ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ নেতৃত্বে অনৈক্য তৃণমূলের ঐক্য বিনষ্ট করে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৯ আগস্ট ২০১৫

শীর্ষ নেতৃত্বে অনৈক্য তৃণমূলের ঐক্য বিনষ্ট করে

কিছুদিন আগেও কলাম লেখার বিষয়বস্তু খুঁজতে হতো। গত কয়েকদিন হলো বিষয়বস্তু খোঁজার দরকার পড়ছে না। বিষয়বস্তুই লেখার টেবিলে উপচে পড়ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে একে অপরের প্রতি প্রশ্নবাণ, প্রবীর শিকদার নামে একজন সাংবাদিককে অহেতুক আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করা, খারাপ লোকদের ‘মেধাবী’ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়া, এমন সব ইস্যু সামনে চলে আসছে। সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে দেশের বেশিরভাগ সংবাদপত্রের সম্পাদকের যৌথ বিবৃতি প্রকাশ, এ ইস্যুগুলো এখনকার জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন। অথচ যে মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য বেশি করে প্রয়োজন তখন ওই ধরনের বিতর্ক মোটেই অভিপ্রেত নয়। যেহেতু এখন শোকের মাস আগস্ট, যে মাসে ঘাতকের নির্মম বুলেটে জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ মাসেই জাতি হারিয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে, যিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীই ছিলেন না, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সবচে বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা, পরামর্শদাতা, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে (বঙ্গবন্ধু তো জেলেই কাটান রাজনৈতিক জীবনের অর্ধেকটা সময়) আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ পরিচালনায় অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে আমরা হারিয়েছি আদরের ছোট্ট শিশু রাসেলসহ তিন ভাইকে। বড় ভাই শেখ কামাল বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা এবং দেশের এক নম্বর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তথা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পুত্র হয়েও সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন, লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি করেছেন। ‘হাওয়া ভবন’, ‘খোয়াব ভবন’ বা সরকারের বিকল্প সরকার বানিয়ে লুটপাটের আখড়া বানাননি, কিংবা ‘ডান্ডি ডাইং’, ‘মার্শাল ডিস্টিলারি’ বা ‘কোকো-ওয়ান, টু, থ্রি...’ বানানোর পথে না গিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি-খেলাধুলা এসব নিয়ে থেকেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’, ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’, ‘ঢাকা থিয়েটার’ নিয়ে আমরা গর্ব করি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর শিল্প-সংস্কৃতি ও খেলাধুলার আধুনিকায়নের প্রধান সংগঠকও ছিলেন শেখ কামাল। শিল্প-সংস্কৃতি, খেলাধুলার প্রতি তার অনুরাগের আরেকটি উদাহরণ হলো তিনি বিবাহ করলেন নিজের মতোই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রীড়াবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী সুলতানাকে। ঘাতকরা তাকেও হত্যা করল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। ২০০৪-এর আগস্টেরই ২১ তারিখ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে সিরিজ গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত হয়েছিল। আল্লাহর অশেষ কৃপায় শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও নিহত হন দেশের অন্যতম প্রধান নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। যাদের মধ্যে শরীরে স্পিøন্টার নিয়ে পরে মারা যান দলের জনপ্রিয় নেতা আবদুর রাজ্জাক ও মেয়র মুহম্মদ হানিফ। অনেকে আজও স্পিøন্টারের যন্ত্রণা সয়ে বেঁচে আছেন। গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চালানো হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতিবারই শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন