ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

১৫ মেট্রিক টন আটকে দিলেন স্থানীয় লোকজন

উখিয়ার খাদ্যগুদামে নিম্নমানের চাল সরবরাহের চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৩০ আগস্ট ২০১৫

উখিয়ার খাদ্যগুদামে নিম্নমানের চাল সরবরাহের চেষ্টা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ সরকারের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে সস্তা দামের নিম্নমানের চাল সরবরাহ করার সময় উখিয়া খাদ্যগুদামে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা শনিবার ১৫০ মেট্রিক টন চাল বোঝাই নয়টি ট্রাক আটক করেছে। নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, স্থানীয় খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে মিল মালিকগণ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজার থেকে নিম্নমানের চাল সরকারী গুদামে সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান সিকদার বলেন, উখিয়া খাদ্যগুদাম ভরা হচ্ছে নিম্নমানের চালে। স্থানীয় বাজার থেকে মিল মালিকরা এক কেজিও সংগ্রহ করেননি। এ কারণে স্থানীয় শত শত কৃষকের ধান তাদের গোলায় রয়ে গেছে। তাই গুদামে ভরার জন্য সাতক্ষীরা থেকে আনা ৯ ট্রাক চাল আটকে আমরা বঞ্চিত কৃষকের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছি। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন নিম্নমানের খাদ্য সংগ্রহ প্রসঙ্গে বলেন, নিম্নমানের খাদ্য সংগ্রহের অভিযোগে গত বুধবার রামুতে ৪৩ মে. টন চাল বোঝাই দুটি ট্রাক আটকের পর মামলা করা হয়েছে। এমনকি এ অভিযোগে দফায় দফায় খাদ্য সংগ্রহও বন্ধ করা হয়। উখিয়ায় আটক চাল বোঝাই নয়টি ট্রাক নিয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ তানভীর হোসেন জানান, উখিয়ায় আটক চাল বোঝাই নয়টি ট্রাকের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে কক্সবাজারে সরকারী খাদ্যগুদামে চলতি মৌসুমে চাল সংগ্রহে ব্যাপক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনায় জেলাজুড়ে তোলপাড় চলছে। জেলার খাদ্যগুদামগুলোতে সংগ্রহকৃত চালগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কমিশনভিত্তিক রাইস মিল মালিক নামে কতিপয় কালোবাজারির কাছ থেকে নিম্নমানের চাল কিনে গুদামভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ সচেতন মহলের। চলতি মৌসুমে আট হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও স্থানীয় পর্যায়ে কোন কৃষকের কাছ থেকে এক মুঠো চালও কেনা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই কালোবাজারি সিন্ডিকেট নিম্নমানের চাল কিনে তা সরকারী খাদ্যগুদামে সরবরাহ দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কালোবাজারি সিন্ডিকেট সদস্যরা দুর্নীতির মামলা থেকে রক্ষায় মোটা অঙ্কের মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে। পচা চাল গুদাম ভর্তি করা এবং একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ৪৩ মে. টন চাল জব্দের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। কয়েক ধান্ধাবাজ নেতার মাধ্যমে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ধর্ণা দিচ্ছে তারা। সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমের ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের আওতায় কক্সবাজারে ছয়টি উপজেলার পাঁচটি খাদ্যগুদামে এবার আট হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। সে মোতাবেক স্থানীয় খাদ্য বিভাগ বেশকিছু মিলারকে চুক্তিবদ্ধ করেছে। এরই মধ্যে জেলার পাঁচটি সরকারী খাদ্যগুদামে চলতি মৌসুমের চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। ৩১ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করার চুক্তি করে মিলাররা। কিন্তু খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বেঁধে দেয়া উৎকোচ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন তারা। এতে প্রকাশ পেয়ে যায় পচা চালে গুদাম ভর্তি করার ঘটনা। এভাবে নিম্নমানের চাল রামু খাদ্যগুদামে ভর্তি করার সময় ৪৩ মে. টন চাল আটক করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহা। এরপর দুর্নীতিবাজ খাদ্য কর্মকর্তা ও কালোবাজারি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে মানববন্ধন করেছে রামুর কৃষকরা। উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া ও টেকনাফের খাদ্যগুদামে ইতোমধ্যে কালোবাজারিদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা চালগুলো মান নিয়ন্ত্রণের জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন মহল। পাঁচ গুদামে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মে. টন চাল সরবরাহ হয়েছে বলে জানায় খাদ্য বিভাগ। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা তানভীর হোসেন ছয়টি গুদামে নিয়োজিত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সরকারী নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নিম্নমানের চাল সংগ্রহ করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই সব এলাকায় যে সব রাইস মিলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, সে সব মিল মালিকরা একমুঠো ধানও স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কেনেননি। নামসর্বস্ব কিছু রাইস মিলের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে তারা কম দামে ও নিম্নমানের চাল (খাবার অনুপযোগী) হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বগুড়া, আশুগঞ্জ, চাক্তাইসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে সরকারী বিধিবহির্ভূতভাবে খাদ্য গুদামে সরবরাহ করছে। এ কালোবাজারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন উখিয়ার আবদুর রহিম, কক্সবাজারের রফিক, সাগর, বুলবুল, লিঙ্করোডের আকতারসহ আরও ৮-১০ জন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে তা মিলিং করে খাদ্যগুদামে সরবরাহ করা হয়েছে কাগজেপত্রে দেখানো হলেও অনেক স্থানে চুক্তিবদ্ধ হওয়া রাইস মিলের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চুক্তিবদ্ধ হওয়া রাইস মিলগুলো যে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করেনি, তার প্রমাণ হচ্ছে গত কয়েক মাসের বিদ্যুত বিল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যে পরিমাণ ধান মিলিং করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছেÑ সেই পরিমাণ বিদ্যুত বিল ওই সব মিলে আসেনি। যদিও বা তাদের দাবি সংশ্লিষ্ট মিলগুলোতেই ধান মিলিং করা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যদি ধান মিলিং করে তাহলে তাদের বিদ্যুত বিল বাড়বে। কিন্তু বিদ্যুত বিল রয়েছে স্বাভাবিক। তাহলে তারা কি চোরাই বিদ্যুত দিয়েই ধান মিলিং করেছে? এমনটা প্রশ্ন সচেতন মহলের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা তানভীর হোসেন প্রত্যেক মিলারদের কাছ থেকে চুক্তির সময় টনপ্রতি দুই হাজার পাঁচ শ’ টাকা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর শাহ জামাল, রামুর ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা, খাদ্য পরিদর্শক মিলে প্রতিটন দুই হাজার টাকা ও গুদামে চাল বুঝিয়ে দেয়ার সময় মাননিয়ন্ত্রণ এবং ওজন করার সময় টন প্রতি পাঁচ শ’ টাকা উৎকোচ নিয়েছে। তাই চাল সংগ্রহের সময় অবাধ অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। সাধারণ মিলাররা অভিযোগ করেন, চকরিয়া উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শশীধর চাকমা, কক্সবাজার সদর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা শাহ জামাল, রামু উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা সুজিত বিহারী সেন, উখিয়া উপজেলা ও টেকনাফ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও সংশিষ্ট খাদ্য পরিদর্শক ও মিল মালিক সমিতির নেতাদের যোগসাজশেই উৎকোচ আদায় করায় অনেক মিলার নিম্নমানের চাল দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। একজন মিল মালিক বলেন, সরকার বেশি দামে চাল কেনায় মিলাররা এবার কিছুটা লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু প্রতি টনে খাদ্য বিভাগের লোকজনকে প্রায় প্রতি কেজিতে ১০-১১ টাকা ও গাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ করে আর লাভের কিছুই থাকছে না। তিনি জানান, সরকারি গুদামে চাল দিতে গিয়ে প্রতি বছরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিতে হয়। এবার মিল মালিক সমিতির জেলা ও উপজেলা নেতারা সেই উৎকোচের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ঘুষের হার বেশি ধরা হয়েছে। রামু এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক মিলার অভিযোগ করেন, উৎকোচ না দিয়ে সরকারী গুদামে চাল দিতে গেলে চাল ভালমানের হয়নি এমন অজুহাত দেখিয়ে ফেরত পাঠান কর্মকর্তারা। এতে আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। মিল মালিক নেতাদের সঙ্গে জড়িত থাকায় কোনও প্রতিবাদও করা যায় না। তারা আরও জানান, এবার শুধু বোরো মৌসুমের চাল সংগ্রহ অভিযানে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, খাদ্য পরিদর্শক ও ওসিএলএসডি কর্মকর্তারা কয়েক কোটি টাকার উৎকোচ পকেটে ভরেছেন। চাল সংগ্রহে দুর্নীতি হয়নি দাবি করে কক্সবাজার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহাগ চন্দ্র সাহার নেতৃত্বে গঠিত টিম তদন্ত না করা পর্যন্ত চাল সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে।
×