ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনিবার্য করে তুলেছে বিপজ্জনক সাগরপাড়ি ;###;৭৫ ভাগ মৃত্যুই ঘটছে ভূমধ্যসাগরে

যুদ্ধবিগ্রহ সহিংসতা ইউরোপ অভিমুখে ঠেলে দিচ্ছে ওদের

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

যুদ্ধবিগ্রহ সহিংসতা ইউরোপ অভিমুখে ঠেলে দিচ্ছে ওদের

নাজনীন আখতার ॥ যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা থেকে পালানো এবং উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ অভিমুখে বিপজ্জনক যাত্রায় একের পর এক ঘটে চলেছে হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা। যুদ্ধবিগ্রহের কারণে মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে ইউরোপে বিপজ্জনক যাত্রা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে ভূমধ্যসাগর হয়ে উঠছে মৃত্যুকূপ। ইউরোপের তুলনামূলক কম ধনী দেশ ইতালি, গ্রীস ও মাল্টায় প্রবেশ করতে গিয়ে শরণার্থী ও অভিবাসী মৃত্যুর ঘটনার ৭৫ শতাংশই ঘটছে ভূমধ্যসাগরে। এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে নৌকায় করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো মানুষদের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে তারা অভিবাসী নাকি শরণার্থী তা সুস্পষ্ট করতে বলেছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। গার্ডিয়ান, বিবিসি, ইকোনমিস্ট এবং ভক্স-এর প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার ৭৫ শতাংশই ঘটেছে ভূমধ্যসাগরে। বছর শুরুর তুলনায় গত মার্চ এপ্রিল মাসে এ ধরনের অভিবাসন ৪৩ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ইতালি। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক লোক ইউরোপে প্রবেশ করেন। ধনী দেশগুলোর কড়াকড়ি থাকায় তারা প্রাথমিকভাবে প্রবেশ করেন মাল্টা, ইতালি ও গ্রীসের মতো কম ধনী দেশগুলোতে। পরে তারা ইউরোপের অন্যান্য অংশের দিকে পাড়ি জমান। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করার মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ছিলেন সিরিয়ার নাগরিক। ৬৭ হাজার সিরীয় নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করেন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ইরিত্রিয়া ৩৪ হাজার, আফগানিস্তান ১৩ হাজার এবং মালির ১০ হাজার নাগরিক ইউরোপে প্রবেশ করেন। এছাড়া বর্তমানে ৬ লাখ মানুষ লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সদস্য দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩শ’ আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই যুদ্ধের কারণে সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা মানুষ। এছাড়া স্বৈরশাসনের জন্য ইরিত্রিয়া থেকে পালিয়ে আসা এবং মালি থেকেও যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য পালিয়ে আসা মানুষ রয়েছে। তবে ধনী দেশগুলো এই অভিবাসনকে খুব একটা স্বাগত জানাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রাজনৈতিক, গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশগুলোর ৫৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন অভিবাসনের বিষয়ে সীমিত সুযোগ দেয়া উচিত। গ্রীসে এ সংখ্যা ৮৬ শতাংশ এবং ইতালিতে ৮০ শতাংশ। ওই ইউরোপবাসীর মধ্যে এক ধরনের বিদেশাতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা চান না অন্য দেশ থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ তাদের দেশে প্রবেশ করে চাকরিসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাপ ফেলুক। গত ২৮ আগস্ট জেনেভা থেকে প্রকাশিত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপমুখী লোকের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। এর মধ্যে নৌকায় করে পাড়ি জমাচ্ছেন বেশি। চলতি বছর ৩ লাখেরও বেশি শরণার্থী ও অভিবাসী বিপজ্জনকভাবে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপে। এর মধ্যে কমপক্ষে ২ লাখ গ্রীসে এবং ১ লাখ ইতালিতে প্রবেশ করেছেন। গত বছর ২ লাখ ১৯ হাজার মানুষ নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও। এভাবে নৌকায় করে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে গত বছর সাড়ে ৩ হাজার মানুষ মারা যান। আর চলতি বছর এ পর্যন্তই মারা গেছেন আনুমানিক আড়াই হাজার। এর মধ্যে লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে গত ২৬ আগস্ট মারা যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট না হওয়ায় তা তালিকাভুক্ত করা হয়নি। লিবিয়া ট্র্যাজেডির ওই ঘটনায় ২শ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউএনএইচসিআরের ওই প্রতিবেদনে লিবিয়া ট্র্যাজেডির শিকার ব্যক্তিদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়। সুদানের ২৫ বছর বয়সী তরুণ আবদেল জানান, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতো বলে তারা খোলে ঢুকতে চাইতেন না। তাদের মারধর করে খোলে ঢুকানো হতো। এছাড়া খোলের বাইরে এসে একটু শ্বাস নেয়ার জন্য আলাদা টাকা নেয়া হতো। সুদানের এক তরুণ পানি খাওয়ার জন্য খোলের বাইরে আসার চেষ্টা করেছিল বলে তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। খোলের ওপর তলায় থাকার জন্য অভিবাসী ও শরণার্থীদের হাজার ইউরো বা ডলারও দিতে হয়েছে স্মাগলারদের। ইরাক থেকে পালিয়ে আসা অর্থোপেডিক সার্জন মাহদি জানান, তিনি উপরের ডেকে তার স্ত্রী ও দুই বছরের পুত্রকে নিয়ে জায়গা পেতে স্মাগলারদের হাতে ৩ হাজার ইউরো তুলে দেন। উদ্ধার হওয়া ৪৫ বছর বয়সী হাসনা জানান, তিনি গাদাগাদি করে মানুষ বোঝাই করা নৌকাটি দেখেই ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্বামী ও তিন কন্যা এবং এক পুত্র। তিনি বলেন, এটা ছিল মাছ ধরার নৌকা। মৃত্যুকূপ। আমরা আমাদের জীবন হাতে নিয়ে ওই নৌকায় উঠেছিলাম। উল্লেখ্য, লিবিয়া উপকূলে ৫শ’ ৭২ জন অভিবাসী ও শরণার্থী বোঝাই নৌকা দুটি ডুবে যায়। এর মধ্যে রবারের ডিঙ্গি নৌকায় ছিলেন ১শ’ জন। বাকিরা ছিলেন কাঠের ডাবল ডেকের নৌকায়। নৌকার তলদেশে ফুটো থাকায় যাত্রার প্রায় এক ঘণ্টা পর ত্রিপোলির জুয়ারা বন্দরের কাছে নৌকা দুটি ডুবে যায়। নৌকার খোলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ৫১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ডুবে যাওয়া নৌকা দুটিতে শিশু এবং নারীসহ ৫৪জন বাংলাদেশী ছিলেন। এর মধ্যে ৪৭জন বাংলাদেশীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ডুবে যাওয়া নৌকা দুটির আরোহীদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, পাকিস্তান, সিরিয়া ও মরক্কোর নাগরিক ছিলেন। এদিকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুবরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ২৭ আগস্ট প্রকাশিত ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে অভিবাসী ও শরণার্থীদের বিষয়টি স্পষ্ট করার তাগিদ দেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে প্রায় ৬ কোটি মানুষ জোরপূর্বক স্থানচ্যুত হচ্ছে। বিপজ্জনকভাবে নৌকায় করেও এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মারাও যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যমে উঠে আসছে এ তথ্য। কখনও স্থানচ্যুত মানুষদের বলা হচ্ছে শরণার্থী। কখনও বা আলোচনায় আসছে অভিবাসী পরিচয়ে। কিন্তু এ দুটো শব্দের মধ্যের সত্যিকারভাবে কোন পার্থক্য আছে কী না সে প্রশ্ন বার বারই উঠে আসে। আর এর জবাবটা হচ্ছে- অবশ্যই সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। আর এ নিয়ে দ্বিধা বা ভুল ধারণা থাকলে তা অভিবাসী আর শরণার্থী দুই ধরনের মানুষের জন্যই সমস্যা তৈরি করবে। যারা সশস্ত্র সংঘর্ষ অথবা অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসে তারা শরণার্থী। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এভাবে পালিয়ে আসা শরণার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৫ লাখ। এ ধরনের ব্যক্তিরা এতটাই অসহনীয় ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির শিকার হন যে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় খোঁজেন পার্শ্ববর্তী দেশে। এ ধরনের মানুষদের আশ্রয় না দেয়ার অর্থ তাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া। আর অভিবাসীরা কোন মৃত্যু হুমকি বা অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আরেক দেশে যায় না। তারা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য নিজেরাই অন্য দেশে আসেন। কখনও পরিবারের সঙ্গে থাকতে, কখনও শিক্ষা বা চাকরির প্রয়োজনে অথবা অন্য কোন কারণে। তারা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী দেশেও ফিরতে পারেন। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আইন ও কনভেনশন মেনে এবং মানুষ হিসেবে অভিবাসী ও শরনণার্থী দুই ধরনের মানুষের প্রতিই সমান সম্মান দেখানো উচিত। অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা যেমন নিশ্চিত করা প্রয়োজন তেমনি শরণার্থীদের দুরাবস্থার কথা বিবেচনা করে তাদের প্রতিও আইনগতভাবে যা করা প্রয়োজন সব কিছু করা উচিত। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপের দেশ ইতালি, গ্রীসসহ অন্যান্য দেশে গত বছর ও চলতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ অবস্থান নিয়েছে। এই মানুষদের অধিকাংশই শরণার্থী হিসেবে দেশ ছেড়ে এসেছেন। খুব অল্পসংখ্যকই আছেন অভিবাসী হিসেবে। গত ১২ মে কানাডাভিত্তিক গণমাধ্যম দি গ্লোব এ্যান্ড মেইলে এক ডাচ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, বিপজ্জনক অভিবাসনের ক্ষেত্রে কী করা উচিত এ নিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় বিতর্ক রয়েছে। এই গবেষণায় ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে শরণার্থী ও অভিবাসীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে নতুন ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, অভিবাসীদের অনেকেই নিখোঁজ হয়ে গেছে যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমস্টারডামে ভিইউ ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ১৮৮ জন অভিবাসী মারা গেছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই কিভাবে মারা গেছেন তা চিহ্নিত হয়নি। ২০১৩ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায়। ওই বছর ইতালির ল্যামপেদুসা দ্বীপের কাছে অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা ডুবে মারা যান ৩শ’ জন। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অভিবাসনের সময় মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মারা গেছেন পানিতে ডুবেÑ ১ হাজার ৯৭৭ জন। শরীরের ন্যূনতাপ বা হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪৫ জন। সহিংসতায় আহত হয়ে মারা গেছেন ১১৫ জন। হার্টএ্যাটাকে মারা গেছেন ৭৬ জন। পানিশূন্যতায় মারা গেছেন ৬৭ জন। শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন। আর ৭৫৬ জনের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।
×