ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ নূরুল হুদা

নজরুলের ‘জয় বাংলা’

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২৭ আগস্ট ২০১৫

নজরুলের ‘জয় বাংলা’

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, সুরমা-ধলেশ্বরী-কর্ণফুলী, আরও কত শত নদ-নদীবাহিত, পলিগঠিত এই বঙ্গীয় অববাহিকা। অনাদিকাল থেকে এই ব-দ্বীপ ভূমিতে বিবর্তমান মানবগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যসূচক অভিধার নাম বাঙালী। আর তার বসতভূমির নাম বাংলা নামের দেশ। ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী ধারাবাহিকতায় পূর্ব দৃষ্টান্তরহিত এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম-জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ার মুহূর্তে তার সাংবিধানিক নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। এ কারণে এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের কাছে ‘নদী বা বদ্বীপ বা পলির মতো অনিবার্য ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের মতোই ‘বং, বাংলা বা বাঙালী’ শীর্ষক শব্দত্রয়ীও তার সত্তার পরিচয় নির্ণয়ে বিকল্পরহিত ব্যক্তিক ও সামষ্টিক অভিধা। আসলে হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় বাঙালী এই অভিধা স্বতঃপ্রাকৃতিকভাবেই অর্জন করেছে। এই অভিধা যেমন তার আপন অর্জন, তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের পথও প্রায় স্বতঃসিদ্ধতাজাত। তাই এই জাতিরাষ্ট্র ও তার নাগরিকের সার্বিক বিজয় মানে বাংলা ও বাঙালীর বিজয়। ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে এই সত্যটি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অনুধাবন করেছেন বাংলার লোককবি, লোকদার্শনিক ও ভাবুক সম্প্রদায়। আর তারই প্রকাশ দেখি ইতিহাসস্বীকৃত যুগে বাঙালী কবির মৌখিক ও লিখিত অভিব্যক্তিতে। বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত দলিল ‘চর্যাপদে’র কবি ভুসুকর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘বাঙালী’ অভিধাটি (‘আজি ভুসুকু বঙালি ভইলি’)। মধ্যযুগের কবি শ্রীধর দাসের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, তার মাতৃভাষার নাম বাংলা, যদিও তার সাহিত্যচর্চার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। কেননা সমাজ তখন তাঁকে অন্য ভাষায় সাহিত্যচর্চার অধিকার দেয়নি। অথচ তিনিও তাঁর মাতৃভাষা বাংলাকে গঙ্গাজলের মতোই পবিত্র মনে করেছেন। পাশাপাশি স্মরণযোগ্য মধ্যযুগের মুসলমান কবি আবদুল হাকিমের কণ্ঠে উচ্চারিত মাতৃভাষার সপক্ষে তীব্র শ্লেষাত্মক উক্তি, ‘যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। তার পর থেকে বাংলা ও বাঙালিত্বের এই ধারণা, প্রেরণা, শক্তিমত্তা ও বহুমাত্রিকতা বাঙালী কবির চিত্তে কত বিচিত্র পথে সংজ্ঞায়িত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই বিষয়ে একটি অনুপুঙ্খ গবেষণা হলেই কেবল এর ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা যাবে। চর্যা-কবি, মঙ্গল-কবি, পুঁথি-কবি, বৈষ্ণব-কবি বা বাউল-কবির পরম্পরা পেরিয়ে পাশ্চাত্য মনন-দর্শনে সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বভিখারি ও আধুনিক হওয়ার মুহূর্তেও আধুনিক বাঙালী কবিরা অভ্রান্তভাবে বাংলা নামক দেশ ও বাংলা নামক ভাষার অনিবার্যতার জয়গান করেছেন। মাইকেলের মাতৃভাষা বন্দনা বাঙালীর বোধ ও বিবর্তনের ইতিহাসে এ রকমই এক নির্ণায়ক ঘটনা। আসলে এই হচ্ছে ইতিহাসের সেই কাব্যসম্মত রায়, যা অদ্যাবধি বাঙালী কবি, সারস্বত সমাজ ও বাংলার সর্বশ্রেণীর লোক-মানুষকে সর্বাংশে মাতৃভাষী তথা বাংলাভাষী করে রেখেছে। তা না হলে বাংলাদেশ, বাঙালী জাতি ও বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্নতর মানসিকতার দাসত্ব বাঙালীকে স্ব-সত্তা