এবং করছেন। হয়ত শেখ হাসিনাকে বাঙালী জাতির নেতৃত্ব দিতে হবে বলেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রবাস জীবনযাপনে বাধ্য হয়েও পিতার মতোই সাহসী, দূরদর্শী এবং দক্ষ নেতৃত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮১-র ১৭ মে থেকে অদ্যাবধি ৩৪ বছর জাতির নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে ‘উপচেপড়া শস্যভা-ার’-এর গর্বিত রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু, পরিবার ও জাতীয় ৪ নেতার হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করে একটি বড় অপরাধবোধ থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এই ঘোষণার সফল বাস্তবায়ন করে এবং কূটনৈতিক সাফল্যের মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, মিয়ানমারসহ আন্তর্জাতিক ভুবনে জাতিকে সম্মানের জায়গায় তুলে এনেছেন। এরই পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের দুষ্ট ক্যান্সার জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং নির্মূল করে চলেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন বিশ্বমানের এই অবস্থা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির জন্যে গৌরবের ও ভরসার। এক. যখন শুনি ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যিনি জাতীয় ৪ নেতার অন্যতম শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র, তিনি যখন বলেন ‘খাই খাই বন্ধ করতে হবে’ বা ‘ঐক্যবদ্ধ থাকুন-নইলে ভয়াবহ বিপদ ঘটে যেতে পারে’, তখন সচেতন নাগরিক সমাজের মধ্যে শঙ্কার উদ্রেক হয়। আমরা শঙ্কিত হই। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী-সমর্থক তথা সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কাউকে ভয় দেখানোর জন্যে এসব বলছেন না। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি হিসেবে সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছেন মাত্র। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেই নেতা যিনি ২০০৬-এর মিলিটারি অভ্যুত্থানের পর যখন শেখ হাসিনাসহ বেশিরভাগ দলীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়, কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, শেখ হাসিনাকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তখন এই আশরাফুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমানসহ যেভাবে দলের হাল ধরেছিলেন, ভীতসন্ত্রস্ত নেতা-কর্মীদের সাহস যুগিয়েছেন, তা আওয়ামী লীগ তো বটেই, যে কোন দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের জন্যে উদাহরণ হয়ে থাকবে। ওই সময়টাতে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা দলের অভ্যন্তরে ছদ্মবেশীর ‘সংস্কার’-এর কথাবার্তাও জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফের নেতৃত্বের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আজ জিল্লুর রহমান নেই, আশরাফুল ইসলাম আছেন। তিনি যখন কথা বলেন তখন তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ইতোমধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ অভিযোগ তুলেছে ‘আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা সংখ্যালঘুদের জমি দখল করছে।’ তাদের এই বক্তব্য আশরাফুল ইসলামের ‘খাই খাই’ মন্তব্যকে সমর্থন দেয়। অবশ্য ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ’-এর অভিযোগ কতখানি সত্য, কতখানি অসত্য তা তদন্তের দাবি রাখে। তারপরও বলব, আমাদের তো চোখ-কানও খোলা, আমরাও মাঝে-মধ্যে নিজ নিজ এলাকায় (মফস্বল) গ্রামে যাই। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে অনেক কিছু দেখতে পাই, অনেক কিছু শুনতে পাই। দুই. মহাজোট হয়েছে তাও এক দশক হয়ে গেল। মহাজোট ক্ষমতার পুরো এক মেয়াদ সম্পন্ন করে দ্বিতীয় মেয়াদেরও দেড় বছর অতিক্রম করল। বলতে হবে ভালভাবেই রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এরই মধ্যে এ সরকার অনেক বড় কাজ সম্পন্ন করছে এবং আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক তথা আমেরিকার মতো রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ঠিক তখনই প্রবীর শিকদারের মতো একজন সাংবাদিককে অসাধারণ বানানোর প্রকল্প হাতে নিলেন কেউ। প্রবীর শিকদার যে স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলেন তার ফেসবুকে তা কোন সাংবাদিক তো নয়ই, কোন সুস্থ লোকও সমর্থন করতে পারে না। ‘আমার মৃত্যু হলে অমুক (নাম দিয়ে)... ব্যক্তি দায়ী থাকবেন’-এটা সাংবাদিকতার কোন নীতিমালায় পড়ে না। আমি নিজে এমন সংবাদ কখনও লিখিনি, কখনও প্রকাশ করিনি। তারপরও বলব, পুলিশের বাড়াবাড়িও কম ছিল না। প্রবীর শিকদার একজন পঙ্গু মানুষ, দৌড়ে পালানোর মতো শারীরিক শক্তি তার মোটেই নেই। তারপরও কেন হাতকড়া পরানো হলোÑ এ প্রশ্ন অমূলক নয়। অথচ অভিযোগ আছে এই পুলিশেরই সহায়তায় বাচ্চু রাজাকার দেশ থেকে পালিয়ে গেছে, সিলেটের শিশু রাজন হত্যার মূল আসামিও দেশ থেকে পালিয়ে সৌদি আরব গেছে। পুলিশ পঙ্গু প্রবীর শিকদারকে হাতকড়া পরিয়ে টেনে নিয়ে যায় এবং তা টেলিভিশনে প্রদর্শন করে। অথচ গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা, সাঈদীদের হাতে হাতকড়া পরায়নি। বরং ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে আনা-নেয়ার সময় তাদের দুই আঙ্গুলের ভিক্টরি চিহ্ন বারবার দেখানো হয়েছিল। তবে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে প্রবীর শিকদারের জামিন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএফইউজে ও ডিইউজের নেতৃত্ব সরকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে তবেই তাকে ছাড়িয়ে আনেন। তাও নজিরবিহীনভাবে রিমান্ড বাতিল করে তাকে জামিন দেয়া হয়। তিন. ৪০ বছর পর আজ নতুন করে কথা উঠেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্যে কে দায়ী, কে দায়ী নয়। সবচে বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, মহাজোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন এ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, যা অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক। অবশ্য কিছুদিন থেকে এই বিতর্ক শুরু হয়েছে। যারা বলেন ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জাসদ জড়িত’ আমি এই প্রশ্নটি গুরুত্ব দিতে চাই এভাবে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে এবং বিচারে যারা গুলি চালিয়েছে মিলিটারির সেইসব ঘাতকের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে, সে যদি জাসদও হয় বা অন্য কোন দলেরও হয় এবং যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের বিচার আমিও চাই এবং যাদের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতার জীবন রক্ষা করা, সে যদি জেনারেল সফিউল্লাহই হোন আর জেনারেল জিয়াউর রহমানই হোন, তাদের বিচার হতে হবে। প্রয়াত হলেও মরণোত্তর বিচার করতে হবে। এ অনেকের মতো আমারও দাবি। কিন্তু এখনও দ-প্রাপ্ত সব খুনীর দ- কার্যকর করা যায়নি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কয়েকজন এখনও পলাতক। যে আমেরিকা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছিল, এমনকি আমাদের ওপর দূরপাল্লার বোম্বিং করার জন্যে সপ্তম নৌবহরে বঙ্গোপসাগরের পথে পাঠিয়েছিল (যদিও তা ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড-ফ্লিট প্রেরণের ফলে), আমেরিকা ফেরত যেতে বাধ্য হয়। সেই আমেরিকা সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদ-প্রাপ্ত এক খুনীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা কালো আফ্রিকার বারাক ওবামাকে মেনে নিলেও এখনও দ্বিতীয়-তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোর বিরুদ্ধে সাম্র্রাজ্যবাদী চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। এখনও তাদের কাছে খুনী ঘাতকদের মানবাধিকার আছে, ঘাতকের খুন হওয়া মানুষের মানবাধিকার নেই। একইভাবে কানাডাও বলেছে, যেহেতু তারা মৃত্যুদ-ে বিশ্বাস করে না সেহেতু বঙ্গবন্ধুর এক খুনীকে (বর্তমানে কানাডায় লুকিয়ে থাকা) ফেরত দেবে না। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, তবে তারা কি কানাডাকে খুনীদের অভয়ারণ্য বানাতে চায়? এর আগেও এক লেখায় বলেছি আমেরিকা নিজ দেশের মানবাধিকারের কথা বলে অথচ অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, সেই আমেরিকায় যেমন স্ট্যাচু অব লিবার্টি শোভা পায় না, তেমনি কানাডায়ও সভ্যতার মুখোশটি খুলে ফেলা উচিত। চার. বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জাসদ জড়িত কি জড়িত নয় তা অবশ্যই তদন্তের ব্যাপার। তবে বুধবার রাতে এটিএন নিউজ চ্যানেলে একটা টক-শোতে আলোচনা শুনলাম। সাংবাদিক প্রভাষ আমিনের সঞ্চালনে আলোচনায় অংশ নেন কর্নেল তাহেরের অনুজ প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, মহাজোট এমপি জাসদের নাজমুল হক প্রধান, বিএনপির এ্যাডভোকেট আহমদ আজম খান (খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা) এবং স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী হালের ‘লেখক গবেষক’ মহিউদ্দিন আহমদ। অবশ্য এ্যাডভোকেট আহমদ আজমও দাবি করলেন তিনি এক সময় জাসদ করতেন, পরে ছেড়ে দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। এ্যাডভোকেট সাহেব জাসদের মতো একটি গণভিত্তিক (হোক না সাময়িক) দল ছেড়ে মিলিটারির দলে ভিড়েছেন, অতএব মন্তব্য নিষ্প্র্রয়োজন। মহিউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি জাসদের রাজনীতির ওপর একখানা কেতাব লিখে আলোচনায় উঠে এসেছেন। এখানে তার কেতাবের দুটি মন্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও টুঙ্গিপাড়ায় সমাধিস্থ করার পর কর্নেল তাহের নাকি বলেছেন, ‘ওই লাশটা দাফন না করে বঙ্গোপসাগরে ফেলা হলো না কেন?’ দ্বিতীয় মন্তব্য হলো, ১৯৭৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় ৪ নেতার অন্যতম শহীদ এম মনসুর আলীর বাসভবনে নাকি গুলি করেছেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন। প্রফেসর আনোয়ার মহিউদ্দিন আহমদের ২টি মন্তব্যকেই অসত্য এবং বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেন। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর দাফন সংক্রান্ত কর্নেল তাহেরের মন্তব্যটি মহিউদ্দিন শুনেছেন জনৈক নঈম জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে। অতএব এখানেও মন্তব্য নিষ্প্র্রয়োজন। দ্বিতীয়ত ড. আনোয়ার নিজেই বলেছেন, তিনি গণবাহিনীর ঢাকা সিটি প্রধান ছিলেন বটে এবং তাদের লক্ষ্য ছিল সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কোনভাবেই, প্রশ্নই ওঠে না এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিও চালাননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিরাজমান প্রেক্ষাপটে কার লাভ হচ্ছে? মহাজোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কাকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার। জাসদ রাজনীতির লেখক যদ্দুর জানি বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে থেকেই জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে এনজিওর ব্যবসা শুরু করেছিলেন। শুনেছি ভালই করেছেন। সেই সুবাদে এনজিওর পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। এই পত্রিকার গত বৃহস্পতিবার সংখ্যায় একজন কলামিস্ট আইসিটি এ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিলে দেশের সম্পাদকদের বড় অংশের বিবৃতির ওপর তার কলামে লিখেছেন, ওই ৫৭ ধারা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং সাংঘর্ষিক। তিনি লিখেছেন, ৩৯ ধারায় রয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে নিরঙ্কুশভাবে, কোন পরিস্থিতি বা শর্তের সাপেক্ষে নয়’ অথচ ৩৯ ধারায় রয়েছে ‘(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে- ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অথচ কলামিস্ট সাহেব সুবিধামতো অংশটি তুলে দিয়ে জনমনে বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি নিজেও জানেন অথবা শিক্ষার দীনতার কারণে সংবিধান বুঝতে পারেননি, বুঝলেও তার বদমতলবই এতে ধরা পড়েছে। ঢাকা ॥ ২৮ আগস্ট ২০১৫ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
×