ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিন লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে পথে পথে ঘুরছে;###;একমাত্র সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেই উদ্বাস্তু ৪ লাখ লোক

ভয়াবহ উদ্বাস্তু সঙ্কট ॥ মানবতা কাঁদছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ভয়াবহ উদ্বাস্তু সঙ্কট ॥ মানবতা কাঁদছে

কাওসার রহমান ॥ চার দিনের লাগাতার ক্ষোভ-বিক্ষোভের পর অবশেষে দরজা খুলেছে বুদাপেস্টের। গত শুক্রবার গভীর রাতে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে আটকে থাকা শরণার্থীদের জায়গা দেয়ার কথা ঘোষণা করে অস্ট্রিয়া। তার পর থেকেই বুদাপেস্টে শুরু হয়েছে শরণার্থীদের বাসে অস্ট্রিয়ার সীমান্তে পৌঁছে দেয়ার প্রক্রিয়া। এতে প্রাথমিকভাবে জট কেটেছে হাঙ্গেরিতে। তবে ইউরোপের শরণার্থী সঙ্কটের সমস্যার সিকিভাগও যে এখনও সমাধান করা যায়নি তা স্বীকার করে নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। তারা জানাচ্ছেন, শুধু অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি নয়, এই উদ্যোগে হাত মেলাতে হবে গোটাবিশ্বকে। এত মানুষকে জায়গা দিতে হলে হাত বাড়াতে হবে সকলকে। না হলে আয়লানদের বাঁচানো যাবে না! তুরস্কের উপকূলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিশু আয়লানের ছবিই জানান দিচ্ছে ইউরোপের শরণার্থী সঙ্কট কতটা গভীর। বুদাপেস্টে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের এই চেষ্টা শুরু হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশে শরণার্থী সঙ্কট এখনও কাটেনি। তবে অন্ধকার কাটছে না ইউরোপের। হাজার হাজার শরণার্থীর কাতর আর্তি এবং বিভিন্ন দেশে কার্যকর নিরাপত্তা বিধিতে সিঁদুরে মেঘ দেখছে ইউরোপ। পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকায় জঙ্গীদের হাতে গণহত্যা এবং তার জেরে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘর ছাড়ার ঘটনায় আদতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অন্ধকার যুগের ভূত দেখতে শুরু করেছে ইউরোপ। বলা হচ্ছে, চল্লিশের দশকের পরে এমন উদ্বাস্তুু সমস্যা বিশ্বে আর হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মমাফিক বুদাপেস্টেই গত শনিবারও জার্মানি যাওয়ার ট্রেনে তোলার নাম করে শরণার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে আশ্রয় শিবিরে। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন দেশে, শরণার্থীদের ধরে ধরে তাদের গায়ে পার্মান্যান্ট মার্কার দিয়ে নম্বর লিখে দেয়া হয়েছে সেøাভাকিয়ায়। সব মিলিয়ে ঘরছাড়াদের ভিড় এবং তাদের হটাতে এই পুলিশী তৎপরতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদী নিধন এবং তার পরের অন্ধকার সময় মনে করিয়ে দিচ্ছে ইউরোপকে। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা আগেই টেনেছে জাতিসংঘ। এই সংস্থা তথ্য দিয়েছে, তিন লাখেরও বেশি মানুষ ইতোমধ্যে সমুদ্র পেরিয়ে ইউরোপে আশ্রয়ের খোঁজে পৌঁছেছেন। কিছু মানুষ এসেছে লিবিয়া থেকে ইতালিতে। আর কিছু মানুষ তুরস্ক হয়ে গ্রিসে পৌঁছেছে। নৌকাডুবি এবং সার্বিয়া আর ম্যাসিডোনিয়ার কঠিন রাস্তা পেরোতে মৃত্যু হয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি শরণার্থীর। এ দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার শরণার্থী সঙ্কটের কথা। বলা হচ্ছে, চল্লিশের দশকের পরে এমন উদ্বাস্তু সমস্যা বিশ্বে আর হয়নি। ইতোমধ্যে মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা বলতে শুরু করেছেন, শরণার্থীদের ট্রেনে চাপিয়ে আশ্রয় শিবিরে বা অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চল্লিশের দশকের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। রবিবার অবশ্য বুদাপেস্টের পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ওয়ার্নার ফেম্যান তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে হাঙ্গেরিতে আটকে থাকা শরণার্থীদের জায়গা দিতে রাজি হয়েছে অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি। হাঙ্গেরির পুলিশ রাতেই শরণার্থী শিবিরে এসে সে কথা ঘোষণা করে। