ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোলাম কুদ্দুছ

’৭৫ থেকে ’৮১- কেমন ছিল বাংলাদেশ?

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৩১ আগস্ট ২০১৫

’৭৫ থেকে ’৮১- কেমন ছিল বাংলাদেশ?

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর দল বিএনপিই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন। গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর আজ পড়ুন শেষাংশ এদিকে ৭ জুন জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। ১০ জুলাই এই হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল শুরু হয়। মেঃ জেনারেল আবদুর রহমান হন এই কোর্ট মার্শালের প্রধান। ১১ আগস্ট কোর্ট মার্শাল জিয়া হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে সেনাবাহিনীর ১২ জন অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এছাড়া আরও ৩০ জন অফিসারকে অভিযুক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হয়। ১ সেপ্টেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ১২ জন অফিসারের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড মওকুফের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বিজ্ঞ আইনজীবীরা ৩ সেপ্টেম্বর কোর্ট মার্শালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। ৭ সেপ্টেম্বর রিট প্রত্যাখ্যাত হলে ওই দিনই সুপ্রীমকোর্টে আপীল করা হয়। সুপ্রীমকোর্ট ১৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শুরু করে ২২ সেপ্টেম্বর আপীল প্রত্যাখ্যান করে রায় প্রদান করে এবং তড়িঘড়ি করে সে রাতেই বারোটা এক মিনিট থেকে তিনটার মধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ কারাগারে অভিযুক্ত ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্রায় দু’বছর পর একই অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল ফজলে হোসেনকে ফাঁসি দেয়া হয়। যে বারোজন সেনা অফিসারকে ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ফাঁসি দেয়া হয় তাঁরা হলেন : ১. ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম, পিএসসি ২. কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন ৩. কর্নেল আবদুর রশীদ বীর প্রতীক, পিএসসি ৪. লে. কর্নেল আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম ৫. লে. কর্নেল দেলোয়ার হোসেন বীর প্রতীক, পিএসসি ৬. মেজর গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ ৭. মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া, বীর প্রতীক ৮. মেজর কাজী মমিনুল হক ৯. মেজর মুজিবুর রহমান ১০. ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার ১১. ক্যাপ্টেন জামিল হক ১২. লে. রফিকুল হাসান খান ণ. জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ১২ জুন ১৯৮১ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারের সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডি ৩২ নং সড়কের বাড়িটি শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাড়িটি অবশেষে দখলমুক্ত হয়ে ফিরে এলো বঙ্গবন্ধুর জীবিত দু’কন্যার কাছে দেশবাসীর কাছে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এই প্রথম ১৭ জুলাই ১৯৮১ শেখ হাসিনাকন্যা পুতুলকে নিয়ে গেলেন লন্ডনে শেখ রেহানার বাসায়। পুত্র জয়ও থাকেন সেখানেই। ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া দিল্লীতে ফেলোশিপের কাজে নিয়োজিত। এদিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সফর স্থগিত করে ৭ আগস্ট ১৯৮১ লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ নির্বাচন কমিশন এক ঘোষণায় ইতোপূর্বে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর পরিবর্তন করে ১৫ নবেম্বর পূর্ণ নির্ধারণ করে। ৮৩ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করলেও শেষ পর্যন্ত ৩৯ জন প্রার্থী রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ৩,৯০,৫১,০১৪ জন। নির্বাচিত বিএনপি প্রার্থী ক্ষমতাসীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে ৮৫,২২,৭১৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর ৩৮,৭,২১৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। জেনারেল ওসমানী, মেজর জলিল, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদসহ অন্য প্রার্থীরা জামানত হারান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ফলাফলকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে অভিযোগ করে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনের চরম পক্ষপাতিত্ব, কেন্দ্র ও বুথ দখল এবং কোথাও কোথাও ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতাসীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্টকেই পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলামের কাছে কারচুপির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করে। কিন্তু সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ২০ নবেম্বর বিচারপতি আবদুস সাত্তার বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২২ নবেম্বর প্রেসিডেন্ট সাত্তার ড. এমএন হুদাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে ২৭ নবেম্বর ৪২ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বিএনপি নেতা বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮১ তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল এইচএম এরশাদ সেনাভবনে পত্র-পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানান। সেখানে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তা অব্যাহত রাখার জন্য সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে যে কোন ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিরোধের জন্য দেশ শাসনে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংহত করার জন্য প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’Ñ গঠনের প্রস্তাব দেন। এ পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, কতিপয় সংশ্লিষ্টমন্ত্রী এবং সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানগণ। সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের এ বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক ও গুঞ্জনের জন্ম দেয়। গণতন্ত্র সংহত করার কথা বললেও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়Ñ যার প্রত্যক্ষ ফল পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে। জাতির এ কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অপরাপর রাজনৈতিক দলসমূহ সংগঠিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তি, জেল-জুলুম নির্যাতন প্রতিরোধ, ঘুুষ-দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং সীমান্ত সমস্যা সমাধান ও ছিটমহল বিষয়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর নেতৃত্বে সারাদেশে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রাণ ফিরে পায় এবং সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দল এবং জনগণকে সংগঠিত করার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত হয়। একই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলসমূহ পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি, সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং প্রগতির বিপরীতে ধর্মান্ধ এবং পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ এ সময় প্রত্যক্ষ করা যায়। এ সকল উদ্যোগকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে বিএনপি এবং পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি। জাতির এ ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রতিরোধ, জনজীবনের নানাবিধ সঙ্কট দূরীকরণ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত হন। দেশবাসীও আশায় বুক বেঁধে পাশে এসে দাঁড়ায়Ñ পরবর্তীতে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×