ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাস্তার ওপর ডাস্টবিন, চারদিকে বাসাবাড়ির বর্জ্যসহ ময়লা ফেলা হচ্ছে;###;প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদন ৪ হাজার টন, অপসারিত হচ্ছে ৩ হাজার টন ;###;দুর্গন্ধে চলাচল কঠিন

বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা মহানগর ॥ আবর্জনায় এশাকার

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৩০ আগস্ট ২০১৫

বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা মহানগর ॥ আবর্জনায় এশাকার

শাহীন রহমান ॥ এই রাস্তাটা না! উহ! মনে হচ্ছে, আমার জামা থেকেই দুর্গন্ধ বের হবে। টিভিতে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের দৃশ্য এটি। যেখানে দেখানো হয়েছে, এক কিশোরী ময়লা-আবর্জনার ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে বাসে চড়ে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধে এমন উক্তি করছে। বিজ্ঞাপনের কল্যাণে পাশে বসা অপর একটি মেয়ের জামা থেকে হুইল পাউডারের সুগন্ধি বের হলেও ঢাকার বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। কঠিন, তরল ও স্যুয়ারেজ বর্জ্যরে কারণে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি দিন দিন অসহনীয় হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রাস্তা ও অলিগলি দখল করে আবর্জনা ফেলে পরিবেশকে চরম দুর্বিষহ করে ফেলা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর আশপাশে দিয়ে চলাফেরা করাই দায় হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে বিভিন্ন রাস্তা ও অলিগলি ঘুরে দেখা গেছে ঢাকার প্রায় সব রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে আবর্জনা ফেলার কন্টেনার। আর কন্টেনারের চারদিকে পুরো রাস্তা দখল করেই বাসাবাড়ির বর্জ্যসহ অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। দুর্গন্ধের কারণে পাশ দিয়ে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই এমনটা ঘটছে। এর পেছনে নাগরিকদের দায় রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলাও রয়েছে। তাদের দায়িত্ব সচেতনতার অভাবেই মূলত এমনটি ঘটছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাংলামোটর থেকে মগবাজার পর্যন্ত সামান্য দূরত্বের রাস্তার ওপর বসানো হয়েছে আবর্জনা ফেলার তিনটি কন্টেনার। এর চারদিকেই ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাস্তা দখল করে সরু করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া দুগর্ন্ধের কারণে চারদিকের পরিবেশটাও অসহনীয় হয়ে পড়েছে। নাকে রুমাল ছাড়া এর পাশ দিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। মাঝে মধ্যে আবর্জনা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলেও গন্ধরোধে কখনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে আশপাশের পরিবেশটা দূষিত হয়ে পড়ছে। শুধু বাংলামোটর বা মগবাজার নয়; ঢাকার বেশিরভাগ এলাকার চেহারা একই। রাজধানীর অভিজাত এলাকায়ও আবর্জনার দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি মিলছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখার পেছনে যেমন নাগরিকদের দায় রয়েছে তেমনি দায়িত্বহীনতা রয়েছে নগর কর্তৃপক্ষেরও। শুধু যে রাস্তার ওপর ফেলে রাখা ডাস্টবিন ঢাকার পরিস্থিতি অসহনীয় করছে তা নয়। এর বাইরে রয়েছে ওয়াসার তরল ও পয়োবর্জ্য। এছাড়া যত্রতত্র প্রকাশ্যে রাস্তার মাঝখানে মল-মূত্র ত্যাগ করে পরিবেশটা নষ্ট করা হচ্ছে। ঢাকার কাওরানবাজার ও মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। অথচ এসব রোধে কোন উদ্যোগ কাজে আসেনি। বর্জ্য অপসারণেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকার পরিবেশ রক্ষায়ও তারা ব্যর্থ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কারণেই মূলত আন্তর্জাতিক জরিপে ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য তালিকায় উঠে আসছে। সম্প্রতি দেশের পরিবেশ সংগঠন পবার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ঢাকায় প্রতিদিন ১৩ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য তৈরি হচ্ছে; যার মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন। পাগলা পয়োবর্জ্য পরিশোধনাগারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। সংগঠনের নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, এসব কারণে নদীর পানির গুণগত মানের অবনতি হচ্ছে। অতি দূষণে নদীর মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। জীবাণুজনিত দূষণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, রাস্তাঘাট, স্যুয়ারেজ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিদ্যুত ও পানির লাইনসহ বিভিন্ন সেবার অবকাঠামো তৈরি ও মেরামতে সরকার জনগণের টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু এ কাজেও কোন সুফল মিলছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থপনা না থাকায় ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা মহানগর। এতে একদিকে যেমন প্রতিনিয়ত ঢাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। অন্যদিকে চারদিকের নদীনালা, খালবিলও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। এখনও গৃহস্থালি বর্জ্য অপসারণ করা হয় অবৈজ্ঞানিক ও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। সৃষ্ট বর্জ্যরে বেশিরভাগ রাস্তাঘাটে বা বাসা-বাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকছে। এসব বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সরাসরি খাল বা নদীতে পড়ছে। বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। ফলে আন্তর্জাতিক এক সংস্থার জরিপে ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় উঠে আসছে। সরেজমিন রাজধানীর