ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

’৭৫ থেকে ’৮১- কেমন ছিল বাংলাদেশ?

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৩০ আগস্ট ২০১৫

’৭৫ থেকে ’৮১- কেমন ছিল বাংলাদেশ?

১৭ মে বিকেলে ঢাকায় বিমান থেকে নামেন শেখ হাসিনা। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ১০-১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল সে সংবর্ধনায়। গতকালের পর আজ পড়ুন ষষ্ঠ কিস্তি.... ঢ. বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির যে সূত্রপাত হয়েছিল তা ধীরে ধীরে আরও প্রকট হতে থাকে। ক্ষমতার লোভ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আদর্শের লড়াই, বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব মিলিয়ে এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে। ক্যু ও পাল্টা ক্যু ইত্যাদি ঘটনায় সংঘর্ষ এবং ফাঁসিতে কয়েক হাজার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। পঁচাত্তরপরবর্তী ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনী প্রধান, উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে তিনি তাঁর অবস্থানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে বিএনপি গঠন করে তিনি রাজনীতিকে পরিচালিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতদসত্ত্বেও জেনারেল জিয়া প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তাঁর পুরো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নানা কারণে হত্যা, মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল যা জেনারেল জিয়া পুরো উপলব্ধি কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। এ সময়ে ২৯ মে ১৯৮১ চট্টগ্রাম সফরে এসে সার্কিট হাউসে উঠলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। সঙ্গে আছেন বিএনপির মহাসচিব ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ৩০ তারিখ ভোরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের একদল সৈনিকের হাতে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে তার আট দেহরক্ষী। এটি শুধু জিয়াকে হত্যা নয়, ক্ষমতা দখল করার একটি পরিকল্পনার অংশ ছিল বলেই পরবর্তীতে প্রতীয়মান হয়। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, একটি ক্যু সংঘটিত করার লক্ষ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্রোহী অফিসাররা চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী কালুরঘাটে ৩০ মে রাতে জড়ো হতে শুরু করে। লে. কর্নেল মতিউর রহমান, মেজর মোজাফফর, ক্যাপ্টেন সৈয়দ ও ক্যাপ্টেন মনির সবার আগে সেখানে পৌঁছান। এর কিছুক্ষণ পরই একটি এক্স জীপ ও দুটি এক্স পিকআপে আসেন ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হোসেন খান, ক্যাপ্টেন মোঃ আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন রফিকুল হোসেন খান, লে. মোসলেউদ্দিন আহমদ এবং সুবেদার সাফদার রহমান। একই সময়ে ষষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল ফজলে হোসেন ক্যাপ্টেন জামিল হককে নিয়ে সেখানে পৌঁছান। সেই গভীর রাতে একে একে অন্যান্য সেনা অফিসাররাও এই কালুরঘাটে এসে জড়ো হন। দুটি এক্স জীপ ও একটি পিকআপে আসেন ১৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর গিয়াসউদ্দিন, ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর কাজী মনিরুল হক এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। সবশেষে পৌঁছান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর এসএম খালেদ, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর ফজলুল হক এবং ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের স্টাফ ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। বিদ্রোহী দলের সিনিয়র অফিসার লে. কর্নেল মতিউর রহমান তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিং প্রদান করেন। অতঃপর কালুরঘাট ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সেনাবহর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের দিকে রওনা হয়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে আনুমানিক রাত ৪টার দিকে লে. কর্নেল মতিউর রহমান একদল সৈন্য নিয়ে গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে অতর্কিতে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে দ্রুত উপরতলায় চলে যান। প্রথমেই তারা প্রেসিডেন্টের ৮ জন দেহরক্ষীকে হত্যা করে। জেনারেল জিয়া সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে যাবার চেষ্টা করলে কয়েকজন সৈন্য তাকে গুলি করে এবং তিনি বারান্দায় পড়ে যান। সৈন্যদের স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে তাঁর শরীর, মুখমণ্ডল ও মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কাজ শেষ করে বিদ্রোহীরা সার্কিট হাউস ত্যাগ করে। আনুমানিক সকাল ৮টার দিকে বিদ্রোহীরা ৫টি জীপে সার্কিট হাউসে এসে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া, প্রধান নিরাপত্তা অফিসার লে. কর্নেল এহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ নিয়ে