থেকে বিযুক্ত করে ঔপনিবেশিকতার স্বর্ণশিকলে চিরপরাধীন করে রাখত। আসলে বাঙালী কবির কাছে বাঙালী ও বাংলার জয়গান মানে তার শনাক্তকৃত স্ব-সত্তার স্বাধীনতার গান। এই পথেই বাঙালী এগিয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার গন্তব্যে। বঙ্গভঙ্গের আশঙ্কায় ব্যথিত কবিচিত্ত তাই বাউল বাঙালীর সুরে ও উক্তিতে বিশ শতকের শুরুতেই জয়গান করলেন অখ- বাংলার রূপৈশ্বর্যের : ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সঙ্গে সঙ্গে তাই হয়ে গেল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-মত-পথ নির্বিশেষে বাঙালীর জাতীয় উচ্চারণ, যার সর্বজনীন স্বীকৃতি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। আর এই বোধ-বিবর্তনের পথে বাঙালী কবির কণ্ঠে বিজয়সূচক ব্রহ্মধ্বনি : ‘জয় বাংলা’। এটি উচ্চারিত হয়েছে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে, যখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি লিখলেন। কবিতাটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ভাঙার গান’ শীর্ষক গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ (১৯২৪ সালের আগস্ট) মাসে প্রকাশিত হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যে অর্থাৎ ১১ নবেম্বর তারিখে বইটি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তারপর থেকে এই বইয়ের ওপর এই নিষেধাজ্ঞাটি আর প্রত্যাহার করা হয়নি। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট/ ভেঙে ফেল র্ক রে লোপাট/ রক্ত-জমাট/ শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!/’। মাত্র এগারোটি কবিতা নিয়ে সঙ্কলিত এই ব্রিটিশত্রাসী কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতা ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ মাদারীপুরের শান্তি সেনাবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারামুক্তি উপলক্ষে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করেন। কবিতাটি তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করেন এবং হারমোনিয়াম সহকারে গেয়ে শোনান। ছয় পঙ্ক্তির নয়টি স্তবকে সজ্জিত (মোট পঙ্ক্তি ৫৪) এই দীর্ঘ কবিতাটি নজরুল তাঁর স্বভাবসুলভ মাত্রা মাত্রাবৃত্তের ধ্বনি ঝঙ্কারে সংগ্রথিত করেছেন। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে ছয় মাত্রার তিনটি পর্ব ও তারপর একটি অপূর্ণ পর্ব। এই বিন্যাস একটি সুসজ্জিত সৈন্যদলের শৃঙ্খলাপরায়ণ মার্চপাস্টের ভঙ্গি ও বীর্যবত্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কবিতার সুশৃঙ্খল চরণে-স্তবকে বাংলার ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তির পাশাপাশি বাঙালীর ভবিষ্যত মুক্তিযুদ্ধ ও অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের বার্তা আভাসিত হয়ে আছে। আশ্চর্যজনকভাবে এই কবিতার ৫১ ও ৫২ পঙ্ক্তি নিম্নরূপ : ‘জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম/ শত্রু-খড়্গছিন্ন-মু- দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম’। তারপরেই এক অবিসংবাদিত নেতার প্রতি কবির স্বাগতিক উচ্চারণ : ‘স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর,/ বাংলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’ জননীর আদেশ পেলেই মুক্ত সেনানী হুকুম দেবেন যুদ্ধের এবং সেই ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর ছিন্ন মস্তক লুটাবে জননীর পায়ের তলায়। এখানে সম্ভাব্য হুকুমদাতা মাদারীপুর তথা ফরিদপুরনিবাসী এক বিপ্লবী, যিনি সদ্য কারামুক্ত। কী আশ্চর্য, তার মাত্র ৪৭ (১৯৭১-১৯২৪=৪৭) বছর পর সর্বযুগের আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালী বিপ্লবী ‘জননীর আদেশ পেয়ে’ অর্থাৎ ‘নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে’ ঘোষণা করছেন বাংলার পূর্ণাঙ্গ ‘স্বাধীনতা’ আর হুকুম দিচ্ছেন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের (৭ মার্চ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, ফরিদপুরবাসী)। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকাব্যেও ‘স্বাধীনতা’, ‘হুকুম’ ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিগুচ্ছ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। আর এ-ও লক্ষ্য করার বিষয় যে, কবিতাটির ২৭নং পঙ্ক্তির শুরুতেই ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনি বাংলা ভাষায় প্রথম উচ্চারিত : ‘জয় বাঙলা-র পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ’। ২৮নং পঙ্ক্তি : ‘জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন’। এই জোড়া পঙ্ক্তিতে (২৭-২৮) ‘জয়’ ধ্বনিটি ঘূর্ণিছন্দে পাঁচবার উচ্চারিত হয়েছে এবং নজরুলের আরেকটি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ গদ্যে (‘বাঙালির বাঙলা’) একই আবহে বার বার প্রযুক্ত হয়েছে। ‘যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র মহাশয়ের পর ভবিষ্যত নেতা-সেনানীদের প্রতিও এই আহ্বান সম্প্রসারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহ্যিক ধারারই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত নেতা-সেনানী; আর তাঁর কণ্ঠেই পুনরুচ্চারিত সেই বিজয়-ধ্বনি : ‘জয় বাংলা’। ১৯৪২ সালে রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও : এই পবিত্র বাংলাদেশ/ বাঙালির-আমাদের।/ দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়/ তাড়াব আমরা করি না ভয়/ যত পরদেশী দস্যু ডাকাত/ রামা-দের গামা-দের’। বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ কাজেই ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক বাঙালীর চিরকালীন জয়ধ্বনির উৎস নজরুলের চিরদ্রোহী কবিচিত্ত। তাঁর প্রথম উচ্চারণও যে নজরুলেরই চিরমুক্ত কবিকণ্ঠ, তা আজ তর্কাতীত। নজরুলের ‘বিদ্রোহী আত্মা ও স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার’ সুস্পষ্ট শনাক্তকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সচেতনভাবেই নজরুলের কাছ থেকে এই ব্রহ্মধ্বনি গ্রহণ করে সকল কালের সকল বাঙালীর জন্য পুনরায় উন্মুুক্ত করেছেন। নজরুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালীর স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। ... পরাধীন জাতির তিমিরঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধুলায়।’ কাজেই নজরুল ও বঙ্গবন্ধু উক্তিতে ও উপলব্ধিতে অভিন্ন। একজন বিদ্রোহের উচ্চারক ও পরিকল্পক, অন্যজন তার ধারক ও বাস্তবায়ক। বাঙালীর পরিশ্রুত প্রতিকৃতির নাম নজরুল আর বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিষয়টি বক্ষ্যমাণ কবিতার টেক্সট বিশ্লেষণ করে আরও পূর্ণতা দেয়া আবশ্যক। বিষয়টি সামাজিক ও নান্দনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যা হোক, বাঙালীর এই বিদ্রোহী সত্তা ও বিজয়ী চেতনার ধারাবাহিকতার আলোকে একালের কবির প্রতিধ্বনি : ‘নজরুলের সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাংলার গণপ্রকৃতি, বিলঝিল, শঙ্খচিল, ধরিত্রী উদগ্রীব.../ নজরুলের সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাঙালীর জাতিপিতা শেখ মুজিব।/ সেই থেকে এই ধ্বনি অনন্তপ্রবাহিনী।/ সেই থেকে এই ধ্বনি বাঙালির বিপদনাশিনী।/ সেই থেকে এই ধ্বনি জনগণমন গিরিতটমন সাগর-নদীর।/ সেই থেকে ‘বল বীর বল চির-উন্নত-মম শির’।/ বিদ্রোহী বাঙালী ও বিজয়ী বাঙালীর এই জয়ধ্বনি ক্রমপ্রসারমান বিশ্ববাঙালীর বুকে-মুখে হয়ে উঠুক এক অসাম্প্রদায়িক ও অভিন্ন উচ্চারণ। ২৫.০৮.২০১৫ লেখক : জাতিসত্তার কবি, নজরুল গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক
×