ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লৌহজংয়ে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গন

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ৩০ আগস্ট ২০১৫

লৌহজংয়ে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গন

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, খড়িয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্পের পাশে কুমারভোগের খড়িয়া গ্রাম এখন পদ্মার ভাঙ্গনে হারিয়ে যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে গ্রামটির অন্তত ১শ’ ৫৫ পরিবার গৃহহারা হয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে শিমুলিয়া বাজারের একাংশ, সরকারী রাস্তা, পুকুর, বৈদ্যুতিক পুলসহ নানা স্থাপনা। শনিবার এই ভাঙ্গন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পদ্মায় হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক জনপদ। গ্রামবাসীরা বাড়িঘর সরিয়ে নেয়ার সময়টুকুও পাচ্ছে না। এছাড়া দক্ষিণ হলদিয়া ও শিমুলিয়া এলাকায়ও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ করেছে- ফেরিঘাট মাওয়া থেকে শিমুলিয়ায় স্থানান্তর করে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিংয়ের কারণেই গ্রামগুলোতে এই ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এছাড়া পদ্মা সেতুর প্রকল্প ঘেঁষা এই গ্রামগুলোতে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যথাসময়ে নদী শাসন কাজ শুরু না করে বিলম্বে টেন্ডার দেয়ারও সমালোচনা করেছে এলাকাবাসী। একই সঙ্গে নদী শাসনে এই এলাকায় ১৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করে মাত্র দেড় কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ তৈরির প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এতে আশপাশের এলাকায় ভাঙ্গন স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জন্য হুমকি স্বরূপ। লৌহজং উপজেলা চেয়ারম্যান ওসমান গনি তালুকদার ঘটনাস্থলে জানান, এখনই নদী ভাঙ্গনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অপূরণীয় ক্ষতি হবে এ অঞ্চলের। ৯০ দশকের ভাঙ্গনে ৩৩ গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এর পর মানুষ কোন মতে টিকে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। পদ্মা সেতুতেও বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখন মানুষের জমিজমা নেই একবারেই। এখন এখানে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছে বহু মানুষ। শুধু ড্রেজিংয়ের ভুলের কারণে গ্রামটির সর্বনাশ হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি শনিবার নদী ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি ভাঙ্গনের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে বলেন, ভাঙ্গন রোধে ইতোমধ্যেই ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কয়েক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। নিলুফার ইয়াসমিনের পাকা ভিটির ঘরটি ভেঙ্গে রাখা হয়েছে পাশের উত্তর হলদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু ভিটি এখনও ছেড়ে যানটি। দুটি সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে এ ভিটিতে আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছেন। কিন্তু ভয়াল পদ্ম ক্রমশ তারে বাড়িটি গিলে ফেলছে। তাই তার স্বামী হলদিয়া বাজারে সবজি বিক্রেতা ওবায়দুল দেওয়ান এখন পরিবারটি নিয়ে দেশেহারা। কোথায় উঠবেন? অনিচ্ছিত এক ভবিষ্যত। দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারটি। এরচেয়েও করুণ অবস্থা বিধবা শিল্পী বেগমের। স্বামীকে হারিয়ে নিজের মানুষের বাড়িতে কাজ করে স্বামীর ঘরে আলো জ্বেলে রেখেছিলেন শিল্পী বেগম। কিন্তু সেই ভিটিবাড়িতে থাবা দিয়েছে পদ্মা। তার ছাপরা ঘরটি এখন একবারেই পদ্মার গ্রাসের মুখে। তাই শনিবার সকালেই ঘরের সবকিছু সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র তার দু’পুত্র আরাফাত হোসেন ও সিফাত হোসেন অসহায় মায়ের সাথে শুধু কাঁদছেন। কি হবে তাদের ভবিষ্যত কোথায় মাথা গুজবেন, সেই চিন্তায় তারা কোন পথই পাচ্ছে না। ঝালমুড়ি বিক্রেতা হেনা বেগম অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে পুরো সংসার চালতেন। সারা