ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্তে ব্যাপক সংঘর্ষ ॥ আরাকান সন্ত্রাসী হামলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৭ আগস্ট ২০১৫

বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্তে ব্যাপক সংঘর্ষ ॥ আরাকান সন্ত্রাসী হামলা

মোয়াজ্জেমুল হক/বাসু দাশ/এইচএম এরশাদ ॥ বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে হামলা চালিয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আরাকান আর্মি। এ ঘটনায় বিজিবির এক নায়েক ও এক সিপাহী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বিজিবি সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সদস্যদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে। বুধবার সকাল পৌনে নয়টা থেকে দুপুর বারোটা নাগাদ বান্দরবানের থানচি উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম থানচির রেমাক্রি ইউনিয়ন সংলগ্ন বড়মদক সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির এ ঘটনা ঘটে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সদস্যরা ছিল ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আহত দুই বিজিবি সদস্যকে চিকিৎসার্থে জরুরী ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের একজনের নাম নায়েক জাকির হোসেন। অপরজন সিপাহী। তার নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। এদের চিকিৎসা চলছে এবং তারা শঙ্কামুক্ত। এ ঘনাকে কেন্দ্র করে বিজিবি সদর দফতরের নির্দেশে জরুরী ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর আলীকদম সেনানিবাস ও বিজিবির বলীপাড়া ব্যাটালিয়ন থেকে হেলিকপ্টারযোগে অতিরিক্ত সেনা ও ফোর্স প্রেরণ করা হয়েছে। বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ সন্ত্রাসী তৎপরতা দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে বান্দরবানের সীমান্ত এলাকার ওই অংশে সেনা ও বিজিবি সদস্যের যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ ঘটনার পর বিজিবির পক্ষে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সীমান্ত বন্ধ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। সংঘটিত এলাকায় হেলিকপ্টারযোগে সেনাবাহিনী ও বিজিবির স্থল টহল জোরদার করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় জারি করা হয়েছে সতর্কাবস্থা। ফলে এলাকাজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বিজিবি ও স্থানীয়সহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবান-মিয়ামনার সীমান্তের দুর্গম ওই এলাকায় মিয়ানমারের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের আনাগোনা রয়েছে। এরা চোরাচালান, মাদক চালান, অস্ত্র বেচাকেনাসহ নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত । বিজিবির ৩৩ বিওপি (সীমান্ত চৌকি) এলাকাটি সীমান্তের ২শ’ গজেরও বেশি অভ্যন্তরে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী এসব সন্ত্রাসী তাদের গোলাবারুদ ও রসদসামগ্রী বহনে ব্যবহার করে থাকে মাউন্টেন হর্স (গাধা)। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশী সীমানাভ্যন্তরে বিজিবি এ ধরনের ১৩টি মাউন্টেন হর্স আটক করে। এ নিয়ে প্রথম দফা গোলাগুলি হয়। এতে দুটি মাউন্টেন হর্স মারা যায়। এর পর বুধবার সকাল পৌনে নয়টা নাগাদ আকস্মিকভাবে আরাকান আর্মির সদস্যরা বিজিবি ক্যাম্পে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে হামলা চালায়। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসীরা বিজিবি ক্যাম্পটিও দূর থেকে ঘেরাওয়ের চেষ্টা চালায়। আর তখনই সীমান্তের অতদ্র প্রহরী বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। আরাকান আর্মির পক্ষ থেকেও এর জবাব আসতে থাকে। এভাবে প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ উভয়পক্ষে ব্যাপক গুলিবিনিময় হয়। এ সময় বিজিবির নায়েক জাকির হোসেনসহ উল্লেখিত সিপাহীর হাতে গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। এরই মধ্যে এ ঘটনার খবর পৌঁছে যায় বান্দরবান, আলীকদম সেনানিবাস, বিজিবির বলীপাড়া ব্যাটালিয়ন দফতরে। শুরু হয়ে যায় ব্যাপক তৎপরতা। বিজিবির সদর দফতরের নির্দেশনা নিয়ে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয় দুটি হেলিকপ্টার বোঝাই সেনা সদস্য ও বিজিবির চৌকস সদস্যদের। এরই মধ্যে আরাকান আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা সীমান্তের ওপারে গহিন অরণ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় দুপুরের পর বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনা নিয়ে তিনি জানান, থানছি সীমান্তে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ অপতৎপরতা রুখে দিতে অতিরিক্ত সেনা ও বিজিবি সদস্যকে প্রেরণ করা হয়েছে। আমরা প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে যাচ্ছি। প্রয়োজনে আরও সেনা ও বিজিবি পাঠানো হবে। তারা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবে। তিনি আরও জানান, আমরা একটি পরিকল্পনা করে রেখেছি। তিনি সাংবাদিকদের কাছে বড়মদক এলাকাটির ম্যাপ দেখিয়ে বলেন, ওই এলাকায় একটি হেলিপ্যাড তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। কিছুদিন আগে ৫২ ও ৭৫ নম্বর পিলার সংলগ্ন এলাকায় বিজিবির পক্ষ থেকে অপারেশন চালানো হয়েছে। তিনি জানান, এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম। আকাশ ও নদীপথ ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। নদীপথে বান্দরবান থেকে সেখানে পৌঁছতে চৌদ্দ থেকে পনেরো দিন সময় লাগে। ইতোমধ্যে সুবিধাজনক একটি স্থানে হেলিকপ্টার থেকে সেনা ও বিজিবি সদস্য অবতরণ করেছেন। তিনি ¯পষ্ট ভাষায় জানান, আগামী বেশ কিছুদিন সেখানে ক্রমাগত অপারেশন চলবে। মাউন্টেন হর্স আটক প্রসঙ্গে বিজিবি প্রধান জানান, এগুলো আরাকান থেকে আসা। আরাকানের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা তাদের রসদ পাঠানোর কাজে এগুলো ব্যবহার করে থাকে। গত মঙ্গলবার এ ধরনের তেরোটি ঘোড়া আটক করার কারণেই আরাকান আর্মি বিজিবির ওপর এ আক্রমণ চালিয়েছে বলে তার ধারণা। সেখানকার তিন্দু ও আন্ধারমানিক এলাকা থেকে এসব মাউন্টেন হর্স আটক করে বড়মদক বিজিবি ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। এদিকে, থানছির রেমাক্রি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মালিরাম ত্রিপুরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, থানছির বড়মদক বিজিবি ক্যাম্প লক্ষ্য করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দফায় দফায় গুলি চালায় এবং ক্যাম্পটি ঘিরে রাখে। থানছির সিংগাপা মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) সিং মৈ অং মারমা সাংবাদিকদের জানান, গোলাগুলির ঘটনায় স্থানীয়দের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন এলাকার তিন্দু, রেমাক্রি ও বড়মদক এলাকায় জনসাধারণের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে আরাকান রাজ্যের আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি), সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার গভীর অরণ্যে ঘাটিগেঁড়ে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি করে আসছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড়মদক বাজারে দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্বাভাবিক জন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সর্বত্র বিরাজ করছে অজানা এক ধরনের শঙ্কা। বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, বড়মদক এলাকায় সাঙ্গু নদীতে বিজিবির একটি টহল বোটে সর্বপ্রথম আরাকান আর্মির সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে। এর পর বিজিবির বড় ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে হামলা চালায়। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির সদস্যরা বুধবার অহেতুক বিনা উস্কানিতে এ ঘটনা ঘটানোর পর থানছি, আলীকদম, নাইক্ষ্যছড়ি, গুমধুমসহ প্রতিটি বিওপি সংলগ্ন এলাকায় সীমান্তরক্ষীদের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। সূত্র জানায়, আরাকান রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ সীমান্ত সংলগ্ন নোম্যান্স এলাকার গহিন অরণ্যে একাধিক আস্তানা গড়ে তুলেছে। কিছু গ্রুপ মসজিদ-মাদ্রাসার নামে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান করেছে। এসব গ্রুপের আসল লক্ষ্য বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে এসব সংগঠন স্বাধীনতা দাবির নামে মূলত নাশকতা ও বেআইনী কর্মকা-ে জড়িত। আরাকান স্বাধীনতাকামী অস্ত্রধারীরা খুনখারাবিও করে আসছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন ইতোপূর্বে বিভক্ত হলেও পরবর্তীতে এক হয়েছে। নূপা (ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকান), এএলপি (আরাকান লিবারেল পার্টি) ও এডিএসবি (আরাকান ডেভেলপমেন্ট স্টুডেন্ট পার্টি মিলেই গঠিত হয়েছে আরাকান আর্মি। এ দলের বেশিরভাগই রাখাইন জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভারি অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত কেউ কেউ। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী গহিন অরণ্যের এসব ঘাঁটিতে কমপক্ষে ৫ হাজার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীর অবস্থান রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরে প্রায় দশ হাজার রাখাইন জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণে লিপ্ত বলেও জানা গেছে। অপরদিকে, কারেন্ট নামে আরেকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন এদের প্রশিক্ষণে সহায়তা করছে। এরা সবাই ‘স্বাধীন আরাকান’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে। ওই সব বিচ্ছিন্নতাবাদীর ঘাঁটি সম্পর্কে মিয়ানমার সরকার পুরোপুরি অবগত থাকলেও নিরাপত্তাজনিত হুমকি থাকায় মিয়ানমার সরকার সেখানে অভিযান পরিচালনা করে না। তবে এসব বিচ্ছিন্নতাবাদীর দাবি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার আরাকান আর্মির দেয়া প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আরাকান আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা সীমান্তবর্তী এলাকার গভীর অরণ্যে ঘাঁটি গেঁড়েছে। এদের পাশাপাশি রয়েছ অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপের অবস্থান। এরা সময়-সুযোগ বুঝে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালান কর্মকা- চালায়। বান্দরবান সীমান্ত এলাকায় যে পপি চাষ হয় তা এসব সংগঠনের অর্থায়নেই হয়ে থাকে। এদের সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ। প্রতিবছর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এসব পপিক্ষেত ধ্বংস করার অভিযান চলে। সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, দুর্গম এলাকা হওয়ায় বড়মদকে বিজিবি নিয়মিত টহল ও অভিযান চালায় না। ফলে সীমান্তের অরক্ষিত ওই এলাকায় আরাকান আর্মিসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের শক্ত অবস্থান গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা গেছে, আরকান রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও, আরইএফ, ওআরএনওসহ এসব বিচ্ছিন্নতাবাদীকে মিয়ানমার সরকার নিষ্ক্রিয় করতে না পারায় এদের শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের সঙ্গে মিয়ানমারের যতটা যোগাযোগ তার চেয়ে বেশি যোগাযোগ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কিছু নেতা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখান থেকে তারা নিয়মিতভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এদের অস্ত্র যোগানসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতায় লিপ্ত। বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি চলছে। বর্তমানে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। তবে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সীমান্ত এলাকার লোকজন রয়েছে ব্যাপক উৎকণ্ঠায়। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহিংস তৎপরতার শিকারে পরিণত হওয়ার শঙ্কা তাদের মাঝে বিদ্যমান। আর এ কারণেই সীমান্ত এলাকাজুড়ে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ অবস্থানে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
×