে বদল হয়েছিল তা পুনর্বহাল হবে। শাহ আমানতের নাম এমএ হান্নান কেন রাখা হলো না? কারণ, সেই বিরোধিতার ভয়। সেই ভোটের ভয়। ১৯৭১-৭৫ যে ভয় ছিল না। ধর্ম তারাও ব্যবহার করেছিল, আমরাও করলাম। আপত্তিটা সেখানে। সুতরাং, স্বীকার করে নিতে হবে স্বাধীনতা বিরোধীরাও এখন শক্তি। তাদের কনস্টিটিউয়েন্সি ব্যাপক। চলবে...
×