রোকেয়া সরণিতে গিয়ে দেখা গেছে সরণির বেশ কয়েকটি জায়গায় মাঝখানে রাখা হয়েছে বর্জ্য ফেলার কন্টেনার। বর্জ্য ফেলার জন্য কন্টেনার রাখা হলেও আশপাশে রাস্তার ওপর বেশি ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। সরণির তালতলা বাসস্ট্যান্ডের পাশেই রাস্তার ওপর আবর্জনা এমনভাবে ফেলা হচ্ছে যে এখন রাস্তার ৭৫ ভাগ বর্জ্যরে দখলে গেছে। বর্জ্যরে দুর্গন্ধের কারণে নাকে রুমাল চেপে প্রতিদিন বাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকে হাজার হাজার যাত্রী। আবার যখন বাস বর্জ্যরে কন্টেনারের কাছে গিয়ে যাত্রী ওঠানোর জন্য থামে তখন ভেতরে থাকা যাত্রীদের অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। নাকে রুমাল দিয়ে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে। এ সরণির শেষ মাথায় মিরপুর ১০ নম্বর ওভারব্রিজের কাছেই রাস্তা দখল করে তৈরি করা হয়েছে ডাস্টবিন। এখানে বর্জ্য ফেলার জন্য একটি কন্টেনার রাখা হলেও দূষিত করছে আশপাশের পরিবেশ। অথচ রাজধানীর অতিব্যস্ততম এলাকার মধ্যে এটি একটি। এর পাশ দিয়ে হেঁটে এবং বাসে চড়ে যেতে সব যাত্রীকেই দেখা গেল নাকে রুমাল চেপে ধরতে। মিরপুর দারুস সালাম রোডের সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পাশেই রাস্তার ওপর ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন বানানো হয়েছে। এখানেও ময়লা ফেলার জন্য একটি কন্টেনার রাখা হলেও এর চারদিকেই আবর্জনা ফেলে রাস্তায় চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হেঁটে, বাসে অথবা রিকশায়ও এলাকা অতিক্রম করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আবার এখানেই প্রতিদিন আবর্জনা ফেলার পাশাপাশি বর্জ্যরে ভেতর থেকে কাগজসহ পুনঃ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য দ্রব্য বাছাইয়ের কাজ করা হয়। ফলে অনেকদূর থেইে নাকে দুর্গন্ধ এসে লাগে। শুধু মিরপুর বা রোকেয়া সরণি নয়। এ অবস্থা সারা ঢাকা শহরের। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা নিউমার্কেটের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ওভারব্রিজের নিচে রাস্তা দখল করে রাখা হয়েছে বর্জ্যরে কন্টেনার। অথচ এর চারদিকেই লোকজনের চলাচল। মুখে রুমাল ছাড়া এর পাশ দিয়ে চলাচল করা যায় না। অনেককে এখানে বসে প্রাকৃতিক কর্ম সারতেও দেখা গেছে। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, প্রতিদিন এখানকার ময়লার অসহনীয় দুর্গন্ধের মধ্যেই তাদের চলাফেরা করতে হয়। ফুটপাথে কিংবা সড়ক বিভাজনে পথশিশুদের মল ও মূত্র ত্যাগের দৃশ্যও এখন হরহামেশায় চোখে পড়ে এই রাজধানীতে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছেÑ সরকার এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দেয়ালে আরবী ভাষা লিখে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল; যাতে আরবীর লেখা দেখে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ শহরের কেউ যেন ভয়ে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ না করে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি। সরেজমিনে এসব জায়গা ঘুরে দেখা গেছে আরবী লেখার পাশেই মল-মূত্র ত্যাগ করছে অনেকে। সেখান থেকে মল-মূত্র রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন শতশত মানুষের চলাফেরার মধ্যেই অনেকে এসব জায়গায় দাঁড়িয়ে মূত্র ত্যাগ করছে। আর তাদের দু’হাঁটুর নিচ দিয়ে তা রাস্তায় চলে আসছে। ব্যস্ততম রাজধানীর কাওরানবাজার ও দারুসসালাম রোডের টেকনিক্যাল মোড়ে প্রকাশ্য মূত্র ত্যাগের এমন অসনীয় অবস্থা সবার চোখের সামনেই পড়ে। অথচ টেকনিক্যাল মোড়ে প্রকাশ্য মূত্রত্যাগের স্থানেই রয়েছে একাধিক ভ্রাম্যমাণ টয়লেট। মাত্র ৫টাকায় প্রাকৃতিক কর্ম সারার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু কেউ সেদিকে যায় না। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকলে এ বর্জ্যই সম্পদে রূপান্তর করা যেত। বর্জ্য থেকেই উৎপাদন করা যেত বিদ্যুত, জৈব সারসহ মূল্যবান সম্পদ। অথচ যেখানেসেখানে এ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ডাম্পিং করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ডাম্পিংয়ের ফলে ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের খাল-বিল হারিয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। ডিসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৪ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। মহানগরীতে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের বসবাস। এর সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৩০ লাখ মানুষ। এই দেড় কোটি মানুষের প্রতিদিন ৪ হাজার টন বর্জ্যের মধ্যে ডিসিসি অপসারণ করতে পারে ৩ হাজার টন। বাকি বর্জ্য পড়ে থাকছে এখানে ওখানে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনঘনত্ব বিবেচনায় মাস্টারপ্ল্যানের অভাব, ত্রুটিযুক্ত ডিজাইন ও বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে মহানগরীর ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় মহাবিপর্যয় ধেয়ে আসছে। অপ্রতুল পয়োবর্জ্য ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করছে। বিদ্যমান স্যুয়ারেজ সিস্টেমের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও অপরিকল্পিতভাবে নিত্যনতুন বাসাবাড়ির বর্জ্যরে সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ধারণ ক্ষমতা বিবেচনা না করে নতুন নতুন সংযোগের ফলে অধিকাংশ সময়ই আগের ড্রেনের সঙ্গে নতুন লাইনের সংযোগ ম্যাচ করে না। নতুন সংযোগ বা বিদ্যমান লাইন মেরামতের সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে বর্জ্য রাস্তায়ই ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ধুলা আর বর্ষাকালে কাদা জমে জনদুর্ভোগ বাড়াচ্ছে।
×