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লাগামছাড়া উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন সেখানে আটক শরণার্থীরা। রাত একটার মধ্যে ‘ট্রানজিট সার্ভিস’ লেখা ৪০টি বাস এসে পৌঁছে ওই শিবিরে। পাশাপাশি বুদাপেস্টের কেলেটি স্টেশনের সামনে অপেক্ষারত শরণার্থীদেরও সেখানে নিয়ে আসা হয়। শুরু হয় হেলিকপ্টারে নজরদারি। প্রথমটায় অবশ্য গোটা বিষয়টা বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল শরণার্থীদের। যে পুলিশ এতদিন স্টেশন থেকে হিঁচড়ে বের করে এনেছে তাদের, আজ তারাই কেন বাসে সীমান্তে পৌঁছে দিতে চাইছে? তাই বাসে উঠতে প্রথমে অস্বীকার করেন অনেকে। পুলিশকে জানান, সীমান্তের নামে পুলিশ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে তারা সন্দিহান। তবে পরে বাসে উঠতে রাজি হন তারা। পুলিশ জানিয়েছে, রাত দুটোর মধ্যেই বুদাপেস্ট থেকে ৪০টি বাস সীমান্তের দিকে রওনা হয়। ভোর পাঁচটার মধ্যে ছ’টি বাসে সেখানে পৌঁছে শ’চারেক শরণার্থী। আর অস্ট্রিয়া পৌঁছে রীতিমতো উৎসবে মাতেন বাসযাত্রীরা। হাততালি দিয়ে, গান গেয়ে ধন্যবাদ জানাতে থাকেন অস্ট্রিয়ার প্রশাসনকে। বাসের পাশাপাশি ট্রেনেও রবিবার সকালে হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়া পৌঁছেছে কয়েক হাজার শরণার্থী। এদিন সকালে নিজের ফেসবুক পেজে ওয়ার্নার ফেম্যান জানিয়েছেন, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান এবং জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মের্কেলের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। বুদাপেস্টে আটকে থাকা শরণার্থীদের না সরালে গোটা ট্রেন চলাচল ব্যবস্থাই স্থবির হয়ে পড়ত। সে জন্যই যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অস্ট্রিয়ার প্রশাসন জানিয়েছে, রবিবার সকালের মধ্যেই হাজারতিনেক শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি, প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, যারা অস্ট্রিয়ায় থাকতে চান না, তাদের জার্মানি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও করবে প্রশাসনই। সিরিয়ার এই গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিম ইউরোপে শরণার্থীর ঢেউ আছড়ে পড়াকে ইউরোপের অন্ধকারময় সময় বলে আখ্যা দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। অস্ট্রিয়া ও জার্মানি আপাতত কিছু শরণার্থীকে ঠাঁই দিলেও এই অভূতপূর্ব সমস্যা কীভাবে সামলানো যাবে তা নিয়ে এখনও ঐকমত্য হয়নি। তবে তুরস্কের বদরামের সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা ছোট্ট আয়লানের দেহ বিশ্ব জনমতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগেও শরণার্থীদের দুরবস্থা, মৃত্যুর খবর এলেও এই মৃত্যুটি যেন প্রতীকী হয়ে উঠেছে। সব বাদানুবাদ ছাপিয়ে আয়লান কুর্দির মৃতদেহের ছবি বিশ্বজুড়ে গভীর আবেগের জন্ম দিয়েছে। আয়লান কুর্দির নিথর দেহের ছবি ব্রিটেনসহ ইউরোপের সব দেশের সংবাদপত্র, টিভিতে ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে। এই একটি ছবি যেন চলমান এই শরণার্থী সঙ্কটের ভয়াবহ এবং করুণ চিত্রটি সামনে তুলে ধরেছে। পাঁচ বছরের শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ নৌকাডুবির পর সৈকতে ভেসে আসে। তুর্কি কোস্টগার্ড জানিয়েছে, সিরিয়া থেকে আসা একদল শরণার্থী তুরস্ক হয়ে গ্রিসের কস দ্বীপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যাত্রাপথে সাগরে নৌকাডুবিতে ১২ জন মারা যায়। পাঁচ বছর বয়সী আয়লান কুর্দি ছিল সেই দলে। নৌকাডুবিতে সে তার মায়ের সঙ্গে প্রাণ হারায়। শিশুটির এক খালা থাকেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে। তিনি জানাচ্ছেন, এই পরিবারটি সিরিয়ার কোবানে শহরে থাকত। সেখানে আইএস জঙ্গীদলের সঙ্গে সরকারী বাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার পর তারা পালিয়ে তুরস্কে আসে। সেখান থেকে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে কর্তৃপক্ষ তাদের শরণার্থী আবেদন নাকচ করে দেয়। এর পর এরা তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছার চেষ্টা করছিল। নৌকাডুবিতে পরিবারটির ১২ সদস্য মারা গেছে। শুধু গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে শিশুটির বাবা। তাই প্রাথমিকভাবে কঠোর হলেও আপাতত