যায়। রাঙ্গুনিয়ার একটি পাহাড়ের পাদদেশে এ তিনজনকে সমাহিত করা হয়। পার্শ¦বর্তী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনজন ছাত্র এ ঘটনা দেখে ফেলে এবং পরবর্তীতে তা জানাজানি হয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অপর একটি দল ভোর রাতেই বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের দখল নিয়ে নেয়। সকাল ১০টা থেকেই এই বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠনের কথা প্রচার করতে থাকে। দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন জেনারেল মঞ্জুর সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশে জেনারেল মঞ্জুর ঢাকায় সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল নুরুদ্দীনের কাছে চার দফা দাবিনামা পেশ করেন। দাবিগুলো ছিল: ১. দেশব্যাপী সামরিক আইন জারি ২. দেশের প্রধান বিচারপতিকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ ৩. জাতীয় সংসদ বাতিল এবং ৪. নবগঠিত বিপ্লবী পরিষদকে স্বীকৃতি প্রদান। জেনারেল নুরুদ্দীন এ সকল দাবি প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ প্রদান করেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিদ্রোহীরা চট্টগ্রামকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কুমিল্লা এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শুভপুর ব্রিজে একদল সৈন্য প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এই সৈন্যদল স্বপক্ষ ত্যাগ করে সরকারী পক্ষ অবলম্বন করলে বিদ্রোহীদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। জেনারেল মঞ্জুর বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। ৩১ মে রাত তিনটার দিকে জেনারেল মঞ্জুর তার স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে এবং কর্নেল দেলোয়ারের স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েসহ একটি জীপে করে চট্টগ্রামের পাইদং গ্রামে যান। সেখান থেকে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে হেঁটে খৈয়াপাড়া চা বাগানে এক উপজাতীয় কুলির ঘরে আশ্রয় নেন। পরদিন বিকেলবেলা হাটহাজারী থানা সার্কেল ইন্সপেক্টর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, এএসআইয়ের দুই কর্মকর্তা এবং ফটিকছড়ি থানার ওসি একদল পুলিশসহ সেখানে উপস্থিত হয়ে কুলির ঘর থেকে জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে। বিকেল ৫টার দিকে মঞ্জুর এবং অন্যদের হাটহাজারী থানায় নেয়া হয়। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমদ সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নির্দেশ মোতাবেক পুলিশকে অবিলম্বে বন্দী মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার আবদুল আজিজের নিকট হস্তান্তর করার আদেশ দেন। অতঃপর পুলিশ হাটহাজারী থানা থেকে ক্যান্টনমেন্টে যাবার পথে ক্যাপ্টেন ইমদাদুল হকের নিকট বন্দীদের হস্তান্তর করেন। ক্যাপ্টেন ইমদাদ জেনারেল মঞ্জুরের হাত-পা বেঁধে চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেন। একটি জীপে মঞ্জুর এবং দেলোয়ারের পরিবারের সদস্যদের উঠিয়ে নিয়ে মঞ্জুরের বাসার দিকে পাঠানো হয়। আরেকটি জীপে জেনারেল মঞ্জুরকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দফতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। মঞ্জুরকে বহনকারী জীপটি সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্টাল শপের সামনে পৌঁছামাত্রই ২০/৩০ জন সশস্ত্র সৈন্যের একটি দল জীপটিকে ঘিরে ফেলে এবং টেনেহিঁচড়ে মঞ্জুরকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নামিয়ে ফেলে। কালবিলম্ব না করে গুলি করে মঞ্জুরকে সেখানেই হত্যা করা হয়। বন্দী মঞ্জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পূর্বেই হত্যা করার পেছনে বড় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কিনা তা আজও জানা যায়নি। ৩০ মে ১৯৮৯ জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সেদিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেন। ৩১ মে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ বেতারে প্রদত্ত এক ভাষণে বিচারপতি সাত্তারের অস্থায়ী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ১ জুন রাঙ্গুনিয়া থেকে জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং ২ জুন জানাজা শেষে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেরেবাংলানগরস্থ চন্দ্রিমা উদ্যানে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার দল বিএনপিই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন এবং সংবিধান অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন ৪ জুন ১৯৮১। ২২ জুন বিএনপি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকেই প্রার্থী ঘোষণা করে। বিচারপতি আবদুস সাত্তারের প্রার্থী হওয়া নিয়ে আইনী জটিলতা এবং তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সরকার ৮ জুলাই সংবিধানে ষষ্ঠ সংশোধনী এনে বিচারপতি সাত্তারের প্রার্থিতা নিয়ে আইনী সঙ্কট দূর করেন। চলবে... লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×