ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ ১২ ভাদ্র

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না...

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৭ আগস্ট ২০১৫

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না...

মোরসালিন মিজান ॥ ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম...। এভাবে সব বলে কয়েই যেন বিদায় নিয়েছিলেন চির অভিমানী কবি। বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষে বিদ্রোহী বীর সাম্য প্রেম মানবতার কবি কা-ারীকে থামতে হয়েছিল। তারিখটিÑ ১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। আজ সেই দিন। আজ ১২ ভাদ্র ১৪২২ বঙ্গাব্দ বুধবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম প্রয়াণ দিবস। কবির ভাষায়Ñ তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/ কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ...। আজ নানা আয়োজনে সারাদেশে দিবসটি পালিত হবে। কথা গান কবিতায় প্রিয় কবিকে অঞ্জলি জানাবেন দুই বাংলার ভক্ত অনুরাগীরা। নজরুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন যুগস্রষ্টা। বিস্ময়কর এক আলো হয়ে জ্বলছেন। পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। জাত চেনাতে কবি নিজেই লিখেছিলেনÑ‘আমি চির বিদ্রোহী বীরÑ/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ তবে শুধু বিদ্রোহী বীর নন, তিনি ছিলেন ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অবমানিতের মরম- বেদনা, বিষ-জ্বালা’ নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ারটির স্রষ্টা তিনি। অসাম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস- চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোাহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থেও ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়। গদ্য রচনার সময়ও স্বতন্ত্র চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এখানে বসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সংকলন ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন ‘যুগবাণী’। তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগ বিস্মিত করে বড় বড় প-িতের। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সকল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি। সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছেন। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। অথচ জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। ক্ষণজন্মা মানুষটি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের পড়ালেখার শুরু মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন কবি। বালক বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যোগ দেন লেটো দলে। এই লেটো দলেই তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। পরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। যৌবনে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনযাপন করেন নজরুল। তবে ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চির বিদ্রেহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। ৩৯তম প্রয়াণ দিবসে আজ নানা আয়োজনে স্মরণ করা হবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। শ্রদ্ধা জানানো হবে। প্রতিবারের মতো খুব ভোরে মানুষের ঢল নামবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত কবির মাজারে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন প্রিয় কবিকে। দিনভর চলবে আলোচনা আবৃত্তি ও কবিতার আয়োজন। বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। তবে আজকের দিনে কবির একান্ত চাওয়াটির কথা মনে রাখা চাই, যেখানে কবি বলেছেনÑ যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগী-বীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি...।
×