দিন কষ্টের যে ঘরে ফিরতেন এখন সেই ঘরই শেষ। এখন অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কোথায় যাবে সেই জায়গা পাচ্ছে না। রাস্তার পাশেও কোন জায়গা খালি নেই। বাড়িঘর হারা বহু মানুষ এখন ঠাঁই নিয়েছে আশপাশের রাস্তায়। জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল জানান, ভাঙ্গন পরিস্থিতি সরকারে উচ্চ পর্যায়ে অবগত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। মিশন হাসপাতাল মেঘনায় বিলীন নিজস্ব সংবাদদাতা, ভোলা থেকে জানান, ভোলা ইলিশা চডার মাথায় এলাকায় গত প্রায় এক মাস ধরে রাক্ষুসে মেঘনা কয়েক শত বসতঘর ভিটা মাটি দোকানপাট, মৎস্য ঘাট গিলে খেয়েও শান্ত হয়নি। এবার ইলশা রাজাপুরের গরিব মানুষের বিনা মূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশন হাসপাতাল বিলীন হয়ে গেছে। শনিবার সকালে মেঘনার ভাঙ্গনে হাসপাতালের মালামালও সরাতে পারেনি। ভোলা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কসহ একের পর এক জনপদ বিলীন হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড এ পর্যন্ত প্রায় ৪-৫ কোটি টাকার জিও ব্যাগ ভর্তি বালির বোস্তা ডাম্পিং করে মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন রোধে ব্যর্থ হওয়ায় এ ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এদিকে পানি সম্পদমন্ত্রীর নির্দেশে ভোলা ইলিশা চডার মাথা এলাকায় পাউবো গত ২ দিন কয়েক টন ওজনের জিও টিউব ব্যাগ ডাম্পিং করলেও রেইট নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় শনিবার থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে। এদিকে ভাঙ্গনের মুখে থাকা ইলিশা জংশন বাজারের ব্যবসায়ী এখন চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ভোলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশন হাসপাতালের প্রোগ্রাম ইনচার্জ হুমায়ুন কবির জানান, ভোলা সদর উপজেলার ইলশা জংশন এলাকায় তাদের হাসপাতালে হোমিও ও এলোপ্যাথিক চিকিৎসা দেয়া হতো। মাদারীপুরে ১০ বাড়ি নদীতে নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর থেকে জানান, শনিবার ভোরে কালকিনির এনায়েত নগর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের ১০টি বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে আড়িয়াল খাঁ নদে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে আলীপুর হাই স্কুল, আলীপুর লাল চান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলীপুর দাখিল মাদ্রাসা ও আলীপুর মোল্লারহাট বাজার। জানা গেছে, শনিবার ভোরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলীপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম মোল্লা, গিয়াস উদ্দিন মোল্লা, মহসিন মোল্লা, মোতালেব ফকির, জলিল ফকির, কুদ্দুস শেখ, শিবুল সরদার, বাবুল সরদার, শান্তি ফকির, হেমায়েত মোল্লার ঘরবাড়ি নদে বিলীন হয়ে যায়। এ সময় কেউ কিছু সরাতে পারেনি। এখনও ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, নদীর পার্শ্ববর্তী ওই এলাকার অর্ধশত বাড়িঘর, স্কুল-মাদ্রাসা ও হাট-বাজার। জরুরী ভিত্তিতে ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। টাঙ্গাইলে দেড় শ’ পরিবার নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল থেকে জানান, সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবার লৌহজং নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। যমুনার শাখা লৌহজং নদীতে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙ্গনও শুরু হয়েছে। গত তিনদিনে বড় বাসালিয়া গ্রামের নদী তীরবর্তী অর্ধশতাধিক পরিবার বাড়িঘর সরিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। অন্যরাও বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছে। ভাঙ্গনের ফলে নির্মাণাধীন একটি ব্রিজ, স্কুল ও তীরবর্তী বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে। কুড়িগ্রামে বাঁধে ভাঙ্গন স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, রৌমারীতে জিঞ্জিরাম নদীর তীব্র স্রোতে গত দুদিনে চেংটাপাড়া বাঁধের ২৫০ ফুট, চরের গ্রামে ১৫০ ফুট ও সুতিরপার এলাকায় ১শ’ ফুট ভেঙ্গেছে। এই ইউনিয়নে ৭টি বাঁশের সাঁকো বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে।
×