বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একটির কার্যক্রম চলবে, অন্যটি নিষ্ক্রিয় থাকবে। মামলার সংখ্যা বাড়লে দ্বিতীয়টির কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল-২ বন্ধ করে ট্রাইব্যুনাল একটি করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যাওয়ার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনটি জারি হতে পারে। একটি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চালু হলে তিনজন বিচারপতি হাইকোর্টে ফিরে যাবেন। মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি বা প্রয়োজন হলে নিষ্ক্রিয় ট্রাইব্যুনাল পুনরায় চালু করে আবার হাইকোর্ট থেকে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে।
এদিকে ট্রাইব্যুনাল একটি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এখন ঘোষণা শুধুই সময়ের ব্যাপার। ইতোমধ্যে একটি ট্রাইব্যুনাল হওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠেছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে দুটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ স্থানান্তর করা হয়েছে। হবিগঞ্জের দুই সহোদর রাজাকার কমান্ডার মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া ও মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়া এবং জামালপুরের রাজাকার আশরাফ হোসেনসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জ হেয়ারিংয়ের জন্য দিন নির্ধারিত করা থাকলেও তা ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্য যে সমস্ত মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা করা হয়েছিল সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রাইব্যুনাল-১-এ চলে যাবে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে জানা গেছে, ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও সদস্য বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম এবং ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন ও সদস্য বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিঞাকে সরিয়ে আনা হবে সুপ্রীমকোর্টে। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর সদস্য বিচারপতি মোঃ আনোয়ারুল হক ও ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম থাকছেন। তাদের সঙ্গে আরেক সদস্য হিসেবে হাইকোর্ট থেকে এক বিচারপতি আনা হবে। সে হিসেবে আপাতত দুইটি থেকে একটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার (জেলা জজ) শহিদুল আলম ঝিনুক জনকণ্ঠকে বলেছেন, তিনি এখনও ট্রাইব্যুনাল একটি হওয়ার আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র হাতে পাননি। সে কারণে আমি কিছুই বলতে পারছি না। তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ট্রাইব্যুনালের অভ্যন্তরের হাবভাব দেখে এটা স্পষ্ট ট্রাইব্যুনাল একটি হচ্ছে। সূত্রমতে দুই চেয়ারম্যানসহ ৬ বিচারপতি নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যারা ট্রাইব্যুনালে থাকছেন বা থাকছেন না যাদের যেন নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়। কারণ ইতোমধ্যে দুটি ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলাম, জাতীয় পার্টি, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০১২ সালের ২২ মার্চ স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুটি ট্রাইব্যুনালে ২১টি মামলার রায় হয়েছে। তার মধ্যে ২৪ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দেয়া দ-ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে ৫টি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলেও এখন পর্যন্ত তিনটি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। আইনজীবীগণ আশা করছেন শীঘ্রই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর নিয়মানুযায়ী রিভিউ করা হবে। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপীলের রায় ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, মুজাহিদের রায় ঘোষণা করা হয় চলতি বছরের ১৬ জুন আর সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপীলের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয় ২৯ জুলাই। এর আগে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার চূড়ান্ত আপীল নিষ্পত্তি শেষে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। বর্তমানে নিজামী-মীর কাশেমসহ আরও ৮টি মামলা আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুটি মামলা ট্রাইব্যুনাল-১-এ স্থানান্তর করা হয়েছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে হবিগঞ্জের দুই সহোদর রাজাকার কমান্ডার মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া ও মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়ার বিরুদ্ধে চার্জ হেয়ারিংয়ের জন্য ৬ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করা ছিল। দুই সহোদরের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ২টি হত্যা, ১টি ধর্ষণ, ১টি অপহরণ, আটক ও ১টি অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর।
তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৬ অক্টোবর সকাল আনুমানিক ১০টার সময় আসামি মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া ও মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়াসহ তাদের সঙ্গীয় রাজাকার বাহিনী ও ১০/১৫ জন পাকিস্তানী আর্মি নিয়ে তিনটি নৌকা যোগে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার মুক্তিযুদ্ধের উপ- সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল (অব) এমএ রব সাহেবের খাগাউড়া গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। আসামিদ্বয় ঐ বাড়িতে আগুন দিয়ে পাঁচটি বড় টিনের ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। একই দিন রাজাকাররা হিন্দুপাড়ায় মনীন্দ্র চন্দ্র দেব, রামাকান্ত দেব, শম্ভুদেব, করুনা দেবের বাড়িঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ছাড়া আসামি বড় মিয়া ও আঙ্গুর মিয়া একাত্তরের ২৬ অক্টোবর বানিয়াচং থানার খাড়াউড়া বেরিপাড় সাকিনে অভিযান চালায়। এ সময় পাকিস্তানী আর্মি আফতাব মিয়ার যুবতী কন্যা আগরচাঁন বিবিকে এবং একই গ্রামের মৃত মঞ্জুর উল্লাহর সুন্দরী স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামালপুরের রাজাকার আশরাফ হোসেনসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের ওপর শুনানির জন্য ১৫ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করা ছিল। এই মামলার ৮ আসামির মধ্যে ২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি ৬ আসামি পলাতক। গ্রেফতারকৃত ২ জন হলেন, এ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই ও এসএম ইউসুফ আলী। পলাতক ৬ জন হলেনÑ আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা মোঃ আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মোঃ আব্দুল হান্নান, মোঃ আব্দুল বারী, মোঃ হারুন ও মোঃ আবুল কাসেম। এর আগে গত ৬ মে ওই ৬ জন আইনের দৃষ্টিতে পলাতক কি-না সে বিষয়ে জানাতে এবং তাদের আত্মসমর্পণে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য প্রসিকিউশনকে আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও তারা আত্মসমর্পণ করেননি বা গ্রেফতার হননি। এদিকে পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে আইজিপির দেয়া দ্বিতীয় প্রতিবেদন দাখিল করে প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল জানান, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ নেত্রকোনার রাজাকার কামান্ডার মোঃ ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বাদবাকি অন্য মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে শরীয়তপুরের দুইজন আসামির মধ্যে সোলায়মান নামে একজন গ্রেফতার হয়েছে। যশোরের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপিসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও ৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের ৫ জনের মধ্যে ১ জন, মহেশখালীতে ১৮ জনের মধ্যে ৪ জন, হবিগঞ্জে ৩ জনের মধ্যে ৩ জনই গ্রেফতার হয়েছেন। এই মামলাগুলোর এখন তদন্ত চলছে।