ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আবদুল খালেক

মহাজোট ভাঙবে না

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মহাজোট ভাঙবে না

মানুষ এবং পশুর মধ্যে দৈহিক কিছু মিল থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। মানুষের আবেগ আছে, পশুর আবেগ নেই, মানুষের বিবেক আছে, পশুর বিবেক নেই, মানুষের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আছে, পশুদের এসব নেই। সমাজের যাঁরা কবি, যাঁরা দার্শনিক, তুলনামূলকভাবে তাঁরা অধিকমাত্রায় আবেগপ্রবণ। অনেকে মনে করেন, যে মানুষের মধ্যে আবেগ নেই, তিনি কবিতা লিখতে পারবেন না। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই কমবেশি আবেগপ্রবণ। সে বিচারে বাংলাদেশের সকল মানুষই কবি। কেউ নীরব কবি, কেউ সরব কবি। ইতিহাসবিদ যাঁরা, আবেগের চেয়ে তাঁদের মননের চর্চা বেশি করতে হয়। তাঁদের চলতে হয় যুক্তির পথে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার ইতিহাস নিয়ে দেশের কতিপয় রাজনৈতিক নেতা বেশ খানিকটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা নিঃসন্দেহে আমাদের ইতিহাসের নির্মম কালো অধ্যায়। এই কালো অধ্যায় নিয়ে কথা বলার অধিকার সকল মানুষেরই আছে। বঙ্গবন্ধু যেহেতু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সে কারণে ঘটনা এবং ঘটনার অন্তরালে যে ঘটনাবলী রয়েছে তা পর্যালোচনা করতেই পারেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই হত্যা করা হয়নি, একই সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে বেগম মুজিবকে, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু পুত্র শেখ রাসেল, ভাই শেখ নাসের এবং অনেক আত্মীয়-স্বজনকে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বাসায় থাকলে ঘাতকরা তাঁদেরও খুন করত। দু’বোন সে সময় দেশের বাইরে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন। তবে ঘাতকরা চুপচাপ বসে নেই। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ঘাতকরা শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে ১৯বার চেষ্টা চালিয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এক জনসভায় শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সে হামলায় বিশিষ্ট নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতা-কর্মী নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা করেছেন। জাতির পিতাকে আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না। বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুর কাছে নানাভাবে ঋণী। বাঙালী জাতি যে অকৃতজ্ঞ নয় তা প্রমাণের সময় এসেছে। পুরো আগস্ট মাসকে বাঙালী জাতি এখন শোকের মাস হিসেবে পালন করে থাকে। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু নেই, এমন কথা বলা যাবে না। কথিত আছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা কারণে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার দাম্পত্য কলহ দেখা দিয়েছিল, সংসার ভেঙ্গে যেতে বসেছিল। বঙ্গবন্ধুই তাঁর উদারতা দিয়ে ভাঙ্গা সংসার জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে কেক কেটে নিজের মনগড়া জন্মদিন পালন করে থাকেন। বিবেকবান কোন মানুষ এমন কাজ করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের নেতা ছিলেন, দিন যত যাচ্ছে, দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ততই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক সময় সমালোচনামুখর ছিলেন, তাঁরাও ধীরে ধীরে মত পাল্টাতে শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা কত সুদূরপ্রসারী ছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তা মূল্যায়নের চেষ্টা করছেন। ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যে সব চুক্তি বঙ্গবন্ধু সম্পাদন করে গেছেন, বিএনপি এসব চুক্তিকে গোলামির চুক্তি বলে আখ্যায়িত করলেও তা ধোপে টেকেনি। এতদিনে সে সব চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং দেশের মানুষ চুক্তি বাস্তবায়নে বিজয় উৎসব পালন করছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে কোন কোন গবেষক তাঁকে রাজনীতির মহান কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। মন্তব্যটি অসাধারণ। কবিরা স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন, স্বপ্ন দেখাতেও তাঁরা পারদর্শী। বঙ্গবন্ধু নিজে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের সময় কবিদের মতো তিনিও আবেগাচ্ছন্ন ছিলেন, কিন্তু সে আবেগকে তিনি লাগাম ছাড়া হতে দেননি। ৭ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে জাতি কি ধরনের সঙ্কটের মধ্যে পতিত হবে, বঙ্গবন্ধু তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু আবেগকে সংযত করে ঘোষণা দিলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ঘোষণাটিকে শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে অনেকে বিবেচনা করে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে জাতির একটা আবেগ আছে। আগস্ট মাসের বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে সেই আবেগের বহির্প্রকাশ ঘটতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে আবেগ কাজ করবে, জাসদ, ওয়ার্কার্স, জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সে আবেগ থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল্যায়ন করার অধিকার দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের রয়েছে, হতে পারেন তিনি শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী, হতে পারেন তিনি রাজনীতিবিদ। আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছি বিভিন্ন শোক সভার অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণসমূহ বিচার-বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন। আমি লক্ষ্য করেছি তাঁদের মূল্যায়ন যথেষ্ট তথ্যনির্ভর। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঠিক কারণসমূহ উদ্ধার করতে বোধ করি কয়েক যুগ সময় লাগবে। বর্তমানকালের গবেষকগণ বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণসমূহ বিশ্লেষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছু কিছু উল্লেখ করা যেতে পারেÑ ১. খোন্দকার মোশতাকের মতো একজন ধূর্ত, উচ্চাভিলাষী নেতাকে বঙ্গবন্ধুর আস্থায় নেয়া ঠিক হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদের মতো পরীক্ষিত নেতাকে দূরে সরিয়ে রেখে খন্দকার মোশতাককে কাছে রাখা বড় ভুল। খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি তার বড় প্রমাণ। ২. ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং ধানম-ির ৩২ নং বাড়ি তাঁর জন্য নিরাপদ নয়, এ কথাও তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এসব কথায় গুরুত্ব দেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল বাংলার কোন মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে না। বাংলার মানুষের প্রতি অতিরিক্ত বিশ্বাস তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ। ৩. জামায়াত, মুসলিম লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির চরম অসহযোগিতা, তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে। বিভিন্ন স্থানে তারা জঙ্গী তৎপরতা চালাতে থাকে। দেশকে অচল করে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি চালাতে থাকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পাল্টা প্রতিশোধ নেয়া ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে তারা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছে। ৪. প্রশাসনে শুরু হয়েছিল দুর্নীতিবাজ এবং পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের আধিপত্য। মুজিব সরকারকে ব্যর্থ করার লক্ষ্যে তারা আড়ালে কাজ করেছে। প্রশাসনে পাকিস্তানপন্থী আমলাদের শক্তি ছিল প্রবল। যে কারণে দুর্নীতিকে কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হয়নি। এতে জনসাধারণ সরকারের প্রতি খানিকটা বিরূপ হয়ে উঠেছে। এটি আমলাদের ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। ৫. ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল, বিভাজনÑ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারাত্মক বিভাজন দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতে পাওয়া অস্ত্র তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে। শুরু হয়ে যায় খুনোখুনি। এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ক’জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী তাদের নিজেদের প্রতিপক্ষ গ্রুপের গুলিতে নিহত হয়। ৬. ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামের একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান, যার সংক্ষিপ্ত নাম জাসদ। জাসদের হটকারী কার্যকলাপ এবং অদূরদর্শী আন্দোলনে শেখ মুজিব মারাত্মকভাবে বিব্রত হয়েছিলেন। এ যেন ঘরের শত্রু বিভীষণ। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে দেশে যে ভয়ঙ্কর অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, শেখ মুজিব তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে শুরু হয় শ্রেণীশত্রু খতমের অভিযান। গ্রামের জোতদার এবং সংসদের সদস্যবৃন্দ তাদের দৃষ্টিতে ছিল শ্রেণীশত্রু। শ্রেণীশত্রু খতমের অভিযানে বেশ ক’জন সংসদ সদস্য এবং গ্রামের জোতদার প্রাণ হারায়। জাসদের এসব হটকারী কার্যকলাপ শেখ মুজিব হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে গবেষকদের স্পষ্ট অভিমত রয়েছে। জাসদের অন্যতম নেতা কর্নেল তাহেরকে বঙ্গবন্ধু ডেকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিনই চলবে তোদের বিপ্লব, শেখ মুজিব মারা গেলে তোদের ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর সতর্কবাণী ছিল নির্ভুল। (সূত্র- খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস।) ১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জাসদের অবস্থান ছিল দৃশ্যমান। সে সময়ের পত্র-পত্রিকা খুললেই তার প্রমাণ মেলে। ৭. আওয়ামী লীগে বিশৃঙ্খলা - মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের কর্মী পরিচয়ে যারা অস্ত্র হাতে পেয়েছিল, তারা সবাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত কর্মী ছিল না। ভুয়া কর্মী বা অনুপ্রবেশকারী বলে তাদের চিহ্নিত করা যায়। অনুপ্রবেশকারীরা তাদের অস্ত্র হাতছাড়া না করে সেই অস্ত্রসমূহ অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে ব্যবহার করতে থাকে। দেশে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বেড়ে যায়। চুরি-ডাকাতির ফলে বঙ্গবন্ধু বেশ খানিকটা দিশাহারা হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘আমি যে দিকে তাকাই শুধু চোর। এত চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে। কিন্তু এই চোর রেখে গেছে। এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।’ (সূত্র- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭৫, ২৬ মার্চের ভাষণ।) ৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতে পাওয়া অস্ত্রের অপব্যবহারÑ মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের হাতে অস্ত্র দেয়া হয়েছিল, তারা সকলেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিল প্রচুর। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা ছিলেন, যুদ্ধ শেষে তাঁরা অস্ত্র জমা দিলেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দেয়নি। সে সমস্ত অস্ত্র চুরি-ডাকাতির কাজে ব্যবহার হয়েছে। এর ফলে দেশে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তাতে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। সেই সুযোগ হত্যাকারীরা গ্রহণ করেছে। ৯. আলবদর, রাজাকার তথা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র - ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল তারা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংগঠিত হতে থাকে। তারা বুঝতে পারে শেখ মুজিবকে হত্যা করার কোন বিকল্প নেই। সুযোগ বুঝে তারা সে কাজটি করেছে। ১০. পাকিস্তান ফেরত সৈনিকদের ষড়যন্ত্রÑ কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন পাকিস্তান ফেরত সৈনিকদের তিনি কি অবস্থানে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একথা শুনে ক্যাস্ট্রো মন্তব্য করেছিলেনÑ কাজটি ঠিক হয়নি, এরা তোমার জীবনের জন্য হুমকি হবে। তবে বঙ্গবন্ধুর উদারতার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেনÑ ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধুর অতিশয় উদারতা তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে বিবেচনা করা হয়। ১১. আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র Ñ মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সমস্ত রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, তারা পরাজয়কে কোনক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। তারা একটি প্রতিবিপ্লব ঘটানোর জন্য সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত কৌশলে বাংলাদেশে একটি দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক কষ্ট দেখে খানিকটা দিশাহারা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। দেশী-বিদেশী সমাজতান্ত্রিক বন্ধুরা পরামর্শ দেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে। বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের প্রতি অনুগত থেকেও দেশের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িকভাবে তিনি সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। গঠন করেন বাকশাল। বাকশাল গঠনের পর দেশে খানিকটা অর্থনৈতিক সমস্যার উন্নতি হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নকে মেনে নিতে পারেনি। বুঝতে পেরেছে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে শেখ মুজিব দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলবে। আর সময় দেয়া ঠিক হবে না। শুরু হয় মার্কিন প্রশাসনের গভীর ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয় পাকিস্তান, সৌদি আরব, লিবিয়াসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র। নানা কারণে দেশে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তারই সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর পথভ্রষ্ট কিছু ভাড়াটে সৈনিক দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দোসরদের সহযোগিতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশে একটি সেনা অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটিয়ে দিতে সমর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণসমূহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে তথ্যসমূহ পরিবেশিত হলো এটাকে ইতিহাস বলা যাবে না। তবে ইতিহাস রচনার টুকরো টুকরো তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর অন্যতম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণসমূহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জাসদের তৎকালীন কার্যকলাপ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা গবেষকদের মূল্যায়নের অনেকটা কাছাকাছি। ইতিহাস সব সময় সত্য কথা বলে। ইতিহাসের সত্যকে আজ জাসদকে মেনে নিতেই হবে। তবে ১৯৭৫ সালের জাসদ এবং আজকের জাসদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। জাসদের তৎকালীন হটকারী অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার ইন্ধন জুগিয়ে থাকে, তার জন্য বর্তমান জাসদ নেতাদের দুঃখ প্রকাশ করাই ভাল। কোন কোন জাসদ নেতাকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেছি। একদিন টেলিভিশনে বিশিষ্ট জাসদ নেতা মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব বাদলের সাক্ষাতকার শুনছিলাম। সে সাক্ষাতকারে তিনি অকপটে স্বীকার করলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব সম্পর্কে তাদের মূল্যায়নে ভুল ছিল। তবে পাশাপাশি দাবি করলেনÑ ‘আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর অবাধ্য সন্তান।’ এ সত্যটাকে স্বীকার করে নেয়াই সমস্যা সমাধানের উত্তম পথ। বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ বিশ্লেষণ এখন একটি একাডেমিক বিষয়। কারণ বিশ্লেষণে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। এর জন্য বেশি আবেগ প্রদর্শন বাঞ্ছনীয় নয়। আওয়ামী লীগ এবং জাসদ নেতাদের মত পার্থক্যের বিষয়টি বিএনপি নেতাদের পুলকিত করেছে। তবে এ পুলক বেশি দিন থাকবে না। এ বিতর্কের কারণে ১৪ দলীয় জোট তথা মহাজোট ভাঙবে না। কারণ মহাজোট কোন আদর্শিক জোট নয়, কতিপয় রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক স্বার্থের জোট। মহাজোটের মধ্যে এমন কিছু দল আছে, যাদের আদর্শিক দূরত্ব উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর সমান। তারপরও পারস্পরিক স্বার্থ বিচারে মহাজোট অটুট থাকবে। লেখক : সাবেক উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×