নমনীয় পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর শরণার্থীদের সাহায্য করতে ব্যবস্থা নিচ্ছে নানা দেশের প্রশাসন। এগিয়ে এসেছে নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। গত শুক্রবার শরণার্থীভরা ট্রেন আটকে দিয়েছিল হাঙ্গেরি। কোথাও আবার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, কোথাও শরণার্থীদের ভুল বুঝিয়ে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল বেশ কিছু দেশ। কিন্তু সঙ্কটের বিস্তার দেখে মনোভাবে বদল এসেছে। শনিবারই শরণার্থীদের বাসে করে অস্ট্রিয়ার সীমান্তে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে হাঙ্গেরি সরকার। এদিন পাঁচ হাজার শরণার্থী নিকেলসডর্ফ সীমান্ত দিয়ে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে। আরও ছ’হাজার শরণার্থী অস্ট্রিয়ায় আসবে বলে জানিয়েছে অস্ট্রিয়ার প্রশাসন। জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেনও এরই মধ্যে আরও বেশি করে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। জার্মানি ইতোমধ্যে আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেবার কথা ঘোষণা করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরান ও আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের মধ্য থেকে ইউরোপের প্রত্যেক দেশকেই সর্বোচ্চ দুই লাখ অভিবাসীকে স্থান দেয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা। কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে রাজি নয় মধ্য ইউরোপের সকল দেশ। এর মধ্যে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিকান, সেøাভাকিয়া ও হাঙ্গেরি রয়েছে । যদিও ওই প্রস্তাবের পক্ষে রয়েছে জার্মানি ও ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় কমিশন। আর্থিক সঙ্কট, বেকার সমস্যা, অনুন্নয়ন এমন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত মধ্য এশিয়ার নানা দেশ। এর পরে যোগ হয়েছে একের পর এক দেশে গৃহযুদ্ধ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আকার নিয়েছে সিরিয়া। প্রায় দু’বছরের ওপর চলা এই যুদ্ধে ঘর ছেড়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে জর্দান, তুরস্ক, লেবাননের মতো প্রতিবেশী দেশে। আর একটি অংশ পাড়ি দিয়েছে ইউরোপে। ক্ষুধা, তৃষ্ণাদীর্ণ সে এক কঠিন যাত্রা। ভূমধ্যসাগর পেরুতে ২০১৪ সালেই শুধু নৌকাডুবিতে প্রাণ গেছে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জনের। এ বছর এখনই সংখ্যাটা দু’হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রকট আকার ধারণ করলেও এ সমস্যা নতুন নয়, বেশ কয়েক মাস ধরেই একটু একটু করে জমে উঠছিল। কিন্তু আশ্চর্য রকমের নীরব ছিল পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থা ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি অবহেলার অভিযোগও তুলছিল। তুরস্ক, জর্দান, লেবাননের মতো দেশে শরণার্থীর চাপে নাগরিক সেবাও প্রায় ভেঙ্গে পড়ার মুখে। কিন্তু তখন সেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি ইউরোপ। যেমন এখনও চুপ করে আছে সৌদি আরবসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ। পশ্চিমাদের সৃষ্ট এ সমস্যার দায় সৌদি আরবেরও। পশ্চিমাদের সহযোগী মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ । যদিও দেশটির সিনেটররা শরণার্থী সঙ্কট প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে চিঠি দিয়েছেন। ১৪ সিনেটর ওই চিঠিতে জানিয়েছেন, শরণার্থী সমস্যা দিনের পর দিন প্রকট হয়ে উঠছে। ফলে অন্তত ৬৫ হাজার শরণার্থীকে আমেরিকায় আশ্রয় দিলে সমস্যার খানিকটা সমাধান হতে পারে। তবে সিনেটরদের এই ভূমিকার সমালোচনাও হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, সীমান্ত এলাকা দিয়ে শরণার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকলে তাদের সঙ্গে জঙ্গীরাও ঢুকতে পারে। তবে মধ্য এশিয়া কিংবা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যাওয়া যতটা সহজ যুক্তরাষ্ট্রে ততটা কঠিন বৈকি। মধ্য এশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে সহজে পৌঁছা যায় গ্রিস, ইতালি। ফলে প্রথমে সেদিক দিয়েই ইউরোপে ঢুকছিল শরণার্থীরা। চাপে