ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাপুরুষ সৃষ্টি করেনি কখনও

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৭ আগস্ট ২০১৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাপুরুষ সৃষ্টি করেনি কখনও

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, আমলাতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে আজকের আমলারাও হয়তো আমলা হতেন না। দেখা যায় ঢাকা বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নুন খাওয়া আমলাতন্ত্রের সদস্যরা সুযোগ পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে অপদস্থ করা যায় তার চেষ্টা করেছেন। এটা জাতীয় ট্র্যাজেডি। গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি... হার্টগের প্রথম কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পদে শিক্ষক নিয়োগ। এবং লন্ডনে বসেই তিনি এ প্রক্রিয়া শুরু করেন। লন্ডনের শিক্ষা দপ্তর, চ্যান্সেলর, নির্বাচকম-লীর বিভিন্নজনের সঙ্গে নিয়মিত চিঠিপত্র আদান-প্রদান শুরু হয়। ১৯২০ সালের আগস্ট মাসে গবর্নর রোনাল্ড শ’ হার্টগকে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করে তিনি লেখেন- “একটি বিষয়ে গোড়াতেই আমি গুরুত্ব দিতে চাই, তাহলো, প্রথম থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ‘চাকরি ব্যবস্থা’র শর্তাবলী থাকবে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিজনের সঙ্গে আলাদাভাবে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। এবং এসব আলোচনার ভিত্তি হবে প্রার্থীর যোগ্যতা, বয়স, অভিজ্ঞতা, সবার ওপরে তার নিজ বিষয়ে বাজারদরও (মার্কেট ভ্যালু) যাচাই করতে হবে। মি. স্টেপলটনের বাজেটে ওভারসিজ অ্যালাউন্স নামে একটি বরাদ্দ আছে; বুঝতেই পারছেন আমি এর বিরোধী। আমি যে কোন স্টেরিওটাইপ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেখানে জন্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে বেতনের ক্ষেত্রে পার্থক্য করা হয় এবং এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে আমি আমার মতামত জানিয়ে দিয়েছি সেক্রেটারি অব স্টেটকে।” সে সময় ইউরোপীয় কর্মচারীরা সমমর্যাদার ভারতীয় চাকরিজীবীদের থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা পেতেন। তার একটি ছিল গ্রীষ্মকালে পাহাড়ে অবস্থান ও কয়েক বছর পর পর ‘হোমে’ যাওয়ার জন্য সবেতন ছুটিসহ ভ্রমণ ভাতা। এ বৈষম্য ভারতীয়দের মনে স্বাভাবিকভাবেই হীনম্মন্যতাবোধে আক্রান্ত শিক্ষক উচ্চ বিদ্যাপিঠে ছাত্রদের আত্মমর্যাদাবান করে তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি নিয়োগ নিয়ে তারা চিঠি চালাচালি করেছেন। রোনাল্ড শ’ সফরে বেরিয়েছেন। তারপরও দেখি, তাঁবুতে বসে রাতে লন্ঠনের আলোয় হার্টগ-কে ১০ পৃষ্ঠার চিঠি লিখছেন। আমি দু’একটি উদাহরণ দেব মাত্র। রোনাল্ড শ’ বিভিন্ন বিভাগীয় পদে নিয়োগের জন্য কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ইংরেজীর প্রফেসর পদের জন্য তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এফ সি টার্নারের নাম। আরবির প্রফেসর হিসেবে ড. জিয়াউদ্দিন ও ড. সিদ্দিকির নাম। এছাড়া আইইএস ক্যাডার থেকে দর্শনের প্রফেসরের পদের জন্য জর্জ হ্যারি ল্যাংলি, ইংরেজীর জন্য ইগারটন স্মিথ ও অঙ্কের জন্য বি এম সেনের নাম বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। প্রফেসর ল্যাংলি ছিলেন তখন ঢাকা কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ পদে তাকে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে ১৯২৬ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঐ পদে ছিলেন তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত। প্রফেসর বিএম সেনগুপ্তও ছিলেন ঢাকা কলেজে এবং অঙ্কবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতিও ছিল। অঙ্ক বিভাগের প্রধান ও প্রফেসর হিসেবে তাঁকেও নিয়োগ করা হয়। তবে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের ভার গ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান। ইগারটন, স্মিথ ও টার্নারের ক্ষেত্রে গবর্নরের অনুরোধ রক্ষা করা যায়নি। টার্নারের ব্যাপারে হার্টগ গবর্নরকে জানিয়েছিলেন, টার্নার নিজেও এ পদে যোগ দিতে চাইবেন কিনা সন্দেহ। “কাগজপত্রে তাঁর যা যোগ্যতা দেখা যাচ্ছে তা সামান্য। দু’বছর ধরে তিনি বিষয়টি পড়াচ্ছেন অথচ এ বিষয়ে তাঁর কোন লেখাজোখা নেই। তাঁর এমন কোন একাডেমিক কৃতিত্বও নেই যে কারণে রিডার হিসেবেও তাঁর নিযুক্তির যৌক্তিকতা দেখানো যেতে পারে।” হার্টগ আরও লিখেছেন, টার্নার তাকে জানিয়েছেন লেকচারশিপ ও সঙ্গে একটি প্রভোস্টশিপ বা ট্রেজারার পদ দিলেই তিনি সন্তুষ্ট, তবে বেতন হতে হবে ১৯০০ টাকা। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে টার্নার তখন হয়ত এই বেতন পেতেন। কিন্তু হার্টগ তাতেও রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে, মাসে ১৯০০ টাকা বেতন একটু বেশি। কারণ, একজন প্রভোস্টের একাডেমিক কাজ থেকে প্রশাসনিক কাজ বেশি। টার্নার পরে ঢাকা হলের প্রভোস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রন্থাগারিক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সঙ্গে ইংরেজীর অনারারি লেকচারশিপ। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে বিজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে আবেদন করেছিলেন এবং যাদের যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি তাদের জানিয়ে দিতে বলা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন ফনেটিকসে নোয়েল আর্মফিল্ড, ইংরেজীতে মি. পিংক ও ইতিহাসে মি. হালিম। আবদুল হালিম পরে অবশ্য ইতিহাস বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন লেকচারার হিসেবে। ৫ অক্টোবর লন্ডনের বোর্ড অব এডুকেশনের পরিচালক টুয়েন্টিম্যান হার্টগকে জানালেন যে পদার্থবিদ্যা বিভাগের তিনজন প্রার্থীÑ মল্লিক, সাহা ও মসকে ডাকা হচ্ছে। এক সপ্তাহ পর গবর্নরকে হার্টগ বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগের একটি সারমর্ম পাঠান। তিনি জানান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর উচ্চতর পদসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে চেয়ারম্যান ও রিডারশিপের জন্য উপযুক্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। ইতিহাস ও পলিটিক্যাল ইকোনমির ক্ষেত্রে একই আস্থা। রসায়ন বিভাগের জন্য ড. জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ নামে একজন, ‘রিমার্কেবল ইয়ং ইন্ডিয়ান’কে পাওয়া গেছে যার গবেষণা ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু, হার্টগ জানালেন, তাঁর বয়স মাত্র ২৮। বিশেষজ্ঞরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন এবং নির্বাচকম-লীও একমত যে, সম্ভব হলে অর্গানিক কেমেস্ট্রির ‘চেয়ার’ ও পরিচালনার ভার দেওয়া উচিত ঢাকা কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ও বর্তমানে (অর্থাৎ ১৯২০ সালে) কানপুরে কর্মরত ইআর ওয়াটসনকে এবং ঘোষকে ‘ফিজিক্যাল কেমেস্ট্রি’র প্রফেসর পদ দেওয়া উচিত। এটি হবে একটি ‘ধফসরৎধনষব পড়সনরহধঃরড়হ’. তারপর ভারতবর্ষ থেকে ইনঅর্গানিক কেমেস্ট্রির জন্য একজন রিডার খুঁজে বের করতে হবে।
×