ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শর্তারোপ থেকে বিশ্বব্যাংক সরে এসেছে;###;এবারও বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাবে- শিক্ষামন্ত্রী

পাঠ্যবই ছাপার অচলাবস্থা কেটে গেছে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

পাঠ্যবই ছাপার অচলাবস্থা কেটে গেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মতবিরোধের ফলে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপায় সৃষ্ট অচলাবস্থার অবশেষে অবসান হলো। আন্তর্জাতিক টেন্ডারের এই বই ছাপানোর কাজে আরোপিত শর্ত থেকে বিশ্বব্যাংক সরে আসায় বুধবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কাছ থেকে ‘নো অবজেকশন এ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা কার্যাদেশ গ্রহণ করেছেন। ফলে বিশ্বব্যাংকের শর্তের কারণে প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপা নিয়ে দীর্ঘ দেড় মাস ধরে চলা সঙ্কটের অবসান হলো। তবে প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজে অংশ নেয়া দেশীয় ২২ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানই বলেছে, বিশ্বব্যাংকের খবরদারি ও এনসিসিটির দুর্বলতার কারণে যেহেতু দেড় মাস সময়ের অপচয় হয়েছে, সেহেতু নির্দিষ্ট সময় শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে হলে পরবর্তী সকল পদক্ষেপ দ্রুত শেষ করতে হবে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র পাল দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিবাচক অবস্থানে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য ‘নো অবজেকশন এ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ তারা আমাদের এ কাজ করতে সম্মত হয়েছে। ফলে পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল তার একটা অবসান হয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা মানসম্মত বই ছাপাব। বিষয়টি বিশ্বব্যাংক অবগত। বিশ্বব্যাংকের ১৫ শতাংশ পারফর্মেন্স গ্যারান্টির শর্তে আমরা আগামী সপ্তাহ থেকেই বই ছাপানোর কাজ শুরু করব। একই সঙ্গে তারা বলেছেন, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপাতে বিশ্বব্যাংকের দেয়া পাঁচ শর্তের চারটি প্রত্যাহার করে নেয়ায় দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে সম্মত হয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে জটিলতা চলায় এবার পুরো বই নিয়েই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। এ অবস্থায় গত এক সপ্তাহ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো ও দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। একপর্যায়ে গত সোমবার এক বৈঠকে পাঠ্যবই মুদ্রণের সঙ্কট কাটাতে ঐকমত্যে পৌঁছায় উভয়পক্ষ। নিজেদের দেয়া পাঁচটি শর্তের মধ্যে চারটিতেই ছাড় দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর মুদ্রণকারীরাও বিশ্বব্যাংকের দেয়া একটি শর্ত মেনে নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, সকলেই মানসম্মত বই চায়। তবে তা বিদ্যমান টেন্ডারের শর্তেই নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা মতৈক্যে পৌঁছেছি। পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল তার অবসান হয়েছে। পাঠ্যবই যেন মানসম্পন্ন হয় সে ব্যাপারে প্রকাশকরা বই ছাপাতে একমত হয়েছেন। এখন বই ছাপানোর কাজ শুরু হবে। প্রতিবছরের মতো এবারও বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা বই পাবে বলে আশ্বাস দিলেন মন্ত্রী। জানা গেছে, আগামী বছরের জন্য প্রাথমিকে ১১ কোটি ৩৫ লাখ ৫৮৬ কপি বই ছাপনোর কথা। এবার ৩৩০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ২২১ কোটি টাকায় বই ছাপানোর কাজ পায় দেশীয় ২২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ৯ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ কোটি টাকা। এই টাকাও বিদেশী সংস্থাগুলো সরাসরি দেয় না। সরকারের তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী বা পিইডিপি-২তে ৯ শতাংশের মতো টাকা দেয় বিদেশী এ সংস্থাগুলো। ওই কর্মসূচীর একটি সামান্য পরিমাণ অর্থ আসে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজে। মূলত এমন একটি অংশগ্রহণমূলক অবস্থান থেকেই বিশ্বব্যাংক এবার বইয়ের মান নিয়ে শক্ত অবস্থান দিয়েছিল। দরপত্র আহ্বানের পর বিশ্বব্যাংক পারফর্মেন্স গ্যারান্টির পরিমাণ ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, কাগজ কেনার পর বিশ্বব্যাংকের কারিগরি শাখার তত্ত্বাবধানে কাগজের মান ও ফর্মা পরীক্ষা, উপজেলা পর্যায়ে যাওয়া বইয়ের মান তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষার শর্ত দেয়। মান পরীক্ষার পর সন্তোষজনক হলে বিল পরিশোধ করার কথা জানায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক জানায়, অবিশ্বাস্য কম দামে স্থানীয় বিডাররা (দরদাতা প্রতিষ্ঠান) কাজ পেয়েছে। এতে বইয়ের কাগজ-কালি ও বাঁধাই নিম্নমানের হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এজন্য পুনঃদরপত্র অথবা তীক্ষè মনিটরিং নিশ্চিতের শর্ত দেয় সংস্থাটি। তবে মুদ্রাকররা জানিয়ে দেন, দরপত্রের শর্তের বাইরে নতুন কোন শর্তজুড়ে দেয়া হলে বই ছাপবে না কোন মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রয়োজনে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বই ছাপা ও সরবরাহে বিলম্ব হলে এর দায়দায়িত্ব বিশ্বব্যাংক কিংবা এনসিটিবিকে নিতে হবে। দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা বিশ্বব্যাংককে চিনি না, জানি না। তাদের কোন শর্ত মানার প্রশ্নই আসে না। কারণ আমরা বই ছাপাই এনসিটিবির। তারা শর্ত যা দেয়ার তা দরপত্র আহ্বানের আগেই দিয়েছে। নতুন করে শর্ত আরোপের কোন সুযোগ নেই। নেতৃবৃন্দের অনেকেই সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, সময় নষ্ট করে বিশ্বব্যাংক পাঠ্যবই নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে চায়। এখানেও তারা পদ্মা সেতুর মতো সঙ্কট বাধাতে চায়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্বব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার ধারণাই নেই বাংলাদেশের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা সম্পর্কে। এ দেশে এখন বেশ কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আছে যারা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৫ লাখ বই ছাপতে পারে। তবে এমন মুখোমুখি অবস্থার অবসান বুধবার শেষ পর্যন্ত ভালভাবেই হয়েছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘নো অবজেকশন এ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেছেন ২২টি দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ শেরনীয়াবাত বলেন, আমরা মানসম্মত বই ছাপাব। বিষয়টি বিশ্বব্যাংক অবগত। বিশ্বব্যাংকের ১৫ শতাংশ জামানতের শর্তে আমরা দ্রুত বই ছাপানোর কাজ শুরু করব। এদিকে জানা গেছে, দুই পক্ষের মতবিরোধে গত বছরের তুলনায় প্রাথমিকের কাজ এবার পিছিয়ে গেছে অন্তত দেড় মাস। গত বছর এ সময়ে প্রাথমিকের বই ছাপা হয়ে উপজেলায় বিতরণও শুরু হয়েছিল। মুদ্রাকররা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের খবরদারি ও এনসিসিটির দুর্বলতার কারণে যেহেতু দেড় মাস সময়ের অপচয় হয়েছে, সেহেতু এবার নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে হলে পরবর্তী সকল পদক্ষেপ দ্রুত শেষ করতে হবে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বলছিলেন, আর কোন কাজে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। বিশ্বব্যাংকের সময়ক্ষেপণের একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এনসিটিবি নো অবজেকশন এ্যাওয়ার্ডের খসড়া বিশ্ব¦ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছিল মতামত দেয়ার জন্য, যা করতে সময় লাগে একদিন। অথচ বিশ্বব্যাংক সেটি পাঠিয়েছে এক মাস পর। এভাবে হলে সঙ্কটতো হবেই। তিনি আরও বলেন, এনসিটিবি এখন নাকি কাগজ ইনেসপেকশন ফার্ম নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেবে। নতুন করে ফার্ম নিয়োগ দিতে গেলে সময় লাগবে। এটাও ভাবতে হবে এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে। এনসিটিবি জানিয়েছে, এবার মোট ৩৫ কোটি বই ছাপতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাথমিকের বইয়ের জন্য ২৯২ কোটি টাকা, প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৩৮ কোটি এবং মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৪৪৩ কোটি টাকা ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ হওয়ায় বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবারও প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কম খরচে বই ছাপার সুযোগ পায় সরকার। তবে আপত্তি কেবল প্রাথমিকের বই নিয়ে। প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার জন্য ৩৩০ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়। কিন্তু দেশীয় মুদ্রাকররা ২২১ কোটি টাকায় এ কাজ পেয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ১০৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। দেশের মোট ২২টি ছাপাখানা এবার প্রাথমিকের বই মুদ্রণের কাজ পেয়েছে।
×