পড়ে গ্রিস আর ইতালি বার বার সাহায্য চাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কর্ণপাত করেনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সাহায্য দূরের কথা, সীমান্তে কড়াকড়ি বাড়িয়ে দিয়েছিল ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড। এখন শরণার্থীরা পথ পাল্টেছেন। তুরস্ক থেকে বুলগেরিয়া, সাইবেরিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া হয়ে উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপের দিকে শরণার্থীরা ভিড় জমাতে শুরু করলে নড়েচড়ে বসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত শনিবার লুক্সেমবুর্গে ইউরোপের কিছু দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়। কিন্তু সেখানেও শরণার্থীদের সামলানোর নীতি নিয়ে ইতালি, গ্রিসের মতো দেশের সঙ্গে জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশের মতপার্থক্য উঠে আসে। কারণ শরণার্থীদের শুধু আশ্রয় দিলেই তো হবে না, তাদের জন্য নানা নাগরিক সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। যার বিপুল খরচ রয়েছে। পাশাপাশি, শরণার্থীদের জন্য তৈরি হওয়া সামাজিক সমস্যা নিয়েও ভীত ইউরোপের দেশগুলো। তুরস্ক, জর্দান, লেবাননের মতো দেশে নাগরিক সেবার সমস্যার পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের মিলমিশ হচ্ছে না। বিষিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক। অচ্ছুত হতে হতে অপরাধ জগতে, যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছেন অনেক শরণার্থী। আয়লানের বাবা আবদুল্লা সিরিয়ার কোবানে ছেড়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু মানিয়ে নিতে না পেরে আবার সিরিয়ায় ফিরে আসেন। পরে আবার তুরস্ক হয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকেন। গ্রিসে ঢোকার জন্য শেষবারের যাত্রার সময় প্রায় সাড়ে চার হাজার মার্কিন ডলার খরচ করেছিলেন আবদুল্লা। আর এখানেই উঠে আসছে মানবপাচার চক্রের কথা। শরণার্থী সঙ্কটকে কেন্দ্র করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মানবপাচার চক্র। বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে অনেক শরণার্থীকে ইউরোপে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এই চক্র। সে যাত্রায় অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। কয়েক দিন আগেই অস্ট্রিয়ায় একটি বন্ধ ট্রাকের ভেতরে ৭১ শরণার্থীর দেহ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে বুলগেরিয়ায় সক্রিয় একটি মানবপাচার চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তা সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। গৃহযুদ্ধে দীর্ণ দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের কাছে পশ্চিম ইউরোপ স্বপ্নের মতো। তাই বিপুল অর্থ ব্যয়, তীব্র কষ্টের মধ্যে কোনমতে পৌঁছতে পারলেই ভবিষ্যতে একটু সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন পাওয়া যাবে। কিন্তু তুরস্ক, জর্দান বা লেবাননের মতো শরণার্থীদের থেকে নানা সামাজিক অস্থিরতা তৈরিরও আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞরা ইউরোপের পরিবর্তে মধ্য এশিয়াতেই শরণার্থীদের ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে জর্দান, তুরস্ক, লেবাননকে শরণার্থীদের সামলাতে আরও বেশি সাহায্য করতে হবে, যাতে ঘরের কাছেই শরণার্থীদের যথাসম্ভব সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা যায়। গৃহযুদ্ধের আঁচ কমলে তারা যাতে সহজে স্বভূমে ফিরে যেতে পারেন। পাশাপাশি, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে আরও উদ্যোগী হতে হবে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে। মধ্য এশিয়ার প্রতিপক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসাতে হবে। নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। যাতে নতুন করে আর সংঘর্ষ না হয়। এ বছরে প্রায় ১৫টি নতুন জায়গায় সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে ঘর ছেড়েছে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ। ঘরে ফিরেছে ১ লাখ ২৭ হাজার, যা ৩১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
×